salehin.arshady@gmail.com
সেপ্টেম্বর মাস, ১৯৯৬। এক শুক্রবারের আলসেমী ভরা সকালে শুয়ে শুয়ে তিন গোয়েন্দা পড়ছিলাম। তেমন সময় আরাফাত আসল রুমে...
- আমাদের এইখানে যে একটা পুকুর আছে জানস? ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করল আরাফাত।
- পুকুর?? কই পুকুর? সারা ক্যাম্পাসে তো আমি কোন পুকুর দেখলাম না। গুল মারিস না।
- প্রমিজ দোস্ত। শুনলাম এইখানে একটা বিশাল পুকুর আছে মসজিদের পাশে। বন-জঙ্গল দিয়ে রাস্তাটা ঢেকে গেছে তাই কেউ জানে না। সত্যি না মিথ্যা এটা তো দেখলেই জানা যাবে, যাবি নাকি দেখতে?? এডভেঞ্চার হবে একটা।
- আমার যেতে সমস্যা নাই।
কিন্তু যাবি কখন?? হাউস থেকে বের হব কিভাবে??
- আরে বেক্কল, শুক্রবারে নামাজ পড়তে যখন মসজিদে যাব তখনই কাট্টি মারব। নামাজ শেষ হবার আগেই চলে আসব।
- কি ফালতু আইডিয়া। সাদা পাঞ্জাবি পড়ে তুই ঘুর ঘুর করবি, আর কায়সার তোরে জামাই আদর দিবে??
- তাইলে??
- এক কাজ করি, স্কুলের রিসেস টাইমে যাই। তখন কেউ কিছু বলবে না।
…..
২
প্রথম চার টা পিরিয়ড বেশ উত্তেজনার সাথে কাটল। রিসেসের বেল পরার সাথে সাথেই সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমরা দুজন বেড়িয়ে পড়লাম এক অজানা রহস্যময় পুকুরে খোঁজে। মসজিদে যাবার রাস্তাটা বেশ জংলা, ইট বিছানো কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে জংলি ফুল আর ফলের গাছে ভর্তি। লাল লাল ছোট ছোট টমেটোর মত বিষ ফল ছিড়ে পকেটে পুরতে লাগলাম।
পরে এগুলো দিয়ে কিছু একটা করা যাবে। মসজিদের ডান পাশে ঘন বন। এর ফাঁক দিয়েই একটি অপ্রচলিত মাটির রাস্তা দেখা যাচ্ছে। গা ছম ছম করা পরিবেশ। ভিতরে ঢুকতে কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
আমাদের মসজিদে যে প্রতি বৃঃস্পতিবার রাতে জ্বীন আসে এই মিথ টা আগেই শোনা ছিল। তাই আমাদের ভয় আরো বেড়ে গেল। এখন মনে হয় দু ধরনের ভয় আমাদের বুকে চাপ দিচ্ছিল, ধরা পড়লে টিসির ভয় টা ভূতের ভয়ের চেয়ে ডমিনেটিং ছিল। এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল...
চোরের মত লুকিয়ে হেটে যাচ্ছি আমরা। আশে পাশে মানুষ জনের কোন চিহ্ন মাত্র নাই।
স্যারদের কোয়ার্টার এখান থেকে আর ও অনেক দূর। ঘন বনে হঠাৎ করেই পাখীদের কিচির-মিচির শুরু হল। পৃথিবীর সব পাখী মনে হয় এক সাথে ডেকে উঠল। আমাদের এখানে আসা টা বোধ হয় তারা পছন্দ করছে না। কিচির মিচির শব্দে কান ঝালাপালা লেগে গেল।
তারা কি আমাদের সাবধান করতে চাচ্ছে? নিষেধ করছে এখানে যেন না আসি?? কিন্তু নিয়তি বলে একটা বেপার আছে, সেই নিয়তির টানেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
যে পুকুরের নাম গন্ধ একদিন আগেও জানতাম না, সেটা এখন আমাদের চোখের সামনে। বিশাল পুকুর, চতুর্দিকে গাছ লাগানো। একটা বিশাল ঘাট ও আছে। এক রহস্যময় পুকুরকে আবিস্কারের আনন্দে আমরা কোলাকলি করলাম।
পুকুর ঘাটে বসলাম দুজন। সবাই কে কতক্ষনে এই কথা বলব এটা এখন বড় সমস্যা হয়ে গেল। আমাদের কেউ এটার কথা জানে না। এইদিকে রিসেসের টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে দিকে আমাদের আর খেয়াল নাই। এক অদ্ভুত আকর্ষনে আমরা পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছি।
পাখিদের ডাকা ডাকি হঠাৎ করে যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। চারদিক এখন অস্বাভাবিক রকম নিশ্চুপ। একটু ও বাতাস নাই কোথাও, গাছের পাতাও নড়ছে না। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গা টা কেমন যেন শির শির করে উঠল।
এই কথা টা আরফাতকে বলতে যাব, তার আগেই...
আরাফাত বলে উঠল চল পানিতে নামি।
- কি?? তোর মাথা খারাপ?? ক্লাসে যাবি না?
- ধুর রাখ তো। পানিতে কি যেন একটা আছে।
এই বলে সে শার্ট খুলে ফেলল। আমি তখন চিল্লাচ্ছি...দোস্ত প্লিজ চল।
আমার খুব ভয় লাগছে। রিসেস মনে হয় শেষ হয়ে গেছে... ক্লাসে আমাদের না পেলে খবর খারাপ করে ফেলবে। প্লিজ এমন করিস না। চল চল...
পানি সামনে থাকলে আমি না নেমে থাকতে পারি না। তুই ও নাম, তোরে সাতার টা শিখিয়ে দেই।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাগলামি করিস না। চল তাড়াতাড়ি।
আমার কোন কথায় পাত্তা না দিয়েই ও ঝাপিয়ে পড়ল পানিতে। ঘাটের সিড়িতে বসে আমি কাকুতি মিনতি করতে লাগলাম আর ও মনে আনন্দে বাটারফ্লাই মারতে লাগল।
এখন ওকে দেখে আমার হিংসা লাগছে। কত সুন্দর করে সাঁতার কাঁটে আরাফাত। আমি সাঁতার পারি না। ওর একটা কথা মনে পড়ে গেল, গ্রামে নাকি ও এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে চলে যায় সাঁতার কেঁটে। আফসোস আমি পারি না।
হঠাৎ পানিতে জোর আলোড়ন টের পেলাম। দূরে দুই জায়গায় পানিতে ঝাপ্টা ঝাপ্টি হচ্ছে। ক্রমশ পানিতে আলোড়ন তুলে যেন সামনে এগিয়ে আসছে...
- আরাফাত দেখ ঐ দিকে কি যেন হচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে আয়। প্লিজ...
- আরে রাখ তো এত... দরপোক কেন তুই??
- শালা মর তুই, আমি গেলাম
- যা যা...বাসায় আম্মুর কোলে বসে ফিডার খা গিয়ে...
... এটা শুনে আমার আতেঁ ঘা লেগে গেল।
অনেক রাগ হয়ে গেলাম।
হঠাৎ দেখি আরাফাত পানিতে খাবি খাচ্ছে। চিৎকার করে উঠল... দুখী বাঁচা বাচাঁ...কে যেন আমাকে পানিতে টানছে। আমার পা দুটো ধরে রাখসে...কিছু কর। পাখী গুলো আবার চেচামিচি শুরু করে দিল।
কেমন যেন নারকীয় একটা অবস্থা। এত চিতকারে কেমন হতবিহ্বল হয়ে গেলাম।
আমি সাঁতার পারি না। কি করব কিছু বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে ও ফাজলামো করছে, আমাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করছে...
পাড়ের খুব কাছে এসে সে হাত তুলে গোঙাচ্ছে, আর থাকতে পারলাম না।
শেষ সিড়িতে এসে ওর হাত টা ধরে টানতে লাগলাম। বেশ শক্তি দিয়ে কি যেন টানছে। আরফাত খাবি খাচ্ছে আর গোঙাচ্ছে। এক হ্যাচকা টানে আমাকেও পানিতে নামিয়ে আনল। পানির নীচের সিড়িতে দাঁড়িয়ে আরাফাতকে টানতে লাগলাম।
হঠাত আমার চোখ পানির নীচে আটকে গেল। এক থুড়থুড়ে বুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের চামড়া কুচঁকানো, বুড়ির চোখ দুটা টকটকে লাল আর বিশাল বড়, যেন এখন ই কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। হঠাত বুড়ি আমার হাত ধরে টান দিল...
আমি ভয়ে আরাফাতকে ছেড়ে দিলাম। আর জোরে টান দিয়ে আমার হাত টা ছাড়িয়েই দৌড় দিয়ে উপরে পাড়ে উঠে গেলাম।
তখনই আমি সেই রুপালি চিতল মাছ ২টা কে দেখি। ঐ জায়গায় মাছ দুটো বার বার ভেসে উঠছে... আরাফাত আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে...।
.........
৩
আরাফাত...
চমকে ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে ফযরের আযান দিচ্ছে। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে।
আজও এই বিভৎস স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে। এত বছর পরেও আমি ভুলতে পারি না সেই বুড়ির বিভৎস চেহারা...আরাফাতের করুন আর্তি।
Fact Files: * ঢাকার বুকে রেসিডেন্সিয়াল মডেলের সেই অভিশপ্ত পুকুর আজও আছে। সেখানে সাতার কাটা নিষেধ করা হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু প্রতিবছর একজন করে ছাত্র ডুবে মারা যায়।
বয়স্করা বলেন, ভোগ নেয় সেই পুকুর। আজ পুকুরের এই রহস্য টা অজানাও রয়ে গেল। অনেক ডুবুরী ঘন্টার পর ঘন্টা খুঁজেও সেই বুড়ি আর তার মাছ দুটোকে পায় নি।
[পোস্ট টি উৎসর্গ করলাম আমার বন্ধু আরাফাতকে, যে খুব ভালো বাটারফ্লাই স্ট্রোক পারত, পানিকে যে পাগলের মত ভালোবাসত, সেই পানিতেই যার লৌকিক স্বত্তা আজ শায়িত। ]
বিঃদ্রঃ উপরের ছবিটি বগা লেকের।
আর সমস্ত কাহিনী টাই কাল্পনিক। ব্লগার দুরন্ত স্বপ্নচারী ভাইয়ের ভূতের গল্প থেকে অনুপ্রানিত....।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।