কিছুক্ষণ আগে আমার প্রথম পাতা দেখা যাচ্ছিল না দেখে দুটো পোষ্ট দিয়েছিলাম। পোষ্ট দুটোই মুছে দিয়েছি; কারণ আমার সমস্যার সমাধান হয়েছে। প্রথমপাতা আমি এখন দেখতে পাচ্ছি। আপনারা যারা আমাকে বিভিন্নভাবে সাজেশান দিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
৬.
মোনায়েম মাষ্টারের ঘর এখন ভরপুর।
যেই একাকিত্ব জীবন তিনি পার করেছেন; বলতে গেলে তা এখন অনেকটা দূর হয়েছে। তার ঘরে এখন মাধুরীরা তো আছেই সাথে আছে রফিক ও মিঠু। মিঠু সেইদিন থেকে মাষ্টারের বাসাতেই। রফিক আর মিঠুর সাথে মাধুরীদের ভালোই খাতির জমেছে। তারা সারারাত বসে বসে আড্ডা দেয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে।
প্রধান বিষয় থাকে যুদ্ধের গল্প। মাষ্টার তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আর বাকি সবাই হা করে তাকিয়ে শুনে। বিশেষ করে মাধুরী, কারিনা আর কারিশমা এই গল্পগুলো শুনে খুব মজা পায়। তারা অবাক হয়ে শুনে।
যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা শুনে অনেক সময় তারা চোখের পানিও ফেলে। যেমন, যেদিন মিঠু তার ফুপুর কথা বলেছিল সেদিন তাদের কারও ঘুম হয় নি। মাধুরী সারারাত বালিশে মুখ গুজে কেঁদেছে। আর বলেছে, মানুষ এরুম জানোয়ার কেমনে হয়!
শুধু যে যুদ্ধের কথা হয় তা কিন্তু নয়। মাধুরীরা তাদের জীবন নিয়েও কথা বলে।
তারা কি করে পরিবার থেকে আলাদা হয়েছে। সমাজে তাদের নিয়ে কি করে খেলা হয়। তাদের দুঃখ-কষ্ট হাহাকার সব কিছুই তারা বলে। মাধুরী তার কথাও বলেছে। আমার জন্মের সময় নাকি সবাই বুইঝা ফালাইছিল আমি না পুরুষ; না মেয়ে।
তাই আমারে আমার বাপ গ্রহণ করে নাই। পরে তিনি আমারে এক মহিলার কাছে দিয়া দেন। সেই মহিলা আমারে এক স্কুল মাষ্টারের কাছে দিয়া দেয় আমারে বড় করতে। আমি ওনার কাছেই বড় হইছি। তিনি মানুষটা খুব ভালো আছিল।
কিন্তু সেই ভালো মানুষটা আমারে নিয়া পড়লো বিপদে। কোথাও শান্তি পান না আমারে নিয়া। আমারে যতদিন নিজের কাছে রাখছে অনেক আদর কইরা রাখছে। উনি বিয়া করে নাই। তাই আমারে পালতো।
বেচারা মানুষের জালায় আমার যহন ২০ বছর তহন আমারে কইলো, তুই আর আমার লগে থাকিস না রে, তুইও বাচবি আমিও বাচমু। আর মানুষের কথা শুনতে ভালো লাগে না।
অনেক কষ্ট পাইছিলাম সেদিন। রাগও হইছে। ওনারে আমি মামু কইয়া ডাকতাম।
মনের দুঃখে আমি ঘর ছাইড়া বাইর হইয়া যাই। কি আর করুম। আমাগো জায়গা তো হিজড়া পল্লী ছাড়া আর কোথাও নাই। তাই ঐহানেই নাম লেখাইলাম। কিন্তু কয়দিন আগে আমি হঠাৎ শুনলাম আমার মামু নাকি অসুস্থ।
এইডা শুইনা আর নিজেরে দূরে সরাইয়া রাখতে পারি নাই। আমারে উনি নিজ হাতে পাইলা পুইশা বড় করছে। দৌড়াইয়া চইলা আসলাম মামুর কাছে। যাইয়া দেহি মামুর জান যায় যায়। আমারে দেইখা উনি ভেউ ভেউ কইরা বাচ্চা পলাপানের মতো কাইন্দা দিলো।
আমারে জড়াইয়া ধইরা কইলো, দুলাল রে তুই আইছস। ও, আমার নাম উনি দিছিল দুলাল। কিন্তু হিজড়া পল্লীতে নাম যহন লেখাইছি তহন আমার গুরু আমার নাম দিলো মাধুরী। যাউগ্গা, আমারে হেইদিনই উনি আমার আসল মা-বাপের পরিচয় দিছে। উনি সব জানতো কিন্তু কয় নাই।
বলা নাকি নিষেধ আছিল। পরে আমি জিগাইলাম, মামু আপনে আমারে এতো বছর পাললেন তয় কেন মানুষের কথা ধইরা আমারে বাইর কইরা দিলেন। তহন মামু কইলো, বাবারে, তোরে মনে কষ্ট দিতে চাই নাই। এখন মরন আইয়া পরছে তাই কইয়া যাই। এইহানকার মানুষ খুব খারাপ রে বাবা।
ওরা বলাবলি শুরু করছিল, আমি বিয়া করি নাই কারণ আমি তোর সাথে রাইত কাটাই। এই কথা শুইনা আমি থাকতে পারি নাই। আমি বিয়া করি নাই। সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা কেমন হয় আমি জানি না। কিন্তু আমি তোরে আমার সন্তানের মতই দেখছি।
এইরকম নোংরা কথা শুনলে কি আর থাকা যায়।
আমিতো এগুলা বুঝি। আমিও কি কম অত্যাচার সহ্য করছি! মাইনষে আমারে দেখলে কেমনে যানি তাকায়, আড়ালে হাসাহাসি করে। এবস তো আমিও বুঝতাম; আমারও খারাপ লাগতো। কিন্তু আমার মামু আমারে কত্ত আদর করতো।
আমি তো বুঝি। বেচারা কেন যে একটা হিজড়ারে নিয়া পালল তা আমি বুঝলাম না।
এই ভাবেই তারা তাদের গল্প বলা শুরু করলে আর থামতো না। তাদের দুঃখগুলো তারা একে অপরকে বলতো। একে অপরকে সান্তনা দিতো।
একদিন মাষ্টার তাদের প্রশ্ন করলো, তোমরা এই গ্রামে কেন আইছো।
মাধুরী তখন একটু চুপ থেকে বলে। আইছি একটা কামে।
একদিন ঠিকই মাধুরী তার গোপন খবরটা ফাঁস করে। তবে তা শুধু মাষ্টারের কাছে।
তাদের এই বদরপুর গ্রামে ঢোকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাধুরী সব কিছু খুলে বলে মাষ্টারকে।
মাষ্টার যে শুধু তাদের সাথে গল্প করতো তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের কথাও বলতো। শিক্ষার কথা বলতো। একদিনতো তিনি সবাইকে নিয়ে পড়তেই বসে গেলেন।
ধর্ম নিয়েও তাদের সাথে আলোচনা হতো। একদিন কারিশমা বলল, হায়রে, ধর্ম কি আর আমাগো লাইগা!!!! ধর্ম হইলো পোলা আর মাইয়া মানুষগো লাইগা। আমাগো মতো হিজরা গোরে কি আর ধর্ম পালন করতে দেয়। আমরা মাইন্সের পুকুরে নামলেই বলে পানি নাপাক হইয়া যায়। আর ঐহানে কন ধর্ম! হেহ.. পরে কইবো ধর্মও আমরা নাপাক বানায়া দিছি।
তারপর তিনজনই হো হো করে হেসে ওঠে।
মাষ্টার শুধু বলে, ধর্ম সবার জন্য। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী আল্লাহর ইবাদত করে। কেউ ওনার কাছে ছোট না। সবাই বড়।
সবারই ওনার কাছে নত হতে হবে। কোনো বিভাজন উনি করেন নাই।
কারিনা তখন একটু ক্ষেপে যায়। সে বলে, হ.. বিভাজন নাই। আপনেও কইলেন একটা কথা স্যার।
তাইলে আমরা হিজড়া কেন? আমাগোরে কেন উনি এমনে কইরা দুনিয়াতে পাডাইছেন? আমগোরে কেন মানুষ কইবো আমরা অভিশাপ?
- এগুলো কুসংস্কার। সমাজের কুসংস্কার। সবকিছুর একটা বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা আছে। তোমরা যদিও বুঝবা না তাও বলি, একটা শিশুর তার মায়ের গর্ভে পূর্ণতা পেতে সময় লাগে ২৮০ দিন। এক্স এক্স ডিম্বাণু বর্ধিত হয়ে জম্ম দেয় নারী শিশুর।
আর এক্স ওয়াই ডিম্বাণু জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। কিন্তু কখনও কখনও এসব ভ্র“ণের বিকাশকালে এদের সমতায় বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন, এক্স ওয়াই ওয়াই অথবা এক্স এক্স ওয়াই। এই অস্বাভাবিক পেটার্নের কারণে অনেক অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। এবং এক্স বা ওয়াই ক্রমোজন বেশী থাকার কারণে আচরণের এর একটা প্রভাব পড়ে।
ঠিক তখনই তা হয়ে যায় তৃতীয় লিঙ্গ মানে হচ্ছে হিজড়া।
করিনা হাসতে হাসতে বলে, কি কইলেন কিছুই তো বুঝতে পারলাম না..
- বুঝবা না তাতো জানি তাও বললাম আর কি। তোমাদের বোঝানোর জন্য যে, এগুলো কোনো অভিশাপ না। মানুষের দেহের ভিতরের সিস্টেমের গন্ডগোল।
মাধুরী বলে, তাইলে আমার প্রশ্ন হইলো, এই গন্ডগোলটা করে কে...
প্রশ্ন শুনে মাষ্টার একটু চুপ হয়ে থাকেন কিছুই বলেন না।
তবে তিনি বলেন, যেটাই হোক। মানুষ এখনও অনেক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
মিঠু হঠাৎ বলে ওঠে, স্যার, কাইলকা তো শুক্রবার। চলেন কাইলকা জুম্মার নামাযে আমরা ওগোরে লইয়া যাই।
- খুব ভালো বলেছিস মিঠু।
আমরা শুধু বড় বড় কথা বললে হবে না। কোনো কাজ করতে হলে আগে নিজেদের শুরু করতে হবে।
শুক্রবারটা ঢাকা শহরের মানুষের জন্য ছুটির দিন হতে পারে। ঢাকার ব্যস্ত মানুষগুলো একটা দিন ছুটি পেয়ে পড়ে পড়ে শুধু ঘুমায়। আবার অনেকে পারিবারকে সময় দেয়ার জন্য ঘরের কাজ করে।
কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোর কাছে শুক্রবার মানে অতিগুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। সকাল থেকে একটা গুরুগম্ভির ভাব সকলের মাঝে থাকে। বলাই বাহুল্য তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই। বদরপুরও তো একটি গ্রামই। তো সেখানকার মানুষগুলোরও একই অবস্থা।
সকাল থেকে বদরপুর মসজিদের ঘষামাজা চলছে। ইমাম সাহেব কাজ তদারকি করতে মহা ব্যস্ত। পুরিষ্কার পরিচ্ছিন্নতা ঈমানের অঙ্গ। সেটা অন্য কোনো দিন না হোক অন্তত বাদ জুমার দিনতো সকলকে বোঝাতে হবে। না হলে তো সকলে বলবে, ইমাম সাহেব কোনো কাজের না।
মসজিদটাও পরিষ্কার রাখে না।
তাই ইমাম প্রতি শুক্রবার মসজিদের আনাচে কানাচে চকচকে করে তুলেন। আর তাকে একাজে সহযোগিতা করেন গ্রামের হাফেজ নুরুল। সেদিন মাধুরীরা নুরুলকে উলঙ্গ করে পুকুরে ফেলে এসেছিল; এতে সে কিঞ্চিত লজ্জিত। সেদিন সে জামা কাপড় ছাড়াই পুকুর থেকে উঠে নিজের ঘরে যায়।
যাওয়ার সময় এক পিচ্চি ছোকরা দেখে ফেলে আর সারা গ্রামে এই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ে। পোলাপানের কাছে এই বিষয়টি একটি চটকদার বিষয়। গ্রামের দুষ্ট ছেলেদের গাল গপ্পের তো শেষ নেই। যে ঘটনা হয়তো তারা দেখে নি শুধু শুনেছে মাত্র সেটা এমনভাবে রসালো করে বলবে যেন মনে হবে সে নিজে সামনে থেকেই দেখেছে। যেমন, এক ছেলে একদিন চা দোকানে বলছিল, আরে নুরুইল্লারে হিজড়া মাগীডি লেংডা কইরা ছাইড়া দিছে।
লেংডা করার পর ওরে রুদ্রে খার করাইয়া কান ধইরা উঠ বস করাইছিল। তারপর গোয়ায় এক লাথি মাইরা পানিত ফালাইয়া দিছে।
একজন হয়তো পাশে থেকে প্রশ্ন করলো। আরে মিয়া, তুমি এতো কিছু জানলা কেমতে?
- হুনো কি কয়। আমি তো ঐহানে গাছের চিপা থেইকা সব দেখছি।
- হাই হাই। তাইলে তুমি নুরুলের সব ই দেইখা ফালাইছো।
- দেখতে কি বাদ রাখতে। হালার পুতের ই টা ছুডো। হা হা হা
এভাবেই একটা কাহিনীকে তারা মজাদার করে তোলে নিজের মতো করে।
তারা যা ভাবতে চায়, যা ভেবে তারা আনন্দ পেতে চায় প্রতিটি মুহূর্তকে তারা ও ভাবেই তাদের বর্ণনায় নিয়ে আসে।
মসজিদের পরিষ্কারের কাজ সব শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মুসুল্লিরা আসা শুরু করবে।
চলবে.......
১ম - ৫ম পর্ব: Click This Link
৬ষ্ঠ পর্ব: Click This Link
৭ম পর্ব: Click This Link
৮ম পর্ব: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।