পর্ব তিনঃ
বিজয়ার পরে গ্রাম ছেড়ে বরিশাল শহরে দিদির বাড়ি, লক্ষ্মি পূজার আয়োজনের ব্যস্ততা। দিদির ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ততার মাঝ আমার বন্ধুটি হাত লাগাল সব কাছে। চালের গুড়ায় আঁকা লক্ষির পা হেঁটে যায় ঘর থেকে ঘরে। আহা সেই নানা রকম সবজী নারকোল দেয়া খিচুড়ির স্বাদ আজো লেগে আছে জ্বীবে। দুচার দিন ঘুরব আশে পাশে তারপর ফেরার পালা কিন্তু সেদিন বিকালে টেলিফোন পেলাম বরগুনা থেকে আমার ফুপার, "আমার এখানে চলে এসো কয়েকদিন বেড়িয়ে যাও।
লঞ্চে তোমাদের জন্য কেবিন রির্জাভ করা আছে। " ঝটপট তৈরী হয়ে আমরা হাজির মেঘনার পাড়ে। বরিশাল থেকে লঞ্চ যাবে বরগুনা রাত ভর। আমরা দুটো মেয়ে আমাদের র্নিধারিত রুমে ঢুকে গুছিয়ে বসলাম। এসপি সাহেব আমাদের জন্য গার্ডের ও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যে রাইফেল কাঁধে আমাদের পাহারায় নিয়োজিত।
কেউ আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদিকে এই ভাবনা নিজেদের বন্দি ভাবালেও আরেক দিকে নিরাপত্তা আমাদের আনন্দ অনেক বাড়িয়ে দিলো। জুলু জুলো চোখে তাকানো লোকেদের অবজ্ঞা করে আমাদের ইচ্ছা মতন কখনো রুমে কখনো বারান্দায় কখনো ডেকে দাঁড়িয়ে নদীর খোলা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে ভরা পূর্ণিমার সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। বিশাল নদী কূল নাই দুই পাশে জল ঝিলমিল, চাঁদের টুকরো ভেঙ্গে গুড়িয়ে হীরের কণার মতন ছড়িয়ে পড়ছে। দূরে দু একটা জেলে নৌকার টিমটিম বাতি। আকাশে সর্প্তষির বয়ে চলা আমাদের সাথে আর দু একটা রাত জাগা পাখির উড়ে যাওয়া, সে এক অদ্ভুত মায়াবী রাত দুধ সাদা জোছনা ধূয়ে দিচ্ছে পৃথিবী।
উছলে পড়া চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে নদীর জলে। ঝিলমিল জলের জলতরঙ্গ বাজচ্ছে মনে। অপার্থিব সে সৌন্দর্য আমরা তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছিলাম প্রায় ভোর পর্যন্ত। খানিক তন্দ্রায় ঘুম দুচোখে জড়াতে না জড়াতে জেগে উঠলাম সকালের রক্তরাগে। অদ্ভুত এক শান্ত সকাল ছোট নদীর তীরে।
ঘাট পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এস,পি সাহেবের জীপ আমাদের নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। ছিমছাম দোতালা বাড়িতে সকলের আদর আপ্যায়নের সুযোগ দেয়ার আগে আমরা ঘুমানোর জন্য ব্যাস্ত হলাম।
দিন দুই বেশ গল্পে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটল। তৃতীয় দিন ফুপা যাচ্ছেন অফিসিয়াল ট্যুরে চরফেস্যান, খেপুপাড়া, কলাপাড়া বললেন, তোমরাও যেতে পারো আমার সাথে। ছোট ফুপাতো এক বোন আর আমরা দুজন সাথি হলাম।
স্পিডবোড চলছে পায়রা নদীর বিশাল ঢেউ কেটে। সমুদ্রের মোহনার নদী সমুদ্রের মতনই ঢেউ। লাফিয়ে লাফিয়ে বোট চলে যাচ্ছে জল কেটে প্রচণ্ড গতিতে। দারুণ লাগছে সে ঢেউর দোলা। খানিক আসার পর স্পীডবোটের ইঞ্জিন থেমে গেলো কাজ করছে না।
এতক্ষন ঢেউ দেখে ভয় না পেলেও এবার ভয় পেলাম। চারপাশে জল ছাড়া কিছু নেই যার সাথে বাঁধা যাবে বোট। স্রোতের টানে ভেসে কোথায় যে চলে যাবো কে জানে। কিন্তু দুই ঢেউর মাঝে একই জায়গায় থেকে ঢেউর দোলায় সামান্য দুলতে লাগল বোট, এক অদ্ভুত অভিঙ্গতা হলো। চালক ইঞ্জিন ঠিক করল বেশ কিছু সময় নিয়ে, আমরা আবার চলতে লাগলাম।
চিকন খালের মতন নদী দুই পাশে মগদের বাড়ি। বেশ কিছুক্ষন চলার পর আমরা এক জায়গায় থামলাম। থানায় গিয়ে এসপি সাহেব অফিসিয়াল কাজ শেষ করলেন আর আমরা ভিতর বাড়িতে আপ্যায়িত হলাম।
ঘন্টা দুই পর আবার যাত্রা শুরু হলো। এখানে আমরা স্পিড বোট ছেড়ে নৌকায় চলেছি।
এবার যেখানে এলাম সেখানে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। এখানে বেশ বড় ধরনের কাজ এস,পি সাহেবের। অনেকটা সময় লাগবে। আমাদের দুপুরের খাওয়া এখানে হবে। এই থানার ওসি সাহেব অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেছেন।
আগামীকাল এই আস্তানা ছেড়ে যাবেন। বাধা ছাদা শেষ। অথচ আমাদের জন্য যে বিশাল আয়োজন এরমাঝেও তারা করেছেন তা সত্যি মনে রাখার মতন। সবজী, মাছ, মাংসের কয়েক রকম পদ। ভাত পোলাউ, শুটকির কোন আয়োজনই বাদ নেই।
এত কিছুর পর মিষ্টি আর খাটি গরুর দুধ খাওয়ানোর জন্য সেকি সাধাসাধি। !
হয়তো আন্তরিকতা, হয়তো এই নিয়ম. তবে এত কিছুর আয়োজন একসাথে না করাই মনে হয় শ্রেয়। (অবশ্য এটা এখনের উপলব্ধি) তখন ভালোই লেগে ছিল যদিও যতটুকু একবেলার আহার ততটুকুই খেতে পেরেছিলাম ।
বিকালের দিকে নৌকায় চড়ার জন্য এসে পরলাম এক মহা বিপত্তির মুখে।
যে নৌকা নদীর কিনারে রেখে আমরা নেমেছিলাম সে এখন ডাঙ্গার উপর বসে আছে জল রূপালী ফিতার মতন চকচক করছে নদীর মধ্যিখানে।
ভেজা ভেজা জলের দাগ নদীর সীমানা দেখাচ্ছে। কজন লোক মিলে টেনে নৌকা আরো নীচে জলের মাঝে নিয়ে গেলো আমাদের হেঁটে ওখানে গিয়ে নৌকায় উঠতে হবে। তা এ আর এমন কী, নদীর মাঝ দিয়ে হাঁটব বেশ তো মজা এইটুকু হেঁটে চলে যাবো এক্ষুনি, হাহা হিহি আমাদের অন্য রকম আনন্দ হচ্ছে। যেই না ভেজা মাটির উপর পা পরেছে মনে হলো শরীর সোজা রাখা বড় কঠিন এখনি পিছলে দড়াম করে গড়িয়ে পপাত ধরনীতল হবো। কী ভয়াভহ পিচ্ছিল সে মাটি, মাগো এখনো পা শিরশির করে উঠছে।
কাদা নয় ঝকঝকে তকতকে মাটি দেখে কিছু বোঝার উপায় নাই, পা ফেলার সাথে টের পাওয়া যায়। জোয়ারের জল নেমে ভাটা চলছে তাই এই অবস্থা। বহু কসরত করে স্যান্ডেল হাতে, খালি পায়ে.. এঁকে বেঁকে অনেক সময় নিয়ে, এ ওকে ধরে পরতে পরতে কোন মতনে একসময় নৌকায় চড়তে পারলাম অবশেষে। আবার যাত্রা শুরু হলো। এবার আমরা যাচ্ছি কুয়াকাটা।
আবেশমাখা সুন্দরী গাছ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুই পারে । শান্ত নদীর জলে তাদের স্থির চিত্র। বিকেলের নরম আলোয় অসম্ভব মায়াবী লাগছে। প্রকৃতির বড় শান্ত রূপ এখানে। মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও কিছু নেই শুধু এই নদী সবুজ বনানী খোলা আকাশ আর আমরা কজন মানুষ।
আমাদের নৌকা যাত্রা শেষ হলো এবার মাইল পাঁচ কী ছয় যেতে হবে মাটির রাস্তা ধরে। এখানে কোন গাড়ি চলে না। আমরা তো অত হাঁটতে পারবো না তা হলে কী উপায়? রিকশাও নেই কোন । দেখা গেলো ওখানে এক ধরনের বাহন চলে যার নাম হেলিকাপটার । রিকসার মতন তিন চাকা পিছনে একটি পাটাতন।
আরতো কোন উপায় নাই তাই আমরা অতেই চড়ে বসলাম । হেলিকাপটার যায় সামনের দিকে আর আমাদের মনে হয় যে কোন সময় উড়ে যাবো পিছনে। ধরার কিছু নেই মাটির রাস্তায় সেকি ঝাঁকুনি। তা সব কিছুই আমাদের হাসির উদ্রেক করে আমরা হাসি ঠিক ভাবে বসতে না পারার জন্য, যে কোন সময় পরে যাওয়ার আশংকায় আর নতুন এক বাহনে উঠার আনন্দে।
দুইপাশের মাঠে অনেক পাখি।
ফুপা সাহেব রাইফেল নিয়ে নেমে গেলেন মাঠে। গুলি ছুটে গেলো কয়েকটা পাখি পরে গেলো । দৌড়ে গিয়ে তাদের ধরে জবাই দেয়া হলো।
পাখিসহ গোধূলির খানিক আগে আমরা পৌঁছালাম কুয়াকাটা । নিবিড় ধূধূ প্রান্তরের মাঝে একটি মাত্র পাকাদালান গেস্টহাউস সদ্য তৈরী হয়েছে।
দারোয়ান আমাদের ঘর খুলে দিলো। ঘরে জিনিস পত্র রেখে আমরা ছোট লাগালাম সাগর পাড়ে। সূর্যাস্তের রঙিন আলোয় উদ্ভাসিত তখন কুয়াকাটা সমুদ্রের জল। লাল সূর্য ঘুরে ঘুরে ডুবে যাচ্ছে জলের নীচে। জলের মাঝে নেমে গেলাম সূর্যের মতন।
সাগর এখানে অতটা উত্তাল নয় কক্সবাজার বা টেকনাফের মতন। মোহনায় কিছুটা শান্ত। জলের মাঝে ঝাপাঝাপি করে ফিরে এলাম চাঁদের আলোয় সাদা বালুকায় পা ফেলে। পাখির মাংস রান্নার সুগন্ধ আমাদের ক্ষিদা বাড়িয়ে দিল। খেয়ে চাঁদের আলোয় সাগরের র্গজন শুনে কাটালাম ছাদের উপর গল্পে সবাই মিলে গভীর রাত পর্যন্ত।
পরদিন ভোরে উঠেই সূর্যদোয়ের খুঁজে চললাম সাগর পাড়ে আবার। যে সূর্য নেমে গিয়েছিল সন্ধ্যায় জলের নিচে সেই যেন ফিরে আসছে ধীরে ধীরে আকাশে রঙ ঢেলে, পানির মাঝে সপ্তরঙের ভেলা ভাসিয়ে। মুগ্ধ অপার বিষ্ময়ে শুধু অবলকোন করা সৃষ্টির অপরূপ লীলা।
সকালের আলোয় চোখে পড়ল দূরে ছোট ছোট বাড়িঘর। মানুষের প্রধান আয় মাঝ ধরা থেকে।
খানিকটা হেঁটে যেতে সারি সারি ঝুলন্ত মাছের শুটকি দেখতে পেলাম। প্রচন্ড গন্ধ। ওর কাছে হাঁটা দুষ্কর। গ্রামের বাচ্চারা আমাদের দেখছে অবাক চোখে। সে সময় বাইরের লোকের যাতায়াত তেমন ছিলনা।
ওদের ভাষা অন্যরকম। এরপর আবার সেই হেলিকাপটার ধরে ফিরে আসা পর দিন নদীর পারে।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।