জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার পথকলি ট্রাষ্ট আবার পুনরুজ্জীবিত করতে হবে --হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
ঢাকা শহরে বের হলে প্রায়ই জানজটে আটকা পড়তে হয়। সেদিন মহাখালীতে গাড়ির ভীড়ের মধ্যে বসে দেখলাম ফুটপাত দিয়ে আট/দশ বছরের একটা ছেলে কাঁধে বড় একটা বস্তা ঝুলিয়ে কাগজ কুড়িয়ে যাচ্ছে। গাড়ির মধ্যে আমাকে বসা দেখে ছুটে এসে সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলাম- কী নাম তোর? উত্তরে বললো, আমার নাম- কালাম। ছেলেটার কাছে প্রশ্ন করে জানলাম, সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে সে বিশ-ত্রিশ কিংবা চল্লিশ টাকার হতো উপার্জন করে।
তাই দিয়েই ওকে চলতে হয়। ওর মা আর এক বোন আছে। তারা বাসা-বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম- লেখাপড়া কিছু জানে কি- না।
বললো- কিছুই জানেনা। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে টাকা পয়সা গুনিশ কীভাবে? বললো- এমনি এমনি শিখেছি। তারপর আর কালামের সাথে কথা বিনিময় হয়নি। গাড়ির জট কেটে গেছে। আমার গাড়ি দ্রুত চলতে শুরু করলো।
ছেলেটার সাথে আরো কথা বলতে ইচ্ছা ছিলো। ওর কথাগুলো আমার মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো বারে বারে তীরে এসে আছড়ে পড়ছিলো। স্মৃতির পাতাটা খুলে গেলো। এ ধরনের কালামদের নিয়ে আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো।
আবার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো- এই সব কালামদের শেষ গন্তব্য কোথায়? ওকি সারা জীবন কাগজ কুড়িয়ে বিশ- ত্রিশ- চল্লিশ টাকা আয় করে জীবন কাটিয়ে দেবে? নিশ্চয় না।
ওর জীবনেও যৌবন আসবে। কৈশোরে দুরন্তপনা থাকবে। সে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাবেনা। তার মধ্যেও স্বাদ আশার জন্ম নেবে। সে এই শহরে কাউকে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতে দেখবে, কেউ গাড়ি চড়ে বেড়াবে, কেউ ভালো ভালো খাবার খাবে, কেউ দামি- দামি পোশাক পড়বে; আর কালামরা নিজের গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখবে সে ছিন্ন মলিন বসন পড়ে আছে, তার পেটে ক্ষুধা নিত্য সঙ্গী হয়ে রয়ে যাচ্ছে- এটা চলতে পারেনা।
একদিন হয়তো সুযোগ বুঝে কোনো মহিলার হাতের ব্যাগটা টান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। তারপর সেখানে যে টাকা পয়সা পাবে, তাই দিয়ে ভালো খাবার কিনে খাবে। ভালো একটা জামা কিনে পড়বে। এভাবে একবার দু’বার করে নিজে সামলে যেতে পারলে ক্রমে তার সাহস বেড়ে যাবে। তারপর বাড়তে থাকবে তার মধ্যে অপরাধ প্রবনতা।
একটা ছিচ্কে ছিনতাইকারী থেকে হয়তো হয়ে যাবে একটা বড় সন্ত্রাসী। এর বিপরিতে এই সব কাগজ কুড়ানো কালামদের ভালো হওয়া কিংবা সুস্থ্য স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন-যাপনের ভবিষ্যৎ আছে কি?
এ রকম চলার পথেই একবার এক শিশুকে তার মায়ের পাশে বসে পাথর ভাঙ্গতে দেখে আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। সেই ব্যাকুলতা সৃষ্টি করেছিলো এক মহৎ কর্মের সোপান। তখন শিশুটির কাছে গিয়ে দেখলাম- হাতুরিটা জাগাতে তার কষ্ট হয়। বুকের পাজরগুলোও নড়ে চড়ে যাচ্ছে।
তবুও তার পাথর ভাঙ্গতে হচ্ছে। হাত দু'টো ধরে দেখলাম- নরম হাতের পাতায় ফোস্কা পড়েছে। এই দৃশ্য দেখে মনটা হু-হু করে কেঁদে উঠলো। সেই কান্না ভেজা অনুভুতি থেকে আমার মধ্যে একটি ধারনার জন্ম হয়েছিলো। ওরা পথকলি।
ওদের ফুটতে দিতে হবে।
সে সময় আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম- এই সব শিশুদের আমি একটি অর্থপূর্ণ জীবন ফিরিয়ে দেবো। তখন এই ধরনের শিশুদের একজন কার্টুনিষ্ট নাম দিয়েছিলেন টোকাই। সাধারণ মানুষও তাদের এই নামেই ডাকতো। এই অবহেলিত শিশুদের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য এবং ওদের প্রতি সহানুভুতি জাগ্রত করার লক্ষ্যে আমার হৃদয়ের আবেগ অনুভুতি উজাড় করে দিয়ে একটা গান লিখেছিলাম।
সেই গানের কথাগুলো এখানে স্মরণ করতে চাই!
“পথের ধারে অবহেলায়
যাদের কাটে সকল সময়
চলার পথে কুড়িয়ে নিয়ে
ঘুচাই তাদের মনের ভয়।
পাথর তারা ভাঙ্গে মাঠে
ঘুরে বেড়ায় পথে ঘাটে
দুঃখ যাদের জীবনময়
জীবন যাদের কাটে অভিশাপে
নাম দিয়েছি পথের কলি
আসুক তারা আলোর পথে
পিছনে ফেলে অন্ধগলি। ”
আমি দেখেছিলাম- এ রকম শিশুরা কারখানায়- গ্যারেজে, বাসা-বাড়িতে কঠোর পরিশ্রম করে- মানবেতরভাবে জীবন-যাপন করে। কোথাও পেটে-ভাতে, কোথাও বা নাম মাত্র বেতনে। অথচ তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে।
কেউ বা রাস্তায় ভিক্ষা করে। ওদের দেখে, ওদের কথা জেনে আমার হৃদয়টা যে কতটা বিগলিত হয়েছিলো- তার পরিমাপ কখনোই করতে পারবো না।
তখন আমি দেশের রাষ্ট্রপতি। মানুষের জন্য ভালো কাজ করার সুযোগ তখন আমার হাতে ছিলো। তাই আমি সে সময় পথের ধারের অবহেলিত এই শিশুদের কল্যাণের লক্ষ্যে আমার মনপ্রাণ উজার করে একটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
সেই উদ্যোগের ফসল ছিলো পথকলি ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা। যে কলিগুলো পথের ধারে পরেছিলো- তাদের তুলে এনে সযত্নে লালন-পালন এবং তাদের মানুষের মতো মানুষ রূপে প্রস্ফুটিত করার প্রয়াস আমি হাতে নিয়েছিলাম। আমার সে প্রচেষ্টা সফলও হয়েছিলো। আমি সেদিন শিল্পীকে উদেশ্য করে বলেছিলাম, দয়া করে অবহেলিত শিশুদের আর টোকাই বলবেন না। ওরা পথের পাশে পরে থাকা ফুলের কলি।
ওদের ফুটিয়ে তোলার জন্য আমি দায়িত্ব নিয়েছি। ওরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর- এদেশের ভবিষ্যৎ মূল্যবান নাগরিক। ওরা এখন থেকে পথকলি নামেই পরিচিত হোক।
আমি জানতাম আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শিশু-শ্রম নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো একেবারে বিরত করা সম্ভব নয়।
গ্রামপ্রধান আমাদের এই দেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের সাথে জড়িত। অনেক কৃষকের সন্তান লেখা পড়া করলেও কৃষিকাজে তারা তাদের বাবাকে সাহায্য করে। মাঠে তাদের বাবার সাথে কাজ করতে হয়। এটা নিবৃত করানো সম্ভব নয়। পান্তরে শহরাঞ্চলে এমন অনেক শিশু আছে যারা একেবারেই অসহায়।
তারা অন্ততঃ কোথাও কোনো কাজ করে দু'বেলা দু’মুঠো খাবার সংস্থান করতে পারে। এই সুযোগ না থাকলে তাদের ভিক্ষা করতে হয়। আমি এই বাস্তবতা উপলদ্ধী করে শিশু-শ্রম একেবারে নিষিদ্ধ না করে শিশুদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের কাজটি না করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেই সাথে শিশুরা যাতে কাজের ফাঁকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে লেখাপড়া শিখতে পারে তারই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পথকলি ট্রাষ্ট গঠন করেছিলাম।
আমার প্রতিষ্ঠিত পথকলি ট্রাষ্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো- ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই তারিখে।
ট্রাষ্টের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বেগম রওশন এরশাদ এবং প্রথম সচিব নিযুক্ত হয়েছিলেন লেঃ কর্ণেল (অবঃ) মোহাম্মদ হোসাইন। এই ট্রাষ্টের পরিচালনার দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিলো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের উপর। হৃদয়বান ব্যাক্তি ও বিভিন্ন সংস্থার দেয়া চাঁদার অর্থে পথকলি ট্রাষ্টের ব্যয়ভার চালানো হতো। তখন ট্রাষ্ট চালানোর জন্য যে অর্থ আমি সংগ্রহ করতাম তা হোটেল শেরাটনের সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় পথকলি ট্রাষ্টের নামে জমা থাকতো। আমার সময়ে মোট পাঁচ কোটি টাকা ফিক্স ডিপোজিট করা হয়েছিলো।
শুনেছি সেই টাকা এখনো ব্যাংকে জমা আছে এবং সুদে-মুলে তার পরিমাণ হয়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা।
এই ট্রাষ্টের কার্যক্রম হিসেবে পথকলিদের জন্য শিক্ষা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমি যেটুকু সময় পেয়েছিলাম- সেই সময়ের মধ্যে মোট ৭১টি পথকলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা পথকলিদের লেখাপড়া শিখাতেন। আমি কারখানা মালিকদের- যাদের কারখানায় শিশু শ্রমিক কাজ করতো- তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম যে, আপনারা শিশু শ্রমিকদের দিয়ে যে ক’ঘন্টা কাজ করান সেই সময়ের মধ্য থেকে ২ ঘন্টা সময় ছেড়ে দিতে হবে এবং যে টাকা বেতন দেন তার সাথে আর ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেবেন।
বাড়তি ৫০ টাকা ওদের নামে ব্যাংকে জমা করা হবে এবং যে ২ ঘন্টা সময় দেয়া হবে সেই সময় ওরা স্কুলে লেখাপড়া শিখবে। আমার হিসাব ছিলো, পথকলি শিশুরা পাঁচ বছর লেখা পড়া করলে- ওদের প্রত্যেকের নামে ব্যাংকে তিন হাজার টাকা জমা হবে। তার সাথে কিছু সুদও জমা হবে। পথকলি স্কুলের পড়া শেষ করে চলে যাবার সময় এই টাকা ওদের এক সাথে দিয়ে দেয়া হবে। এই টাকা দিয়ে হয়তো তারা আরো কিছু উপায়ের ব্যবস্থা করতে পারবে।
আমি সেসব মালিকদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তারা আমার আহ্বানে সর্বান্তকরনে সাড়া দিয়েছেন। আমি জানি, আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত হৃদয়বান। যে কোনো মানবিক আবেদনে তারা সাড়া না দিয়ে পারে না। আমার পথকলি ট্রাষ্টের উদ্যোগ সফল হয়েছিলো- দেশের হৃদয়বান মানুষের একান্ত সাহায্য সহযোগিতা ও নৈতিক সমর্থনের কারণে। আমি উপলদ্ধী করেছিলাম পথকলি শিশুরা সব সময় ঠিক মতো খেতে পায়না।
পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ লেখাপড়া শিখতে আসবে না। তাই পথকলি স্কুলে যারা খেলা পড়া শিখতে আসবে তাদের একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সে কারণে এই স্কুলে উপস্থিতি থাকতো শতভাগ। শিশুরা কাজে যাবার আগে সকাল বেলা পথকলি স্কুলে আসতো। এখানে দুই ঘন্টা লেখা পড়া শিখতো এবং যাবার সময় সকালের খাবার খেয়ে কাজে যেতো।
সে সময় একজন পথকলি ছাত্রের সকালের এক বেলা খাবারের জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ করেছিলাম। কাজ করা শিশুরা বয়সে একটু বড় থাকায় তাদের বুদ্ধিও বেশি থাকতো। ফলে লেখাপড়া সহজে শিখে যেতো। আমি দেখেছি পথকলি স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব দ্রুত লেখা পড়া শিখে যাচ্ছে।
আমি যদি সময় পেতাম তাহলে সারা দেশেই এবং প্রত্যেক শহরেই এ ধরনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথকলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দিতাম।
আমাদের দেশে যাদের অক্ষর জ্ঞানটুকুও নেই- তারা নিরক্ষর শুধু আর্থিক কারণেই। আমি যদি পথকলি ট্রাষ্টের মাধ্যমে পথকলিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম- তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশ এতদিনে নিরক্ষরতা মুক্ত হতোই। শুধু নিরক্ষরতা মুক্তই নয়- যে শিশুদের জীবনের সামনে ছিলো শুধু ঘোর অমানিষা- আমি তাদের আলোর সন্ধান দিয়েছিলাম। অবহেলিত শিশুরা যদি শ্রমের পাশাপাশি লেখা পড়া শিখতে পারে- তাহলে তারাই হতে পারে দক্ষ শ্রম-শক্তি। অবহেলিত শিশুরা টোকাই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে তারপর অপরাধের জগতে না মিশে নিজেদের দেশের মূল্যবান এবং অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আশ্রয়স্থল পেয়েছিলো পথকলি ট্রাষ্টে।
সে সময়ে এবং এখনো আমার মনে হয়- জীবনে যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকি কিংবা যদি কোনো ভালো পরিকল্পনা করে থাকি- তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে আমার এই পথকলি ট্রাষ্টের ধারনা এবং তার বাস্তবায়ন।
তারপর আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম। আর পথকলি ট্রাষ্টও বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ক্ষমতা ছাড়ার পর যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন তারা আমার উপর রাগ ঝাড়তে গিয়ে আমার যুগান্তকারী কর্মকান্ডগুলোকেও ধ্বংস করে দিলেন। তা না হলে পথকলি ট্রাষ্ট নিখোঁজ হয়ে যাবে কেনো? কি দোষ করেছে এদেশের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অবহেলিত শিশুরা! ওদের কি মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার নেই? ওদের কি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খাদ্যের অধিকার নেই? আমি তো সেই অধিকার দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম।
আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর ৭১টা পথকলি স্কুলের একে একে সবগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। হাজার হাজার অসহায় শিশু শিক্ষা এবং একবেলা খাবার থেকে বঞ্চিত হলো। আবার সেই শিশুরা সারা দিনমান কারখানায় কঠোর পরিশ্রমের সাথে জড়িয়ে পড়লো। কেউ রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়ানো শুরু করলো। কেউবা একটা রুটি কিনে খাবার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে শুরু করলো।
আমি কারামুক্ত হবার পরও পথকলি ট্রাষ্টের খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে পথকলি শব্দটি মুছে গেছে। শুনেছি বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ট্রাষ্ট বিলুপ্ত না করলেও এর নাম বদলে দেয়। যেহেতু এই ট্রাষ্টের নামে ব্যাংকে অর্থ জমা ছিলো- তাই ট্রাষ্টটি বহাল রাখলেও এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এই ট্রাষ্টের মাধ্যমে কোনো ধরনের দূর্নীতি হয়েছে কিনা তা নিয়ে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা হয়েছিলো।
বিএনপির তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জমির উদ্দিন সরকার পথকলি কনসেপ্টকে খুব পছন্দ করতেন শুনেছি। ট্রাষ্টের সচিব মোঃ হোসাইন আমাকে জানিয়েছেন- জমির উদ্দিন সরকার সাহেব পথকলি ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য আমার প্রশংসাও করতেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া নাকি এটা আমার সৃষ্টি বলে সহ্যই করতে পারতেন না। জমির উদ্দিন সরকার সাহেব নাকি বেগম জিয়াকে বুঝনোরও চেষ্টা করেছিলেন যে- এটা একটা সুন্দর প্রতিষ্ঠান- এটা চলুক না। এতে তো এরশাদ সাহেবের নাম নেই।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্দেশ দিলেন যে, এই ট্রাষ্ট রাখতে হলে নাম বদলাতে হবে। মোঃ হোসাইন আমাকে আরো জানালেন যে, এক দিনের নোটিশে পথকলি ট্রাষ্টের বিরাট সাইন বোর্ডটি নামিয়ে ফেলা হয়েছিলো। এরপর ১৯৯২ সালের ২৬ আগষ্ট তারিখে ট্রাষ্টের বোর্ড সভায় কয়েকটি নতুন নাম নিয়ে যাচাই বাছাই করা হয়। অতপর ৬/৯/৯২ তারিখের সভায় পথকলি ট্রাষ্ট নাম পরিবর্তন করে ‘শিশু কল্যাণ ট্রাষ্ট’ নামকরণ করা হয়। এভাবেই তৎকালীন বিএনপি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আরো একটি নগ্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।
তাও যদি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই ট্রাষ্ট গঠন করা হয়েছিলো সেই কার্যক্রম বহাল রাখা হতো- তাহলেও কোনো কথা ছিলোনা। থেমে গেলো অবহেলিত পথকলিদের স্কুলের কলকাকলি। পথকলিদের চিকিৎসার জন্য শ্যামপুরের কাছে মুন্সিখোলায় একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছিলো। সেই হাসপাতালটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এই চিকিৎসা কেন্দ্রটি চালু রাখা হলে কি আমি উপকৃত হতাম- না অসহায় মানুষেরা উপকৃত হতো?
প্রখ্যাত গায়ক মান্না দের একটা বিখ্যাত গান আছে- “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”।
কিছুটা হতাশা কিছুটা নষ্টালজিয়া মিশ্রিত এই গানের প্রতিবাদ্য বিষয় হচ্ছে- এক সময় কফি হাউজের আড্ডায় রাজনীতি, সংস্কৃতি কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সবাই যার যার জীবিকায় জড়িয়ে গেছে। আড্ডার মানুষগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সেখানে আর আড্ডা বসেনা। কবি বা গীতিকারের লেখা এই গানটি এখনো আবেদনময়।
আমাদের এখানে কেউ লেখেন না যে, “পথকলি স্কুলের সেই কলকাকলি আজ আর নেই। ” পথকলি স্কুলের সেই পথকলিরা আবার টোকাই হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম আইন এখনো বলবৎ আছে। শিশুশ্রম আমাদের দেশে এখনো আছে। শিশুরা কারখানায়, গ্যারেজে, বাসা-বাড়িতে, রেল- বাস- লঞ্চ স্টেশনে কঠোর পরিশ্রমের কাজ এখনো করছে।
এমনকি তাদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজও করানো হয়। এভাবে শিশুদের একটি অংশ যাতে ধংশ না হয়- তাদের জীবনও যাতে অর্থপূর্ণ হয়- সে ব্যবস্থা করাটা যেন আমার অপরাধ হয়েছিলো! আমরা দেখলাম- নিস্ব মানুষের কাছে উচ্চহারের সুদে ঋণ দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে সেই ঋণ আদায় করার দক্ষতার জন্য নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর এই দেশের নিরন্ন অসহায় শিশুদের জীবনকে অর্থবহ করার কার্যক্রম ও পদক্ষেপ বাতিল হয়। তাই মাঝে মাঝে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে “কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!”
তবে অনেক বিচিত্র ঘটনাই আমরা অবলোকন করে যাচ্ছি। ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তন আর একটি বিচিত্র ঘটনা।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুতেই আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সেই আলোর মধ্যে পথকলিদের মুখেও আবার একটুখানি হাসি দেখার প্রত্যাশা করি। পথকলি ট্রাষ্টের সেই অন্তরাত্মা এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ট্রাষ্টের ফান্ডও রয়ে গেছে। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন জানাবো- আবার সেই পথকলি ট্রাষ্ট পুনরুজ্জীবিত করা হোক।
আবার ট্রাষ্টের কার্যক্রম শুরু করা হোক। পথকলি নামের উপর প্রতিহিংসার যে কালো ছায়া লেগে আছে তা মুছে দেয়া হোক। বিগত ১৫ বছরে দুইটি দলীয় সরকার যে সব কু-কর্ম করেছে- তার অনেক কিছুই বর্তমান সরকার সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনের উদ্যোগ তার মধ্যে অন্যতম। সেইভাবে পথকলি ট্রাষ্টের কার্যক্রম আবার চালু করা হলে সেটাও হবে এই সরকারের একটি মহৎ কাজ।
আবার যদি ছিন্নমূল অসহায় শিশুরা- যারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, ডাষ্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খায় কিংবা কারখানায় কঠোর পরিশ্রম করে তাদের যদি আবার শিক্ষালয়ের বেঞ্চে বসিয়ে দেয়া যায়- তাহলে হয়তো ওরা আবার অন্ধগলি থেকে আলোর পথে ফিরে আসতে পারবে।
ঢাকা শহরে বের হলে প্রায়ই জানজটে আটকা পড়তে হয়। সেদিন মহাখালীতে গাড়ির ভীড়ের মধ্যে বসে দেখলাম ফুটপাত দিয়ে আট/দশ বছরের একটা ছেলে কাঁধে বড় একটা বস্তা ঝুলিয়ে কাগজ কুড়িয়ে যাচ্ছে। গাড়ির মধ্যে আমাকে বসা দেখে ছুটে এসে সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলাম- কী নাম তোর? উত্তরে বললো, আমার নাম- কালাম।
ছেলেটার কাছে প্রশ্ন করে জানলাম, সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে সে বিশ-ত্রিশ কিংবা চল্লিশ টাকার হতো উপার্জন করে। তাই দিয়েই ওকে চলতে হয়। ওর মা আর এক বোন আছে। তারা বাসা-বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম- লেখাপড়া কিছু জানে কি- না। বললো- কিছুই জানেনা। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে টাকা পয়সা গুনিশ কীভাবে? বললো- এমনি এমনি শিখেছি। তারপর আর কালামের সাথে কথা বিনিময় হয়নি। গাড়ির জট কেটে গেছে।
আমার গাড়ি দ্রুত চলতে শুরু করলো। ছেলেটার সাথে আরো কথা বলতে ইচ্ছা ছিলো। ওর কথাগুলো আমার মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো বারে বারে তীরে এসে আছড়ে পড়ছিলো। স্মৃতির পাতাটা খুলে গেলো। এ ধরনের কালামদের নিয়ে আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়লো।
আবার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো- এই সব কালামদের শেষ গন্তব্য কোথায়? ওকি সারা জীবন কাগজ কুড়িয়ে বিশ- ত্রিশ- চল্লিশ টাকা আয় করে জীবন কাটিয়ে দেবে? নিশ্চয় না। ওর জীবনেও যৌবন আসবে। কৈশোরে দুরন্তপনা থাকবে। সে দিন দিন দুর্বল হয়ে যাবেনা। তার মধ্যেও স্বাদ আশার জন্ম নেবে।
সে এই শহরে কাউকে বিলাসবহুল জীবন-যাপন করতে দেখবে, কেউ গাড়ি চড়ে বেড়াবে, কেউ ভালো ভালো খাবার খাবে, কেউ দামি- দামি পোশাক পড়বে; আর কালামরা নিজের গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখবে সে ছিন্ন মলিন বসন পড়ে আছে, তার পেটে ক্ষুধা নিত্য সঙ্গী হয়ে রয়ে যাচ্ছে- এটা চলতে পারেনা। একদিন হয়তো সুযোগ বুঝে কোনো মহিলার হাতের ব্যাগটা টান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। তারপর সেখানে যে টাকা পয়সা পাবে, তাই দিয়ে ভালো খাবার কিনে খাবে। ভালো একটা জামা কিনে পড়বে। এভাবে একবার দু’বার করে নিজে সামলে যেতে পারলে ক্রমে তার সাহস বেড়ে যাবে।
তারপর বাড়তে থাকবে তার মধ্যে অপরাধ প্রবনতা। একটা ছিচ্কে ছিনতাইকারী থেকে হয়তো হয়ে যাবে একটা বড় সন্ত্রাসী। এর বিপরিতে এই সব কাগজ কুড়ানো কালামদের ভালো হওয়া কিংবা সুস্থ্য স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন-যাপনের ভবিষ্যৎ আছে কি?
এ রকম চলার পথেই একবার এক শিশুকে তার মায়ের পাশে বসে পাথর ভাঙ্গতে দেখে আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো। সেই ব্যাকুলতা সৃষ্টি করেছিলো এক মহৎ কর্মের সোপান। তখন শিশুটির কাছে গিয়ে দেখলাম- হাতুরিটা জাগাতে তার কষ্ট হয়।
বুকের পাজরগুলোও নড়ে চড়ে যাচ্ছে। তবুও তার পাথর ভাঙ্গতে হচ্ছে। হাত দু'টো ধরে দেখলাম- নরম হাতের পাতায় ফোস্কা পড়েছে। এই দৃশ্য দেখে মনটা হু-হু করে কেঁদে উঠলো। সেই কান্না ভেজা অনুভুতি থেকে আমার মধ্যে একটি ধারনার জন্ম হয়েছিলো।
ওরা পথকলি। ওদের ফুটতে দিতে হবে।
সে সময় আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম- এই সব শিশুদের আমি একটি অর্থপূর্ণ জীবন ফিরিয়ে দেবো। তখন এই ধরনের শিশুদের একজন কার্টুনিষ্ট নাম দিয়েছিলেন টোকাই। সাধারণ মানুষও তাদের এই নামেই ডাকতো।
এই অবহেলিত শিশুদের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য এবং ওদের প্রতি সহানুভুতি জাগ্রত করার লক্ষ্যে আমার হৃদয়ের আবেগ অনুভুতি উজাড় করে দিয়ে একটা গান লিখেছিলাম। সেই গানের কথাগুলো এখানে স্মরণ করতে চাই!
“পথের ধারে অবহেলায়
যাদের কাটে সকল সময়
চলার পথে কুড়িয়ে নিয়ে
ঘুচাই তাদের মনের ভয়।
পাথর তারা ভাঙ্গে মাঠে
ঘুরে বেড়ায় পথে ঘাটে
দুঃখ যাদের জীবনময়
জীবন যাদের কাটে অভিশাপে
নাম দিয়েছি পথের কলি
আসুক তারা আলোর পথে
পিছনে ফেলে অন্ধগলি। ”
আমি দেখেছিলাম- এ রকম শিশুরা কারখানায়- গ্যারেজে, বাসা-বাড়িতে কঠোর পরিশ্রম করে- মানবেতরভাবে জীবন-যাপন করে। কোথাও পেটে-ভাতে, কোথাও বা নাম মাত্র বেতনে।
অথচ তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। কেউ বা রাস্তায় ভিক্ষা করে। ওদের দেখে, ওদের কথা জেনে আমার হৃদয়টা যে কতটা বিগলিত হয়েছিলো- তার পরিমাপ কখনোই করতে পারবো না।
তখন আমি দেশের রাষ্ট্রপতি। মানুষের জন্য ভালো কাজ করার সুযোগ তখন আমার হাতে ছিলো।
তাই আমি সে সময় পথের ধারের অবহেলিত এই শিশুদের কল্যাণের লক্ষ্যে আমার মনপ্রাণ উজার করে একটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেই উদ্যোগের ফসল ছিলো পথকলি ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা। যে কলিগুলো পথের ধারে পরেছিলো- তাদের তুলে এনে সযত্নে লালন-পালন এবং তাদের মানুষের মতো মানুষ রূপে প্রস্ফুটিত করার প্রয়াস আমি হাতে নিয়েছিলাম। আমার সে প্রচেষ্টা সফলও হয়েছিলো। আমি সেদিন শিল্পীকে উদেশ্য করে বলেছিলাম, দয়া করে অবহেলিত শিশুদের আর টোকাই বলবেন না।
ওরা পথের পাশে পরে থাকা ফুলের কলি। ওদের ফুটিয়ে তোলার জন্য আমি দায়িত্ব নিয়েছি। ওরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর- এদেশের ভবিষ্যৎ মূল্যবান নাগরিক। ওরা এখন থেকে পথকলি নামেই পরিচিত হোক।
আমি জানতাম আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শিশু-শ্রম নিষিদ্ধ।
কিন্তু আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো একেবারে বিরত করা সম্ভব নয়। গ্রামপ্রধান আমাদের এই দেশের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের সাথে জড়িত। অনেক কৃষকের সন্তান লেখা পড়া করলেও কৃষিকাজে তারা তাদের বাবাকে সাহায্য করে। মাঠে তাদের বাবার সাথে কাজ করতে হয়। এটা নিবৃত করানো সম্ভব নয়।
পান্তরে শহরাঞ্চলে এমন অনেক শিশু আছে যারা একেবারেই অসহায়। তারা অন্ততঃ কোথাও কোনো কাজ করে দু'বেলা দু’মুঠো খাবার সংস্থান করতে পারে। এই সুযোগ না থাকলে তাদের ভিক্ষা করতে হয়। আমি এই বাস্তবতা উপলদ্ধী করে শিশু-শ্রম একেবারে নিষিদ্ধ না করে শিশুদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের কাজটি না করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেই সাথে শিশুরা যাতে কাজের ফাঁকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে লেখাপড়া শিখতে পারে তারই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পথকলি ট্রাষ্ট গঠন করেছিলাম।
আমার প্রতিষ্ঠিত পথকলি ট্রাষ্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো- ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই তারিখে। ট্রাষ্টের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বেগম রওশন এরশাদ এবং প্রথম সচিব নিযুক্ত হয়েছিলেন লেঃ কর্ণেল (অবঃ) মোহাম্মদ হোসাইন। এই ট্রাষ্টের পরিচালনার দায়িত্ব ন্যাস্ত ছিলো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের উপর। হৃদয়বান ব্যাক্তি ও বিভিন্ন সংস্থার দেয়া চাঁদার অর্থে পথকলি ট্রাষ্টের ব্যয়ভার চালানো হতো। তখন ট্রাষ্ট চালানোর জন্য যে অর্থ আমি সংগ্রহ করতাম তা হোটেল শেরাটনের সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় পথকলি ট্রাষ্টের নামে জমা থাকতো।
আমার সময়ে মোট পাঁচ কোটি টাকা ফিক্স ডিপোজিট করা হয়েছিলো। শুনেছি সেই টাকা এখনো ব্যাংকে জমা আছে এবং সুদে-মুলে তার পরিমাণ হয়েছে প্রায় দশ কোটি টাকা।
এই ট্রাষ্টের কার্যক্রম হিসেবে পথকলিদের জন্য শিক্ষা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমি যেটুকু সময় পেয়েছিলাম- সেই সময়ের মধ্যে মোট ৭১টি পথকলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা পথকলিদের লেখাপড়া শিখাতেন।
আমি কারখানা মালিকদের- যাদের কারখানায় শিশু শ্রমিক কাজ করতো- তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম যে, আপনারা শিশু শ্রমিকদের দিয়ে যে ক’ঘন্টা কাজ করান সেই সময়ের মধ্য থেকে ২ ঘন্টা সময় ছেড়ে দিতে হবে এবং যে টাকা বেতন দেন তার সাথে আর ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেবেন। বাড়তি ৫০ টাকা ওদের নামে ব্যাংকে জমা করা হবে এবং যে ২ ঘন্টা সময় দেয়া হবে সেই সময় ওরা স্কুলে লেখাপড়া শিখবে। আমার হিসাব ছিলো, পথকলি শিশুরা পাঁচ বছর লেখা পড়া করলে- ওদের প্রত্যেকের নামে ব্যাংকে তিন হাজার টাকা জমা হবে। তার সাথে কিছু সুদও জমা হবে। পথকলি স্কুলের পড়া শেষ করে চলে যাবার সময় এই টাকা ওদের এক সাথে দিয়ে দেয়া হবে।
এই টাকা দিয়ে হয়তো তারা আরো কিছু উপায়ের ব্যবস্থা করতে পারবে। আমি সেসব মালিকদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তারা আমার আহ্বানে সর্বান্তকরনে সাড়া দিয়েছেন। আমি জানি, আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত হৃদয়বান। যে কোনো মানবিক আবেদনে তারা সাড়া না দিয়ে পারে না। আমার পথকলি ট্রাষ্টের উদ্যোগ সফল হয়েছিলো- দেশের হৃদয়বান মানুষের একান্ত সাহায্য সহযোগিতা ও নৈতিক সমর্থনের কারণে।
আমি উপলদ্ধী করেছিলাম পথকলি শিশুরা সব সময় ঠিক মতো খেতে পায়না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ লেখাপড়া শিখতে আসবে না। তাই পথকলি স্কুলে যারা খেলা পড়া শিখতে আসবে তাদের একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সে কারণে এই স্কুলে উপস্থিতি থাকতো শতভাগ। শিশুরা কাজে যাবার আগে সকাল বেলা পথকলি স্কুলে আসতো।
এখানে দুই ঘন্টা লেখা পড়া শিখতো এবং যাবার সময় সকালের খাবার খেয়ে কাজে যেতো। সে সময় একজন পথকলি ছাত্রের সকালের এক বেলা খাবারের জন্য ৮ টাকা বরাদ্দ করেছিলাম। কাজ করা শিশুরা বয়সে একটু বড় থাকায় তাদের বুদ্ধিও বেশি থাকতো। ফলে লেখাপড়া সহজে শিখে যেতো। আমি দেখেছি পথকলি স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব দ্রুত লেখা পড়া শিখে যাচ্ছে।
আমি যদি সময় পেতাম তাহলে সারা দেশেই এবং প্রত্যেক শহরেই এ ধরনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক পথকলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দিতাম। আমাদের দেশে যাদের অক্ষর জ্ঞানটুকুও নেই- তারা নিরক্ষর শুধু আর্থিক কারণেই। আমি যদি পথকলি ট্রাষ্টের মাধ্যমে পথকলিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে পারতাম- তাহলে সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশ এতদিনে নিরক্ষরতা মুক্ত হতোই। শুধু নিরক্ষরতা মুক্তই নয়- যে শিশুদের জীবনের সামনে ছিলো শুধু ঘোর অমানিষা- আমি তাদের আলোর সন্ধান দিয়েছিলাম। অবহেলিত শিশুরা যদি শ্রমের পাশাপাশি লেখা পড়া শিখতে পারে- তাহলে তারাই হতে পারে দক্ষ শ্রম-শক্তি।
অবহেলিত শিশুরা টোকাই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে তারপর অপরাধের জগতে না মিশে নিজেদের দেশের মূল্যবান এবং অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আশ্রয়স্থল পেয়েছিলো পথকলি ট্রাষ্টে। সে সময়ে এবং এখনো আমার মনে হয়- জীবনে যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকি কিংবা যদি কোনো ভালো পরিকল্পনা করে থাকি- তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে আমার এই পথকলি ট্রাষ্টের ধারনা এবং তার বাস্তবায়ন।
তারপর আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিলাম। আর পথকলি ট্রাষ্টও বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ক্ষমতা ছাড়ার পর যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন তারা আমার উপর রাগ ঝাড়তে গিয়ে আমার যুগান্তকারী কর্মকান্ডগুলোকেও ধ্বংস করে দিলেন।
তা না হলে পথকলি ট্রাষ্ট নিখোঁজ হয়ে যাবে কেনো? কি দোষ করেছে এদেশের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অবহেলিত শিশুরা! ওদের কি মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার নেই? ওদের কি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খাদ্যের অধিকার নেই? আমি তো সেই অধিকার দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর ৭১টা পথকলি স্কুলের একে একে সবগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। হাজার হাজার অসহায় শিশু শিক্ষা এবং একবেলা খাবার থেকে বঞ্চিত হলো। আবার সেই শিশুরা সারা দিনমান কারখানায় কঠোর পরিশ্রমের সাথে জড়িয়ে পড়লো। কেউ রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়ানো শুরু করলো।
কেউবা একটা রুটি কিনে খাবার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে শুরু করলো।
আমি কারামুক্ত হবার পরও পথকলি ট্রাষ্টের খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে পথকলি শব্দটি মুছে গেছে। শুনেছি বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ট্রাষ্ট বিলুপ্ত না করলেও এর নাম বদলে দেয়। যেহেতু এই ট্রাষ্টের নামে ব্যাংকে অর্থ জমা ছিলো- তাই ট্রাষ্টটি বহাল রাখলেও এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।
এই ট্রাষ্টের মাধ্যমে কোনো ধরনের দূর্নীতি হয়েছে কিনা তা নিয়ে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করা হয়েছিলো। বিএনপির তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জমির উদ্দিন সরকার পথকলি কনসেপ্টকে খুব পছন্দ করতেন শুনেছি। ট্রাষ্টের সচিব মোঃ হোসাইন আমাকে জানিয়েছেন- জমির উদ্দিন সরকার সাহেব পথকলি ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য আমার প্রশংসাও করতেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া নাকি এটা আমার সৃষ্টি বলে সহ্যই করতে পারতেন না। জমির উদ্দিন সরকার সাহেব নাকি বেগম জিয়াকে বুঝনোরও চেষ্টা করেছিলেন যে- এটা একটা সুন্দর প্রতিষ্ঠান- এটা চলুক না।
এতে তো এরশাদ সাহেবের নাম নেই। এরপর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্দেশ দিলেন যে, এই ট্রাষ্ট রাখতে হলে নাম বদলাতে হবে। মোঃ হোসাইন আমাকে আরো জানালেন যে, এক দিনের নোটিশে পথকলি ট্রাষ্টের বিরাট সাইন বোর্ডটি নামিয়ে ফেলা হয়েছিলো। এরপর ১৯৯২ সালের ২৬ আগষ্ট তারিখে ট্রাষ্টের বোর্ড সভায় কয়েকটি নতুন নাম নিয়ে যাচাই বাছাই করা হয়। অতপর ৬/৯/৯২ তারিখের সভায় পথকলি ট্রাষ্ট নাম পরিবর্তন করে ‘শিশু কল্যাণ ট্রাষ্ট’ নামকরণ করা হয়।
এভাবেই তৎকালীন বিএনপি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আরো একটি নগ্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। তাও যদি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই ট্রাষ্ট গঠন করা হয়েছিলো সেই কার্যক্রম বহাল রাখা হতো- তাহলেও কোনো কথা ছিলোনা। থেমে গেলো অবহেলিত পথকলিদের স্কুলের কলকাকলি। পথকলিদের চিকিৎসার জন্য শ্যামপুরের কাছে মুন্সিখোলায় একটি চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছিলো। সেই হাসপাতালটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
এই চিকিৎসা কেন্দ্রটি চালু রাখা হলে কি আমি উপকৃত হতাম- না অসহায় মানুষেরা উপকৃত হতো?
প্রখ্যাত গায়ক মান্না দের একটা বিখ্যাত গান আছে- “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”। কিছুটা হতাশা কিছুটা নষ্টালজিয়া মিশ্রিত এই গানের প্রতিবাদ্য বিষয় হচ্ছে- এক সময় কফি হাউজের আড্ডায় রাজনীতি, সংস্কৃতি কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সবাই যার যার জীবিকায় জড়িয়ে গেছে। আড্ডার মানুষগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সেখানে আর আড্ডা বসেনা।
কবি বা গীতিকারের লেখা এই গানটি এখনো আবেদনময়। আমাদের এখানে কেউ লেখেন না যে, “পথকলি স্কুলের সেই কলকাকলি আজ আর নেই। ” পথকলি স্কুলের সেই পথকলিরা আবার টোকাই হয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম আইন এখনো বলবৎ আছে। শিশুশ্রম আমাদের দেশে এখনো আছে।
শিশুরা কারখানায়, গ্যারেজে, বাসা-বাড়িতে, রেল- বাস- লঞ্চ স্টেশনে কঠোর পরিশ্রমের কাজ এখনো করছে। এমনকি তাদের দিয়ে অপরাধমূলক কাজও করানো হয়। এভাবে শিশুদের একটি অংশ যাতে ধংশ না হয়- তাদের জীবনও যাতে অর্থপূর্ণ হয়- সে ব্যবস্থা করাটা যেন আমার অপরাধ হয়েছিলো! আমরা দেখলাম- নিস্ব মানুষের কাছে উচ্চহারের সুদে ঋণ দিয়ে অত্যন্ত কৌশলে সেই ঋণ আদায় করার দক্ষতার জন্য নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। আর এই দেশের নিরন্ন অসহায় শিশুদের জীবনকে অর্থবহ করার কার্যক্রম ও পদক্ষেপ বাতিল হয়। তাই মাঝে মাঝে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে “কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!”
তবে অনেক বিচিত্র ঘটনাই আমরা অবলোকন করে যাচ্ছি।
ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তন আর একটি বিচিত্র ঘটনা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুতেই আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সেই আলোর মধ্যে পথকলিদের মুখেও আবার একটুখানি হাসি দেখার প্রত্যাশা করি। পথকলি ট্রাষ্টের সেই অন্তরাত্মা এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ট্রাষ্টের ফান্ডও রয়ে গেছে।
তাই বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন জানাবো- আবার সেই পথকলি ট্রাষ্ট পুনরুজ্জীবিত করা হোক। আবার ট্রাষ্টের কার্যক্রম শুরু করা হোক। পথকলি নামের উপর প্রতিহিংসার যে কালো ছায়া লেগে আছে তা মুছে দেয়া হোক। বিগত ১৫ বছরে দুইটি দলীয় সরকার যে সব কু-কর্ম করেছে- তার অনেক কিছুই বর্তমান সরকার সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনের উদ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।