জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি
বঙ্গভবন
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবিএম ইলিয়াস (অবঃ)
সাবেক সামরিক সচিব
০১। বঙ্গভবন রাষ্ট্রের একটি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। আমি যখন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে আসি, তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন সরকার প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান। কোনো বেসামরিক প্রতিষ্ঠানে এইটিই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি তখন কুমিল্লার একটি নতুন আর্টিলারী ব্রিগেডে (৩৩ আর্টিলারী) প্রথম ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলাম।
তারিখটা বোধহয় ছিলো ১৪ অথবা ১৫ জুন, ১৯৮৪। সকাল ১১টার দিকে আমার জিওসি. জেনারেল শফি আহমেদ চৌধুরী আমাকে টেলিফোনে অফিসে ডেকে পাঠালেন। আমি জেনারেল শফি আহমেদ চৌধুরীর অফিসে গেলে তিনি আমাকে জানালেন যে, এম.এস.পি. পদে বঙ্গভবনে আমার পোষ্টিং হয়ে গেছে এবং আমাকে যতো শীঘ্র সম্ভব যোগদান করতে হবে। আমি তা পছন্দ করতে পারলাম না। কারণ একজন সৈনিক হিসেবে সামরিক বাহিনীর কর্মশীল (এ্যাকটিভ) ইউনিটে থাকাই আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
তাই এই পোষ্টিং বন্ধ করার জন্য জিওসি-কে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি রাজি হননি। পরের দিন আমি মেজর জেনারেল মান্নান সিদ্দিকীকে সেনাসদর দফতরে টেলিফোনযোগে অনুরোধ করে ব্যর্থ হই। এইভাবে ৩/৪ দিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ২১ শে জুন, ১৯৮৪ তারিখে এমএসপি হিসেবে বঙ্গভবনে যোগ দেই। ব্যাপারটি ছিলো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
০২। দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বঙ্গভবন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র এই বঙ্গভবন (এখন নয়)। যে কোনো সৈনিকের মনেই একটু ভয়, দ্বিধাদ্বন্দ বা আড়ষ্টতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি।
হ্যা, তবে একটি কথা মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিলো এবং সেটি ছিলো এই, “হে আল্লাহ আমি যেনো আমার কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে সুষ্ঠুভাবে পালন করে সম্মানের সাথে এখান থেকে যেতে পারি”। আল্লাহপাক আমার এই ইচ্ছা পুরণ করেছিলেন। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে অনেকে আমার নামে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেছিলো বা বলেছিলো। কিন্তু তা আমাকে এতোটুকু বিচলিত করেনি। কারণ আমি জানি এমএসপি হিসেবে বঙ্গভবনে আমার দায়িত্ব কি ছিলো এবং আমি কি করেছি।
০৩। যদিও একান্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি বঙ্গভবনে যোগ দেই, কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য একজন সৈনিক হিসেবে সৈনিকের মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করি এবং আমার কর্মদক্ষতা ও বিশ্বস্ততার মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হই।
০৪। রাষ্ট্রপতি যখন সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান তখন সামরিক সচিবের দায়িত্ব অনেক। বিশেষ দায়িত্ব বলতে আর কিছু থাকে না।
কারণ, রাষ্ট্রপতি যা করেন তা সবই বিশেষ। সামরিক সচিবের ব্যর্থতা রাষ্ট্রপতিকে ব্যর্থ করে দেবে তথা সরকারের ব্যর্থতায় পরিণত হবে। কাজেই এখানে কাজে ব্যর্থ হয়ে বা সিদ্ধান্তে ভুল করে “দুঃখিত” বলার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই সব কর্তব্যই আমাকে বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে নিতে হয়েছে। এককথায় রাষ্ট্রপতিকে সরকার ও দেশ পরিচালনার সার্বিক যোগান আমাকে দিতে হয়েছে।
এটাই উল্লেখযোগ্য বিশেষ দায়িত্ব।
০৫। রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনেক বিদেশী ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন এবং এদের বেশীরভাগই সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান অথবা রাজ পরিবারের সদস্য বৃন্দ। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে উনারা বাংলাদেশ সফরে আসেন। ইয়াসির আরাফাত অনেকবার রাষ্ট্রপতির অফিসে এসেছিলেন।
একবার উনি আমাকে আবেগের সুরে বললেন, “ইলিয়াস এটা (রাষ্ট্রপতির অফিস) যদি আমার অফিস হতো কতো না ভালো হতো”। আমি বলেছিলাম- হয়তো স্যার এটা নয়, তবে এমন একটি অফিস কোনোদিন আপনার হবে। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন।
০৬। আমি সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক সচিব ছিলাম।
এই দীর্ঘ সময়ে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান আমাদের রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, চীনের রাষ্ট্রপতি লি সিয়ান নিয়েন, মালেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথীর মোহাম্মদ, চীনের প্রধানমন্ত্রী লী পেং, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউল হক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তুরগাত ওজাল, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়াস জয়বর্ধনে, নেপালের রাজা ও রানী, ভুটানের রাজা ও রাজার বোন, রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চেসিস্কো, ব্রিটেনের প্রিন্সেস এ্যান, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁ, চীনের প্রেসিডেন্ট, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট, আগা খান, পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর ওয়াইজ সাকার, জ্যোতি বসু শেখ আল নাহিয়ান, সৌদী রাজ পরিবারের সদস্য বৃন্দ এবং আরো অনেকে।
০৭। আর একটা অভিজ্ঞতা, যা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার পর হয়েছে। বঙ্গভবনে থাকাকালীন যেহেতু প্রশাসনের খুব কাছে ছিলাম, কাজেই অনেক কিছুই খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
তখন দেখেছি অনেক ব্যক্তিবর্গ অনেকভাবে অনেক ধরণের সুবিধা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা, কখনোবা ব্যবসায়িক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক। আমার অভিজ্ঞতায় যা বাস্তবে দেখেছি যে এই স্বার্থান্বেষী লোকগুলো ক্ষমতাসীনদের কতোভাবে সুখী ও খুশী করতে চায় এবং তাদের অনুগ্রহ লাভের জন্য তাদের আশেপাশে থাকার কতো কৌসল খুঁজে বেড়ায়। আর যখন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ক্ষমতা থেকে সরে যায়, তখন ওইসব স্বার্থান্বেষী লোকগুলো ভোল পাল্টিয়ে ফেলে এবং কৃতজ্ঞতাবোধে সহযোগিতা করার পরিবর্তে উল্টো ক্ষতি করে এবং বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আর যারা ওই ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে কিছুই পায়নি বা পাওয়ার চেষ্টাও করেনি, তারাই বারেবারে দুঃসময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়।
০৮। রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব থাকাকালীন আমার কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি যা আমাকে এখনও উদ্বেলিত করে- এমন বিশেষ কিছু বলা সঠিক হবে না। আমি প্রায় ৫ বছর সামরিক সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে ছিলাম, যা সচরাচর হয়না। এই দীর্ঘ সময়ে বঙ্গভবনে আমার সময় কেটেছে মিনিটে মিনিটে বা ঘন্টার হিসেব, দিনের হিসেবে নয়। প্রতিদিন আমাকে গড়ে প্রায় ১৩/১৪ ঘন্টা শুধু অফিসেই কাটাতে হয়েছে তা দিনের যে কোনো সময়েই হোকনা কেনো।
তাছাড়া বাইরের প্রোগ্রাম তো আছেই। এমনও দিন গেছে যে ৩/৪ ঘন্টা বিশ্রাম বা ঘুমানোর সময়ও আমার হয়নি। এই ব্যস্ততা আর কর্মচাঞ্চল্যের মাঝে কোনটা যে বিশেষ অভিজ্ঞতা বা কোনটা যে মনকে উদ্বেলিত করে- তা আলাদাভাবে মনে করতে পারছি না। তবে হ্যা, এটা বলা যায় যে- বঙ্গভবনে থাকাকালীন সম্পূর্ণ সময়টাকেই আমি একটি স্মৃতি বা ঘটনা বলে মনে করি- যা আমাকে আজোও আলোড়িত করে। অনেক সময় বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে, এই দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা করে কাজ করে কিভাবে আমি টিকে ছিলাম।
বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যার চোখ বঙ্গভবনের কোনো এক কোনায় পড়ে থাকা একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠিও এড়ায়না। এই দীর্ঘ সময়ে আমি ছুটিতে ছিলাম মাত্র একদিন। আমার বড় চাচার কুলখানিতে অংশ নেয়ার জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম।
০৯। পূর্বেই বলেছি আমি বঙ্গভবনে যোগদান করি ২১ জুন, ১৯৮৪।
দুই/তিন সপ্তাহ লেগে গেলো বঙ্গভবন ও বঙ্গভবনে কর্মরত লোকদেরকে চিনতে ও জানতে। তারপর আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য জানতে আরো কিছু সময় অতিবাহিত হলো। বিভিন্নভাবে ভবনটিকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম- ভেতরে ও বাইরে। এর মাঝে ৮/৯ মাস কেটে গেলো এবং ২/৩ বার দেশের বাইরে গেলাম যেখানে বঙ্গভবনের মতো ভবন দেখার সৌভাগ্য হলো। রাষ্ট্রপতির ভবন হচ্ছে বঙ্গভবন।
কিন্তু এই ভবনের অবস্থা দেখে বঙ্গভবনের প্রতি আমার যে একটা ধারনা ছিলো তা পুরোপুরিভাবে পাল্টে গেলো। বিশেষ করে আমি যখন বিদেশের ২/৩টি সেরকম ভবন দেখলাম।
১০। দেখতে দেখতে বঙ্গভবনে আমার প্রায় এক বছর হয়ে গেলো। একদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি কোনো এক অবসর মূহুর্তে আমাকে উনার অফিসে ডেকে বললেন, “ইলিয়াস, তোমার তো বঙ্গভবনে প্রায় এক বছর হয়ে গেলো।
এই বিল্ডিংটা সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা করছো কিনা। ” আমি বললাম- জ্বি স্যার, দেখছি, ভাবছি। রাষ্ট্রপতির ভবন এমন থাকতে পারে না, কিছু করা উচিৎ। ওইদিন আর বেশী কথা হয়নি। এর কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে উড়ির চরের জলোচ্ছাস হলো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী এবং শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী জয়বর্ধনে সমবেদনা জানাতে উড়ির চর দেখে গেলেন।
তার ২/৩ দিন পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক উড়ির চর দেখতে বাংলাদেশ আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং তিনি একদিন ঢাকায় থাকবেন তাও জানালেন। ভারত ও শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীদ্বয় বিমানবন্দর থেকেই স্বদেশ ফিরে যান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে নির্দেশ দিলেন তিনি এই মহামান্য অতিথিকে বঙ্গভবনে রাখবেন। তিনি আমাকে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে নিয়ে গেলেন এবং একটু বিরক্তির সুরেই বললেন যে, রুমটি আদৌ কোনো দেশের রাষ্ট্রপতির বাসের যোগ্য নয়। এটাকে কিছু করতে হবে।
আমি বললাম, স্যার সময় হাতে মাত্র ৭ দিন- দেখি কি করা যায়। “ও.কে” বলে উনি চলে গেলেন, আর কিছুই বললেন না। বেলা তখন ২.৩০। আমি তখনও খাইনি। রাষ্ট্রপতি ৩.৩০ মিনিটে গলফ খেলবেন বলে বাসায় চলে গেলেন।
আমি আমার অফিসে কাজ শুরু করলাম। এ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার তাহের তখন বঙ্গভবনে কর্মরত। ওকে নিয়ে ড্রইং, ডিজাইন এবং উপকরণ সব ঠিকঠাক করে রাত সাড়ে তিনটায় ঘরে ফিরলাম। সকাল ৮টা থেকে কাজ শুরু করতে হবে। দৈনিক তিন শিফট করে ৭ দিনে ২১ শিফটে কাজ শেষ করতে হবে।
৪ দিন চলে গেলো। রাষ্ট্রপতি আমাকে ডেকে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলেন। আমি বললাম যে দু’দিন পর আপনি দেখবেন। দু’দিন পর উনি রুমে এলে হতবাক হয়ে উনি শুধু দেখতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে ধপ করে সোফায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “This looks like that a President can live. How did you do it? Thank you Elias”. এখান থেকে শুরু হয় বঙ্গভবন নবরূপায়নের কাজ। তারপর ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভবনটি নবরূপায়িত হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩ বছর।
১১। ভবন নবরূপায়ন আমার কাজ বা দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা। ডাঃ মতিন তখন গণপূর্তমন্ত্রী। এমএসপি'কে সভাপতি করে বঙ্গভবন নবরূপায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হলো। যদিও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো, কাজ সব সময়ই আমাকে করতে হয়েছে।
কারণ রাষ্ট্রপতি সব কিছুই আমার উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং তার কারণ ছিলো প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটের নবরূপায়ন। ওটা দেখে হয়তো ওনার একটা বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিলো যে এই নবরূপায়নের জন্য যা দরকার (যেমন রং, ডিজাইন, ফার্নিচার, ফিটিংস ইত্যাদি) এ সব কিছুরই একটা ধারনা বা জ্ঞান আমার আছে যা রাষ্ট্রপতির অপছন্দ হবে না।
১২। এই নবরূপায়নের জন্য যে ডিজাইন বা উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রায়ই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ভবন বা কনফারেন্স সেন্টার থেকে নেয়া। যেমন ক্যাবিনেট রুম, যেখানে সাপ্তাহিক ক্যাবিনেট মিটিং হয়- তার আসবাবপত্র ১৯৮৫ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত ও.আই.সি. কনফারেন্স রুমের আসবাবপত্রের নমুনায় করা।
কারণ রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন ওইরকম আসবাপত্র দিয়ে তিনি ক্যাবিনেট রুমটি সাজাতে চান। আমি ক্যামেরা দিয়ে ওই রুমের ফটো তুলতে গেলে আমাকে নিষেধ করা হয়। পরে আমি প্রত্যেকটা ফার্নিচার ও রুমের ডিজাইন হাতে এঁকে নিয়ে আসি এবং ঢাকায় এসে সেই ড্রইং ফার্নিচারে রূপান্তরিত করে ক্যাবিনেট রুম সাজাই। এইভাবে বঙ্গভবনের প্রত্যেকটি রুম তথা সম্পূর্ন ভবনটি নবরূপায়িত করা হয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ভবন বা রাজবাড়ির ফার্নিচার বা রুমের নমুনা দেখে।
১৩।
এই ভবনটির প্রধান আকর্ষন হলো দরবার হল যেখানে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের পরিচয় পত্র গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, রাজরাণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই হলটির সব আসবাবপত্রই বিদেশ থেকে আনা। এই বিশেষ আসবাবপত্রগুলো ভিক্টোরিয়া নমুনার রৌজউড দিয়ে ইটালীর তৈরী এবং ইহার রং-এর সাথে আংশিক স্বর্ণ চূর্নের মিশ্রণ আছে যাহা রংকে সহজে নষ্ট হতে দেয়না। ইহা এন্টিক (পুরাতন বা প্রাচীন) মানের আবাবপত্র যা নুতন অবস্থায়ই অনেক পুরানো মনে হয় এবং ইহাই এই ফার্ণিচারের বিশেষ বৈশিষ্ট। এই রুমটির কোথায় কি রং লাগানো হবে এবং কোথায় কোন রকমের সোফা রাখা হবে প্রত্যেকটাই আমার হাতে করা।
১৪। ভবনের ভিতরে আলোক সজ্জার জন্য যে বাতিগুলো ছিল তা সমপ্রকৃতির (হোমেজেনাস) ছিলনা- তা ছিল বিভিন্ন ধরনের যা এই ভবনের জন্য খুব দৃষ্টি কটুর লাগতো। ১৯৮৫ কি ৮৬ সালে জার্মান চাঞ্জেলার জনাব ওয়াইজ সাকার বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং এই সেণ্ডেলিয়ার (১২০ বাল্ব যুক্ত) ও ওয়াল লাইটগুলো পশ্চিম জার্মান থেকে এই সফরের পূর্বে আনা হয় এবং বঙ্গভবনে স্থাপন করা হয়। ভবনের বাইরে লাইটিং সিষ্টেম নামেমাত্র ছিলো। সন্ধ্যার পরে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হতো।
প্রত্যেক নমুনার একটি করে লাইট, লাইট স্ট্যান্ড বিদেশ থেকে আনা হয়েছিলো এবং পরে ঢাকায় আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ও মিস্ত্রি দিয়ে নমুনা দেখে দেশে তৈরী করা হয়। এতে করে প্রায় ৩০% ব্যয় কমে যায়।
১৫। এখানে একটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করি। আমার মনে হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ না হলে বঙ্গভবনের আজকের এই রূপ হয়তো আমরা দেখতে পেতাম না।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে উন্নত মানের রুচির অধিকারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও তিনি ভবনটির কোথায় কি করতে হবে তা- সঠিকভাবে আমাকে বলেননি তবে আমি উনাকে বুঝতে পেরেছিলাম উনি কি চান? আর্কিটেক্ট এর সাথে আলোচনা করে সব বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তিনি তা অপছন্দ করেননি। হ্যাঁ তবে মাঝে মাঝে আমি যখন কোনো সিদ্ধন্ত নিতে দ্বিধা করতাম তখন উনার কাছে যেতাম এবং প্রায়ই উনার পছন্দ আমার পছন্দের সাথে মিলে যেতো।
১৬। আজ আমি বলতে পারি, বঙ্গভবনের প্রতি ইঞ্চি জায়গায় আমার হাতের ছাপ আছে এবং আমি যা ছেড়ে এসেছি তা তেমনিই আছে- এখনো পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।