[সবগুলো পর্বের লিংক লেখার শেষে দেয়া আছে]
৭.
গোপাল এসেছে। কিন্তু কিভাবে? গোপাল না মৃত! সাদা ধবধবে একটি কাপড়ে মোড়ানো গোপাল। পরিষ্কার কাপড়টি যেনো তার পবিত্রতা প্রকাশ করছে। পুরো ঘরটি একটি মিষ্টি গন্ধে ভরে গেছে। চেয়ারম্যান ভয়ে কাপা শুরু করেছেন।
তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না গোপাল ঠিক তার সামনে দাড়িয়ে আছে। চেয়ারম্যান বলে উঠলো, গোপাল..আরে গোপাল..!! তুই তুই...
আর কিছুই তিনি বলতে পারছেন না। তোতলাচ্ছেন আর কাপছেন। সাথে প্রচন্ড পানির পিপাসাও পাচ্ছে।
- গুরু ও গুরু! কেন আমারে এমনে মারলেন? কেন?
- যা যা..তুই কি চাস? যাহ যাহ...
গোপাল এবার তার মোড়ানো সাদা কাপড়টা খুলে ফেলে।
রক্তাক্ত পুরুষাঙ্গটি থেকে ঝরঝরিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার মারবেল পাথরে মোড়ানো মেঝে।
- ওমা ওমা... বাচা বাচা...
ধড়মড় করে করে তিনি জেগে ওঠেন। এটা স্বপ্ন ছিল। তার বুক ধকধক করছে।
তিনি যেনো আসলেই আজ গোপালকে দেখতে পেলেন। সমস্ত শরীর দিয়ে তার ঘাম ঝরছে। বেশকিছুদিন থেকেই তিনি বিভৎস স্বপ্ন দেখছেন। তবে আজকেরটা অতি ভয়ানক। গোপালকে দেখেছেন।
বিছানা থেকে নেমে তিনি বারান্দায় যান। বাইরে একটা ঠান্ডা হাওয়া। হিমেল হাওয়ায় মনটা তার সতেজ হয়ে উঠছে। তার এতো বিশাল বারান্দা থেকে তিনি অন্ধকারে তাকান। যতই সামনে তাকান কিছুই দেখা যায় না; দেখা যায় শুধু অন্ধকার।
অথচ দিনের আলোয় বলতে গেলে গ্রামের দূর-দুরান্ত পর্যন্ত চোখ চলে যায়। এমনই একটি অসাধারণ বারান্দাটার স্বাদ হয়তো তার মেয়েই নিতে পারতো।
কথাটি ভাবতেই তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
কাল সকালে মাষ্টার আসবে তার বাসায়। মাষ্টার হিজড়াদের মসজিদের মতো পবিত্র জায়গায় ঢুকিয়েছে।
বদরপুরে একটা অচেনা কাক ঢুকলেও তিনি তার খবর রাখেন। হিজড়ারা ঢুকেছে এটা তিনি শুনেছেন ঠিকই কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেন নি। এই ঘৃৃণ্য জাতটার মুখোমুখি তিনি হতে চান না। তাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু এখন আর এড়ানো সম্ভব নয়।
তারা তার গ্রামের একটি মসজিদে ঢুকে গেছে। গ্রামের মানুষ সেদিন বাইরে ছিল আর তারা ছিল ভেতরে। এটা হতে পারে না। আর সে জন্য মাষ্টারই একমাত্র দায়ী। তাকে মেরে কেটে কিংবা ক্ষতি করার চিন্তা আপতত তিনি বাদ দিয়েছেন।
কারণ, সামনে ভোট আছে। কোনো ঝামেলাতে আর জড়াতে চান না। তবে তিনি মাষ্টারকে ডেকেছেন। কথা বলে সমস্ত সমস্যার সমাধান করার একটা চেষ্টা তিনি করে দেখবেন। ইদানিং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তো সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ ই্যসু।
যে কোনো ব্যাপারেই তারা এখন আর ঝগড়া ঝাটি করতে চায় না। তারা চায় গোপন বৈঠক মানি সংলাপ। গোপন সমঝোতা। তেমনই একটি সমঝোতায় তিনি মাষ্টারের সাথে বসতে চাচ্ছেন। তাই মাষ্টারকে জরুরী তলব করা হয়েছে।
মাষ্টারকে কিন্তু চেয়ারম্যান একটু ভয়ই পায়। তার ব্যক্তিত্ত্ব তার তেজদীপ্ততাকে তিনি ভয় পান। এই মাষ্টারের মুখোমুখি তিনি বহুবার হয়েছেন। প্রতিবারই তিনি মাষ্টারকে শাসাতে সখ্যম হয়েছিলেন। শুধু একবার সেটা পারেননি আর সেই ঘটনাটা যদ্ধের পর পর।
যাই হোক সেই ভয়ানক অপমানজনক স্মৃতি তিনি মনে করতে চাচ্ছেন না। তবে তার মনে পড়ে, প্রথম তিনি মাষ্টারকে ডেকেছিলেন যুদ্ধের কিছুদিন আগে। মাষ্টার তখন ছেলেপেলেদের আমার সোনার বাংলা গান শিখাতেন, আন্দোলনের কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। এধরনের অভিযোগ যখনই তিনি শুনতে পান তখনই তিনি মাষ্টারকে ডেকে পাঠান।
তিনি তখন এই গ্রামের একজন মাতাব্বর। মাষ্টার তখন বদরপুর স্কুলের সদ্য হেড-মাষ্টার। মাষ্টারকে তিনি প্রশ্ন করলেন, কি মোনায়েম সাহেব, ভালো আছেন?
- জ্বি।
- তো মিয়া দেশের কি অবস্থা? আপনের তো দেশের হালচালের খবর রাখার শখ আছে।
মাষ্টার তখন খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, দেশের অবস্থা ভালো না মাতব্বর সাব।
ঢাকায় আন্দোলন চলতাছে। বঙ্গবন্ধু যে কোনো সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন।
কাশেম তখন একটু ভুরু কুচকে প্রশ্ন করেন, দাড়ান দাড়ান..... বঙ্গবন্ধুটা কে যেনো? শেখ মুজিব?
- জ্বি, শেখ মুজিবুর রহমান।
কাশেমের তখন মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়। মুজিবের কথা শুনলেই তার রক্ত গরম হয়ে যেতো।
তিনি মাষ্টারকে আবারও প্রশ্ন করেন, আপনার ছেলে তো ঢাকাতেই আছে। তাই না?
- জ্বি।
- তো..ছেলের কি অবস্থা?
- আল্লাহর রহমাতে সে ভালো আছে। ঘনঘন চিঠি লিখতাছে।
কাশেম তখন চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে প্রশ্ন করেন, যাই হোক।
যেই কামে আপনারে ডাকছি। আপনারে নিয়া তো গ্রামের মানুষের অনেক অভিযোগ। তাকি আপনে জানেন?
মাষ্টার জানতেন এ ধরনের প্রশ্ন তাকে করা হবে। তিনি তাও বললেন, জ্বি না।
- আপনে নাকি পোলাপানরে কি সব গান শিখান? তাও সে গান বলে হিন্দু মাইনষের লেখা?
- জ্বি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গানটি। এই গান ওদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করবে তাই ওদের শেখাই।
কাশেম হেসে উঠেছিলেন, তাই নাকি? হিন্দু মাইনষের গান গাইলে কি দেশ প্রেম বাড়ে? আর দেশ প্রেম দিয়া কি করবেন? নিজে শেখ মুজিব হইবেন নাকি পোলাপান চার পাচটারে শেখ মুজিব বানাইবেন?
মাষ্টার তখন ক্ষেপে যায়। কড়া সুরে তিনিও কথা বলা শুরু করেন। মানে? দেশপ্রেম না থাকলে ওরা মানুষ হবে কি করে? দেশকে এগিয়ে নিতে হলে, জীবনে কিছু করতে হলে দেশপ্রেম থাকা জরুরী।
জবাবটা পাল্টাপাল্টি আসলো। কাশেমেরও কড়া জবাব। চুপ থাকেন। দেশপ্রেম। কিসের দেশপ্রেম।
দেশপ্রেম বাড়ানোর জন্য পাকিস্তানের গান গাওয়ান। এই দেশ পাকিন্তান। এটা মুসলমানের দেশ। এইহানে যা হবে তা ইসলামী কায়দায় হবে। কোনো হিন্দু ররীন্দ্রনাথের কথায় হবে না।
আর আপনের মুজিবের কথাতেও হবে না।
আপনের নামে আরো অভিযোগ আছে আপনে নাকি পোলাপানরে বলছেন এই দেশের নাম হবে বাংলাদেশ। তারপর আপনে একটা লাল-সবুজ কাপড় উড়াইছেন।
- জ্বি, আপনে ঠিক শুনছেন।
- বাহ।
তো এই বাংলাদেশ নামটাও কি আপনার রবীন্দ্র দিছে নাকি মুজিব সাহেব দিছে।
মাষ্টার তখন তীব্র বেগে জ্বলে উঠেছিলেন। তিনি কখনও কোনো কিছু ভয় পেতেন না এটা কাশেম জানতো কিন্তু চোখের সামনে দেখেন নাই। কাশেমের মতো ক্ষমতাধর একজন মানুষকে তিনি সেইদিন হুংকার দিয়ে বলেছেন, আর একটা কথা বলবেন তো আমি আপনাকে সম্মান করতে ভুলে যাবো। আমাকে কেনো ডেকেছেন সেইটা বলেন।
কাশেম একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা প্রকাশ না করে গম্ভীর ভাবে বলেন, কি করতে হইবো? আপনে কাল থেকা আর স্কুলে আইবেন না। আপনে তো পোলাপানরে হিন্দু বানায়া দিবেন। এহন থেকা বাসায় থাকেন আর বাসায় থাইকা মহান ব্যক্তিগো পূজা দেন।
মাষ্টার সেদিন হনহন করে বেরিয়ে গিয়েছিল তার বাড়ি থেকে।
তিনি আর বদরপুর স্কুলে শিক্ষকতার জন্য আসেননি। কিন্তু তাই বলে গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়ানোটা তিনি ছাড়েন নি।
এই সব পুরনো অতীত আজও কাশেম চেয়ারম্যানের মনে পড়ে যায়। ৭৫ এর পর মাষ্টারের সাথে তার আর মুখোমুখি হওয়া হয়নি। দুজন দুজনের সমস্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবগত থাকতেন কিন্তু কেনো যেনো কেউ কাউকে ধরা দিতেন না।
হঠাৎ তিনি সামনে আবার তাকালেন। ভেবেছিলেন আবার হয়তো ঘুটঘুটে অন্ধকারটি দেখতে পাবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, রাতের অন্ধকারেরা ঘুমিয়ে পড়ছে আর পূর্ব আকাশে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সূর্য।
মাষ্টার এসেছে তার ড্রয়িং রুমে। কাশেম ভেবেছিল মাষ্টার রফিক আর মিঠুকেও সাথে আনবে।
কিন্তু না; মাষ্টার একা এসেছে। মাষ্টার সব সময় তার সাহস দেখাতে পিছপা হননি। আজও তিনি সাহস দেখিয়েছেন। খদ্দরের একটি পান্জাবী আর লুঙ্গি; সেই চিরাচরিত পোষাক পরে তিনি দাড়িয়ে আছেন ফাতেমার ছবিটির সামনে। কাশেম দূর থেকে কিছু দেখছেন।
মাষ্টারের চুল পেকে গেছে, একটু রোগা রোগা ভাবও চলে এসেছে। তাহলে এই মাষ্টার এই রুগ্ন মাষ্টার এতো তেজ কিভাবে দেখালো! এই বৃদ্ধ বয়সে কি করে তার এতো শক্তি আসলো! এসব ভেবে অবাক হয় কাশেম।
রাগে কাশেমের গা জ্বলা শুরু হয়ে গেছে। তরতর করে এবার তিনি ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন।
- কি মাষ্টার সাহেব।
কি অবস্থা?
- জ্বি ভালো।
- বুড়া হয়ে গেছেন দেখি। হাসতে হাসতে কাশেম বলল।
মাষ্টারও একটি মুচকি হাসি দিলেন। তারপর বললেন, সময়...চেয়াম্যান সাহেব সময় যাচ্ছে.....বুড়া তো হবই।
তবে সে অপবাদের হাত থেকে তো আপনিও বাচেন নি।
এরপর দুজন মিলেই হেসে ওঠেন।
মাষ্টার বললেন, আমাকে এখানে ডাকার কারণ কি?
- কারণটা আপনি নিশ্চই জানেন। আপনি কয়েকটি হিজড়াকে মসজিদে ঢুকিয়েছেন।
মাষ্টার দাড়িয়ে থেকেই বলেন, ঢুকিয়েছি মানে! আমরা নামায পড়েছি।
- দেখেন। আপনার সাথে আমার কোনো কথা বাড়ানোর দরকার নাই। আপনে কেনো এই অভিশপ্ত জাতটাকে মসজিদে ঢুকালেন? সেটাও আমার জানার দরকার নাই। আপনে আজকেই এই হিজড়াগুলাকে গ্রাম থেকে বের করবেন। এবং গ্রামের সবার কাছে মাফ চাবেন ঐ ঘটনাটার জন্য।
মাষ্টার শক্ত কন্ঠে বললেন, আমি কোনো অন্যায় করি নাই যে আমি মাফ চাবো।
- আলবাত করেছেন। অতি অন্যায় করেছেন। এই গ্রাম, এই গ্রামের মানুষ এটাকে অন্যায় ভাবছে।
- এটা কোনো অন্যায় না।
আমি যা করেছি তা একটি কুসংস্কারকে হটানোর জন্য করেছি। এবং বলতে পারেন, এটা আমার একটা প্রতিবাদ।
কাশেম এবার হো হো করে ওঠে। প্রতিবাদ! কিসের প্রতিবাদ? আপনে একাই প্রতিবাদ করেন। আর কেউ তো প্রতিবাদ করে না।
রাজাকার রাজাকার বইলা তো বহুত লাফাইছেন এক কালে। সেই লাফানিতে কি কোনো লাভ হইছে? কেউ আপনের রাজাকার প্রতিবাদে শামীল হইছিল? কেনো শুধু শুধূ আমার সাথে আপনে ঝমেলা পাকান তা আমি বুঝি না।
মাষ্টার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, এখন আর সেই দিন নাই কাশেম সাহেব। বাতাস এখন অনেক বদলেছে। আমার সাথে আছে এক ঝাক নতুন প্রজন্ম।
- হা হা হা.....শুনেন মাষ্টার। পোলাপান বয়সে এসব নাস্তিক কর্ম আর প্রতিবাদ সবাই করে। কিন্তু যখন পেটের ভাতের কথা আসে আর যখন বয়স বাড়ে আর মরনের চিন্তা মাথায় ঢুকে তখন প্রতিবাদের ভুত মাথা থেইকা নাইমা যায়। আপনের মাথায় এই ভুত কেন আছে আমি বুঝলাম না। প্রতিবাদ কইরা কোনো লাভ নাই।
মরনের সময় হইয়া যাইতাছে সুতরাং আল্লাহ খোদার নাম নেন।
মাষ্টার এগুলো শুনে আবার যেনো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সেদিনের মতো আবার কোনো এক অজানা বিপ্লবী আত্মা তার উপর ভর করে বসলো।
প্রতিবাদ কোনো লাভের আশায় করি না কাশেম সাহেব। প্রতিবাদ একটি নতুন দিনের স্বপ্ন পূরণের জন্য করি।
- প্রতিবাদ শুধু আপনেই করেন কেনো? আর তো কেউ করে না।
মাষ্টার বললেন, প্রতিবাদ করে না? আপনার বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ হয়েছে কাশেম সাহেব। যেই ছবিটিতে একটি নারীটিকে আপনি বন্দী করে রেখেছেন সেই নারী আপনার একমাত্র কন্যাও আপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। আর আপনি বলছেন কেউ প্রতিবাদ করে নি!!
কাশেম এবার চিৎকার দিয়ে উঠলো। চিৎকারের আওয়াজের ভয়াবহতা বোঝা মুশকিল।
চোখ মুখ লাল করে তিনি বললেন, এই অভিশাপের মধ্যে খবরদার আমার মাইয়ারে ঢুকাইবা না। খবরদার..
- অভিশাপ কিসের অভিশাপ?
একই প্রজন্মের দুটি মানুষ আজ মুখোমুখি। একজন সত্যপথের যাত্রী। আরেকজন শুধু মুখোশ পরে কাটিয়ে দিয়েছেন বহুকাল। একই প্রজন্মের, একজন জাতির গর্ব কিন্তু থাকেন নিভৃতে আর অন্যজন জাতির কলঙ্গ কিন্তু থাকেন মহারাজার মতো।
অঢেল ক্ষমতার অধিকারী আবুল কাশের মুখোমুখি একজন অতিসাধারণ স্কুল মাষ্টার এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতা মোনায়েম মাষ্টার।
অভিশাপ আপনেরা। একসময় পাকিস্তান ভাইঙ্গা চুরমার করছেন, পাকিস্তান নষ্ট করছেন, ইসলাম পালন করা তো দূরের কথা তার ধারে কাছেও কেউ যায় না। এহন আবার, হিজড়া আইনা রঙ্গলিলা শুরু করছেন। এই সব কারণেই এই গ্রামের কোনো উন্নতি নাই।
অভিশাপের জন্য আপনে আজ অসহায়। সব হারাইছেন। ছেলে, চাকরী। গরীবী হালতে থাকেন। কি পাইছেন জীবনে?
মাষ্টার এবার আরো বেগবান হয়, জীবনে আমি যদি অসহায় হই তাহলে আপনি তো আমার চাইতে বড় অসহায় কাশেম সাহেব।
প্রাসাদ সমান বাড়িতে আপনে একা। বিশাল বাড়ি কিন্তু আপনার কান্নার আওয়াজ শোনার কেউ নাই। আপনার ঘর হাহাকার করে। আমি ছেলে হারিয়েছি। কিন্তু আমি আমার ছেলেকে নিয়ে গর্ব করি।
কিন্তু আপনার মেয়ের কথা আপনি কারোও সাথে বলতে পারেন না। আপনি আপনার মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন কিন্তু তারপরও অন্যের সামনে সেই মেয়ের কথা নিজ থেকেই উঠাতে চান না। আমি তো দেখছি আপনি আমার চাইতেও বড় অসহায়। নিজেকে বাচানো জন্য নেতার মুখোশ পড়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। আপনি এতো ধনী, আপনার এতো সম্পদ কিন্তু ভোগ করবার কেউ নেই।
তাই আমি তো দেখছি আপনি আমার চাইতেও বড় অসহায়। আর অভিশাপ? কিসের অভিশাপ। শুনেন চেয়ারম্যান আবুল কাশেম, পাকিস্তান যেই রক্তের বন্যা এদেশে ঘটিয়েছিল সেই রক্তের বন্যা এখন তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে ঘটায়। খবর রাখেন না? একটার পর একটা বোমা হামলায় আজ আপনার পাকিস্তান রণক্ষেত্র। আর অভিশাপের উদাহরণ দেখবেন? যেই মানুষটির জন্য এই বাংলার মাটি রক্তাক্ত হয়েছিল সেই জুলফিকার আলী ভুট্টো পরিবার এখন অভিশপ্ত।
তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যু পায় নি। এমনকি তার তেজদীপ্ত কন্যা বেনজীর ভুট্টোও পিতার অন্যায়ের শাস্তিটা গুলি হয়ে তার মাথায় ঢুকেছে। আমি তো দেখি আপনার পাকিস্তান অভিশপ্ত। হ্যা কাশেম সাহেব। এ প্রকৃতি আপনাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।
আর তাই অভিশাপ শুধু আপনাদের ঘিরেই রয়েছে। আপনাদের মতো মানুষগুলোকে রাষ্ট্র প্রাধান্য দেয় বলে আজ এ দেশও অভিশপ্ত। আমরা এক অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয়েছি। আপনি নিজেও অভিশপ্ত কাশেম সাহেব। আপনার কন্যার উলঙ্গ লাশ আপনাকে দেখতে হয়েছে।
আপনি একটি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু সাথে সাথে সেই স্ত্রী মরে গেছে। আমি তো দেখছি সমস্ত কিছু আপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। এমনকি স্বয়ং স্রষ্টাও আপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান আপনি গ্রহণ করেন নি কেনো? মনে পড়ে কাশেম সাহেব? হ্যাঁ আপনার সেই সন্তান এখন এই গ্রামে এসেছে। যাদের আপনে অভিশপ্ত জাত বলেছেন।
সেই জাতের একজন আপনার সেই সন্তান যাকে আপনি গ্রহণ করেন নাই। আপনার পাপের শাস্তি আপনার সন্তান বহন করে বেড়াচ্ছে। বুঝলেন কাশেম সাহেব। আমি দেখতে পাচ্ছি এক ক্ষমতাধর অসহায় চেয়ারম্যান, এক অভিশপ্ত চেয়ারম্যান। যার জীবনের ষোল আনাই বৃথা।
একটানে মাষ্টার শুধু বলেই যাচ্ছে। কাশেমের বলার কিছুই নেই। সে নিশ্চুপ হয়ে শুধু শুনেই যাচ্ছে। কিন্তু যখনই তার সেই সন্তানের কথা আসলো তখন তার সমস্ত শরীর যেনো অবশ হয়ে আসছিল। মাষ্টারের প্রতিটি কথা তার বুকের মধ্য খান দিয়ে গুলির মতো যাচ্ছে।
তার চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। কোনো আওয়াজ আর তার কানে আসছে না। তিনি শুধু দেখছেন মাষ্টার তার রুম থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছে। এরপর তিনি লুটে পড়লেন মারবেল পাথরের মেঝেতে।
অজ্ঞান কাশেমকে তার প্রশস্ত বেডরুমে শোয়ানো হয়েছে।
প্রেসার হাই।
ধর ধর কুত্তাটারে ধর। সেই বৃদ্ধ! আবার সেই একদল উলঙ্গ নারী। তার পিছন ছুটছে। তিনি প্রাণ দিয়ে দৌড়াচ্ছেন।
হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ সামনে গোপাল। গুরু, ও গুরু, আপনে কেমনে আমার লগে এই কাজটা করলেন। না হয় করলেন আমার বউডা কি দোষ কুরছিল।
তারপর গোপাল তার পরা সাদা কাপড় খুলে ফেলে।
রক্ত। তার কাটা লিঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝরছে। গোপাল এক লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় কাশেমকে। কাশেম আবারও উঠে দাড়ায়। তার পিছনে আবারও এক ঝাক উলঙ্গ নারী।
তিনি প্রাণ পন দৌড়াচ্ছে। আর সেই বৃদ্ধের চিৎকার করা হাসির শব্দ। হা হা হা হা হা.......কি ভয়ংকর সে হাসি। কাশেম আর পেছনে চায় না। সামনে হঠাৎ এক নারী এসে দাড়ায়।
আরে আরে, এতো ফাতেমা। উলঙ্গ ফাতেমা। হে আল্লাহ... আল্লাহ..., আর্ত চিৎকারে তিনি গলা ফাটান। সেই বৃদ্ধের হাসির বন্ধ নেই। অবিরাম সে হেসেই চলেছে।
হঠাৎ চারিপাশ নিস্তব্ধ। কেউ নেই। কাশেমের পেছনে কেউ নেই। উলঙ্গ নারীরাও নেই। গোপালও নেই।
সেই বৃদ্ধের হাসির শব্দও নেই। তিনি তখন দেখতে পান। সেই বৃদ্ধটিকে সাদা পায়জামা-পান্জাবী পরা। একটু রক্তের ছিটা সেখানে। মুখ সাদা কাপড়ে মোড়ানো।
- ঐ কুত্তা। মরস না কেন তুই? যাহ মর... দাও নে দাও.....তারপর নিজেরে নিজে কোপ মার। হালা কুত্তা।
কে এই বৃদ্ধ? তার পেছনে কেনো লেগেছে?
- কে আপনি?
বৃদ্ধের আবার উচ্চস্বরে হাসি। দেখবি? দেখবি আমারে? বলেই বৃদ্ধ তার মুখে জড়ানো সাদা কাপড় খুলে ফেলে।
এতো এতো তার পিতা আবুল আহাদ।
- আব্বা।
- চুপ হারামজাদা। কে তোর আব্বা। চোপ।
মর কুত্তা। তোর মতো কুত্তার বাপ আমি না।
কাশেম ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠেন। তার ঘরে কেউ নাই। অসহায় কাশেম উঠে দাড়ায়।
সারা শরীর তার বিধ্বস্ত। শক্তি নেই। কানে শুধু বাজছে সেই একটি বাক্য, দাও নে দাও। নিজেরে নিজে কোপ মার।
আয়নার সামনে দাড়ায় কাশেম।
এক অসহায় ক্ষমতাধর বৃদ্ধ আয়নার সামনে। আয়নার ওপারে ফাতেমাকে দেখা যাচ্ছে।
- আব্বাজি...ও আব্বাজি.....দাও নেন...দাও.........মুক্তি লন। মুক্তি। অভিশাপ থেকে মুক্তি।
কাশেমের হাতে একটি দা। ফাতেমা তখনও বলছে, আব্বাজী। দেন.. কুপ দেন। মুক্তি লন। অভিশাপ আপনেরে খাইবো।
মুক্তি পাবেন। দাও নেন। দাও......
১ম - ৫ম পর্ব: Click This Link
৬ষ্ঠ পর্ব: Click This Link
৭ম পর্ব: Click This Link
৮ম পর্ব: Click This Link
৯ম পর্ব: Click This Link
১০ম পর্ব: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।