আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে উত্তাল গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল : ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ৭০০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে উত্তাল গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ৭০০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে । । ভ্যানগার্ড প্রতিবেদন। ।

জুলাই ২০১০। । মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল। মালিকরা বলছে, তারা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, এটাই যথেষ্ট। শ্রমিকদের এতেই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

মজুরি যা দিচ্ছি তা দিয়েই শ্রমিকদের চলা উচিত। কিন্তু যে মজুরি পাচ্ছে তাতে একজন শ্রমিক কি করে চলবে? চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল গার্মেন্টস শ্রমিকদের সঙ্গে তার কথোপকথন তুলে ধরে লিখেছেন - “সকালে কি খেয়ে এসেছো? - ‘ভাত আর খেসারির ডাল। ’ দুপুরে যেয়ে কি খাবে? - ‘ভাত আর আলু তরকারী। ’ রাতেও কি ভাত খাবে? - ‘না,’ বলল খুরশীদা, ‘ফ্যাক্টরি থেকে এত রাতে বাসায় ফিরে আর রাঁধতে ইচ্ছা করে না। রাতে তাই পাউরম্নটি খাব।

’ শুধু পাউরুটি? - ‘না, চিনি দিয়ে। ’ এ ছিল খুরশীদা নামে এক গার্মেন্টস কর্মীর সাথে আমার কথোপকথন। ” (দৈনিক প্রথম আলো, ৫ জুলাই ২০১০) বাজারে মোটা চাল ৩২ টাকা, মশুর ডাল ১০৫ টাকা, চিনি ৪৫ টাকা, পুকুরের পাঙ্গাস মাছও ১০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। গার্মেন্টস-এ ওভারটাইম ডিউটি করেও দুই-আড়াই হাজার টাকা বেতন পাওয়া শ্রমিক তার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এবং প্রোটিন পাবে কীভাবে? অথচ এরাই দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। দেশের রপ্তানি আয়ের ৭৫ ভাগ আসে গার্মেন্টস খাত থেকে।

গত বছর ১২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৮৪,০০০ কোটি টাকা এ খাত থেকে আয় হয়েছে। ১৯৭৮ সালে ২টি গার্মেন্টস কারখানা দিয়ে যে শিল্পের যাত্রা শুরু সেখানে আজ প্রায় ৪৫০০টি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। ৩০ লড়্গ শ্রমিক এ শিল্পের সাথে যুক্ত। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক (চীন ও তুরস্কের পর) বাংলাদেশকে তৃতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করেছে। কিন্তু কিছুদিন থেকে কখনও আশুলিয়া, কখনও সাভার, কখনও গাজীপুর, কখনও নারায়ণগঞ্জ, কখনও বা ঢাকা-চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

আন্দোলনকারী শ্রমিকরা মিছিল, সমাবেশ, ঘেরাও, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনা নতুন ঘটছে এমন নয়। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান না করে ঢালাওভাবে ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে শ্রমিকদেরকে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হাজার হাজার শ্রমিকের নামে মামলা, গ্রেফতার, চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা, পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস নিড়্গেপ ও গুলি করার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এতে সমস্যা তো সমাধান হচ্ছেই না বরং আরো গভীর হচ্ছে।

‘ষড়যন্ত্র’ না খুঁজে শ্রমিক অসন্তোষের আসল কারণ খুঁজতে হবে কোনো শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে মালিকপড়্গ এবং সরকার একযোগে বলতে থাকে এসব হচ্ছে ‘শিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র’। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হল না। শ্রমিক অসন্তোষের কারণ অনেক, সেদিক থেকে নজর অন্য জায়গায় সরাতে এসব কথা বলা হয়। অসন্তোষের মূল কারণগুলো কি? (এক) চাল, ডাল, তেলসহ জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে, পালস্না দিয়ে বাড়ছে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ কিন্তু শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে না; (দুই) সময়মতো বেতন এবং ওভারটাইম ভাতা না দেয়া, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি না থাকা; (তিন) কর্মকর্তা কর্তৃক শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার, অমানবিক ব্যবহার করা; (চার) যে কোনো অজুহাতে শ্রমিকদের ছাঁটাই, শোকজ ইত্যাদির মাধ্যমে হয়রানী করা; (পাঁচ) গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার না থাকা, অর্থাৎ শ্রমিকদের পড়্গ থেকে কথা বলার কোনো পক্ষ নেই; (ছয়) ঝুট ব্যবসায়ীরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগ গ্রহণ করে আবার মালিকের পড়্গ নিয়ে শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়। এমনকি মালিকদের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ নানা বিরোধে শ্রমিকদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

এসব নানা বিষয়ের প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকরা ড়্গুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ সারা মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জীবন-যাপনের উপযোগী মনুষ্যোচিত ন্যূনতম মজুরি না পাওয়া। ন্যূনতম মজুরি কি? ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি কি? সরকার মজুরি নির্ধারণের জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড ঘোষণা করেছে। যদিও শ্রম মন্ত্রণালয় গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা না করেই এবং দেশে প্রচলিত শ্রম আইন ২০০৬-এর মজুরি বোর্ড বিষয়ক ১৩৮ এবং ১৩৯ নম্বর ধারার তোয়াক্কা না করেই মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি মনোনীত করেছে। এ বোর্ড ইতোমধ্যে ৯টি বৈঠক করেছে (মধ্য জুলাই পর্যন্ত)।

কিন্তু মালিকরা অফিসিয়ালি ১৯৯৭ টাকা, আনঅফিসিয়ালি ২২০০ টাকার বেশি মজুরি দিতে রাজী নন। শুধু গার্মেন্টস নয়, জাতীয়ভাবেই ন্যূনতম মজুরি কি হবে তা একটু যুক্তিসঙ্গতভাবেই আলোচনা হওয়া দরকার। আমাদের দেশে মজুরি নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন কমিটি আছে। ১· জাতীয় পে কমিশন - সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে। ২· মজুরি কমিশন - সরকারি খাতে পরিচালিত কল-কারখানাসমূহের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে।

এটাকে ন্যাশনাল ওয়েজ এন্ড প্রোডাকটিভিটি কমিশন বলে। ৩· নূন্যতম মজুরি বোর্ড - বেসরকারি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর মজুরি নির্ধারণ করে। এ বোর্ড ৩৮টি সেক্টরের জন্য আলাদাভাবে মজুরি নির্ধারণ করে থাকে। এটাকে মিনিমাম ওয়েজ বোর্ড বলা হয়। ৪· ওয়েজ বোর্ড - এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের জন্য বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়।

একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর কাজের বিনিময়ে যে অর্থ পায় তাকে মজুরি বলে। মজুরি সাধারণত মাসিক ভিত্তিতে হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক, দৈনিক, পিস রেট ইত্যাদি রূপেও হতে পারে। আই·এল·ও-এর ১৩১ নং কনভেনশনে বলা হয়েছে, “সর্বনিম্ন মজুরি অবশ্যই আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, জীবন যাত্রার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।

” বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে - ‘প্রত্যেক কর্মীর নিজের ও পরিবারের মানবিক মর্যাদা রড়্গায় সড়্গম এমন ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ’ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার বিষয়টি রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তিসঙ্গত অথবা মানবিক মর্যাদা রক্ষা করার মতো মজুরি নির্ধারণ করা হবে কিভাবে? একটি শ্রমিক পরিবারে কি কি দরকার হয়? অন্তত তিন বেলা খাবার, পোষাক, মাথা গোঁজার ঠাঁই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদন ছাড়া মানবিক জীবন কিভাবে হয়? এসব বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এরপর অষ্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে, ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে, শ্রীলংকায় ১৯২৭ সালে এবং ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, মরিশাস, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে প্রতি বছর মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়। কানাডায় করা হয় প্রতি দুই বছর পর পর। বাংলাদেশে ৫ বছর পর পর মজুরি পুনঃনির্ধারণের আইন করা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের দাবি - দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতিবছর মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের তুলনামূলক মজুরি বাংলাদেশ তৈরি পোষাক রপ্তানিতে পৃথিবীতে তৃতীয়।

চীন, তুরস্ড়্গের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী তুরস্কের একজন শ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় মজুরি পান ২·৪৪ ডলার, মেক্সিকোতে ২·১৭ ডলার, চীনে ১·৮৮ ডলার, পাকিস্তানে ৫৬ সেন্ট (১ ডলার = ১০০ সেন্ট), ভারতে ৫১ সেন্ট, শ্রীলংকায় ৪৪ সেন্ট, ভিয়েতনামে ৪৪ সেন্ট পেয়ে থাকেন। ভিয়েতনাম সরকার শ্রমিকদের জন্য সস্তায় আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এখানে ধারাবাহিক শ্রমিক অসন্তোষের মূলে রয়েছে কম মজুরি। এর ফলে গোটা পোষাকশিল্পখাতের ভবিষ্যতও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশের পোষাকশিল্প খাতে শ্রমিকের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মজুরি হিসাব করে বলা হয়েছে, এখানে ঘণ্টাপ্রতি মজুরি ৩১সেন্ট। (দৈনিক প্রথম আলো, ০৮·০৬·২০১০) একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৬৬২·৫০ টাকা। এ হিসেবে ন্যূনতম মজুরি দাড়ায় ঘণ্টাপ্রতি ১০ সেন্ট। পাকিস্তান, ভারতের শ্রমিকেরা যে মজুরি পায় বাংলাদেশে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম মজুরি পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটানের চাইতেও আমাদের দেশের মজুরি কম। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশের মজুরি কাঠামোকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে ২০০৬ সালে দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত একটি গার্মেন্টস পণ্য ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১০০ ডলারে বিক্রি হলে কারখানার মালিক পান ১৫-২০ ডলার, উক্ত রাষ্ট্র ২৫-৩০ ডলার এবং বিদেশি কোম্পানি ৫০-৬০ ডলার পেয়ে থাকে। উৎপাদনকারী শ্রমিকের ভাগে পড়ে মাত্র আধা ডলার। ফলে গার্মেন্টসের রপ্তানি বাড়লে লাভবান হয় সবাই, শুধু বঞ্চিত হয় শ্রমিক। মজুরি কতো হলে বাংলাদেশের বিবেচনায় তা ন্যূনতম মজুরি হবে? ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত তা হিসাব করার জন্য বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অতীতের মজুরির পরিমাণ, কতটুকু আয় করলে একজন শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার উর্ধ্বে উঠবে, প্রতিদিন কতটুকু সুষম খাবার লাগে এবং অন্যান্য খরচ কত এসব হিসাব করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে হলে একজন মানুষের দৈনিক ২ ডলার আয় প্রয়োজন। ৪ জনের একটি পরিবার ধরলে পরিবারের আয় হওয়া উচিত ৪*৩০*২ = ২৪০ ডলার প্রতি মাসে। ১ ডলার সমান ৭০ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ২৪০*৭০ = ১৬৮০০ টাকা। [এখানে * চিহ্নকে গুণিতক রূপে ধরত হবে] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছে দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজ করলে একজন পুরম্নষ গার্মেন্টস শ্রমিকের ৩৩৬৪ কিলোক্যালরি এবং নারী শ্রমিকের ২৪০৬ কিলোক্যালরি তাপ লাগে।

এ হিসাবকে ভিত্তি ধরে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট মজুরি বোর্ডে যে হিসাব দাখিল করেছে এখানে তা পুরোই তুলে ধরা হলঃ- সাধারণভাবে একজন মানুষের জন্য তাপশক্তি কত লাগে এটা হিসেব করতে হলে বিভিন্ন কাজে কত কিলোক্যালরি তাপলাগে তা জানা দরকার। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের একজন মানুষের তাপশক্তি প্রয়োজন হয়ঃ মাঝারি গতিতে হাঁটলে (১২ মিনিটে ১ কিঃ মিঃ) ৪ কিলোক্যালরি মাঝারি ধরনের কাজে ৩ কিলোক্যালরি ঘরের কাজে ২ কিলোক্যালরি বসে থাকতে (টিভি দেখা, গল্প করা) ১·৫ কিলোক্যালরি ঘুমানোতে ১ কিলোক্যালরি। এ হিসাবে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের প্রতিদিন কত কিলোক্যালরি তাপ প্রয়োজনঃ ৮ ঘণ্টা কাজ (৮*৬০*৩) = ১৪৪০ কিলোক্যালরি ৮ ঘণ্টা ঘুম (৮*৬০*১) = ৪৮০ কিলোক্যালরি ১ ঘণ্টা বিরতি (১*৬০*১·৫) = ৯০ কিলোক্যালরি ২ ঘণ্টা ওভারটাইম (২*৬০*৩) = ৩৬০ কিলোক্যালরি ২ ঘণ্টা ঘরের কাজ (২*৬০*২) = ২৪০ কিলোক্যালরি ২ ঘণ্টা অবসর/আড্ডা/গল্প (২*৬০*১·৫) = ১৮০ কিলোক্যালরি ১ ঘণ্টা হাঁটাঃ কর্মড়্গেত্রে যাওয়া-আসা (১*৬০*৪) = ২৪০ কিলোক্যালরি সর্বমোট = ৩০৩০ কিলোক্যালরি (নারী শ্রমিকদের ওজন ৫০ কেজি ধরলে এটা কিছুটা কম হবে। আবার সন্তানসম্ভবা কিংবা প্রসব পরবর্তী সময়ে কিছু বেশি লাগবে। এখানে আরো একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

গার্মেন্টসের একজন নারী শ্রমিক ঘুমায় কতক্ষণ? এক হিসাবে দেখা গেছে মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। তাকে রান্নার জন্য লাইন দিতে হয়, বাথরুমে যাবার জন্য লাইন দিতে হয়। ফ্যাক্টরিতে দেরীতে আসলে মজুরি কাটে কিন্তু দেরীতে ফিরলে সে অনুযায়ী মজুরি বাড়ে না। ) সুষম খাদ্য দ্বারা এই ক্যালরির প্রয়োজন মেটালে শারীরিক সুস্থতা এবং কর্মশক্তি রড়্গা করা সম্‌ভব। মোট খাদ্যের ৫৭ শতাংশ কার্বহাইড্রেট যেমন চাল, আটা দ্বারা, ৩০ শতাংশ চর্বি জাতীয় খাবার যেমন তেল, ঘি, মাখন দ্বারা এবং ১৩ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ দ্বারা পূরণ করা দরকার।

ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ খুবই প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধ এবং শক্তি ব্যবহার করার জন্য। আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম শক্তি উৎপাদন করে না কিন্তু এগুলোর অভাব হলে শরীর কর্মড়্গম থাকতে পারে না। ভিটামিন ও খনিজ দ্রব্যের জন্য শাক-সবজি ও ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন। বাজারে প্রাপ্ত সস্তা খাবার দ্বারা যদি একজন শ্রমিক তার শক্তি ও পুষ্টি রড়্গা করতে চায়, তাহলে প্রতিদিন নিম্নরূপ খরচ হবেঃ খাদ্য পরিমাণ ক্যালরি বাজার মূল্য (টাকা) ১· চাল ৫০০ গ্রাম ১৮০০ ১৬·০০ ২· আটা ৫০ গ্রাম ২০০ ১·৫০ ৩· ডাল (মসুর নয়, ছোলা) ৬০ গ্রাম ২০০ ৩·৫০ ৪· তেল (সয়াবিন) ৫০ মিলিলিটার ৪৫০ ৪·৫০ ৫· ডিম ১টি ৭০ ৬·৫০ ৬· মাছ ৬০ গ্রাম ৮০ ৬·০০ ৭· আলু ১০০ গ্রাম ১০০ ১·৫০ ৮· শাক-সবজি ১৫০ গ্রাম ৫০ ৩·০০ ৯· কাঁচা মরিচ, মশলস্না, হলুদ ২·০০ ১০· ফল ১টি কলা বা আমড়া ৫০ ৪·০০ ১১· রান্নার খরচ ১০·০০ ১২· চা দিনে ২ কাপ ৬·০০ সর্বমোট ৩০০০ কিলোক্যালরি ৬৪·৫০ টাকা (অসুস্থ হলে খরচ বাড়বে। শিশুদের ভাত কম লাগবে কিন্ত অন্যান্য খরচ বাড়বে।

গড়ে ৬৪·৫০ প্রতিদিন খরচ ধরতে হবে) ৪ জনের পরিবারের খরচ কত? খাওয়া খরচ (৬৪·৫০*৪*৩০) = ৭৭৪০·০০ বাসা ভাড়া (১ রুম বিশিষ্ট + পানি + বিদ্যুৎ + গ্যাস) = ৩৫০০·০০ যাতায়াত (২ জন কর্মজীবী মানুষ) (৫০০*২) = ১০০০·০০ চিকিৎসা (২৫০*৪) = ১০০০·০০ পোষাক, অন্যান্য = ১০০০·০০ সর্বমোট = ১৪,২৪০·০০ অর্থাৎ ১৪,২৪০ টাকার কমে একটি পরিবার চলতে পারে না। স্বামী-স্ত্রী ২ জনই চাকুরী করলে প্রত্যেকের কমপক্ষে ৭১২০ টাকা মজুরি দরকার। এখানে সন্তানের শিক্ষা খরচ, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়, বিনোদন ও অতিথি আপ্যায়নের হিসেবও ধরা হয়নি। মন্ত্রী-এমপিদের বেতন বাড়ে, শ্রমিকের বাড়ে না কেন? দ্রব্যমূল্য, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের বেতন ভাতা বাড়ানো হয়েছে। সরকার সম্প্রতি পে স্কেল ঘোষণা করেছে।

এতে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন বেতনের বিশাল বৈষম্য। তা সত্ত্বেও একজন পিওন পদের কর্মচারী ৪১০০ টাকা ক্সেলে বেতন পাবেন। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও আনুসঙ্গিক ভাতাসহ সর্বনিম্ন বেতন দাঁড়ায় ৭০০০ টাকা। তাহলে যারা উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত আছে তাদের বেতন কত হওয়া উচিত? ১৯৬৯ সালে যখন আমরা পরাধীন ছিলাম তখন শ্রমিক নিম্নতম মজুরি পেত ১২৫ টাকা, অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাতা মিলে তা হতো ১৫৫ টাকা। এ মজুরি দিয়ে তখনকার বাজার দরে ৩০ টাকা মণ হিসাবে ৫ মণ চাল কিনেও ৫ টাকা উদ্বৃত্ত থাকতো।

শ্রমিকরা সেদিন এ মজুরির বিরোধীতা করেছিল। আজ অন্তত ৫ মণ চালের দামের সমান মজুরি পেতে হলেও ৭০০০ টাকা দরকার। তাই দেশের অর্থনীতির অবস্থা এবং মালিকদের সক্ষমতাসহ সামগ্রীক বিবেচনায় একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত কমপক্ষে ৭০০০ টাকা। দেশের স্বার্থেই শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন শ্রমিক বেতন পেলে সে টাকা দেশেই খরচ করে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন কাপড়, সাবান, টুথপেস্ট, স্যান্ডেলসহ দ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ে।

লুটপাটকারী ধনীরা বিদেশে বাজার করে, বিদেশে টাকা পাচার করে। শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি মানে দেশের উৎপাদনবৃদ্ধি। তাই যে দেশের শ্রমিকদের মজুরি বেশী সে দেশ তত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত। আড়াই-তিন হাজার টাকা বেতনের একজন দরিদ্র শ্রমিক মানে দুর্বল শ্রমিক, তার কাছে বেশী উৎপাদন আশা করা বোকামী। দুর্বল শ্রমিকের সন্তান শারীরিকভাবে দুর্বল এবং শিড়্গার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই, শুধু গার্মেন্টস সেক্টরেই নয়, সকল শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৭০০০ টাকা করা প্রয়োজন। বাজার দরের সাথে সঙ্গতি রেখে জীবনধারণের মতো মজুরি তাকে দিতেই হবে। গার্মেন্টস, পাট, চা, তাঁত, ঔষধ, রসায়ন, লৌহসহ বিভিন্ন শিল্পড়্গেত্রে যে লড়্গ লড়্গ শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে দেশের উৎপাদন হয়, বৈদেশিক মুদ্রা আসে, দেশে দামী গাড়ি আমদানী হয় সেই শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি বিবেকবান গণতন্ত্রমনা মানুষের দায়িত্ব। মানুষের মতো বাঁচার জন্য ন্যূনতম মজুরি, চাকুরীর নিশ্চয়তা, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বেগবান করার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাথে সাথে শ্রমিকদের এটাও বুঝতে হবে যে আমাদের দেশ একটি শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।

এখানে উৎপাদন হয় সামাজিকভাবে, কিন্তু এর মালিকানা ব্যক্তিগত। উৎপাদন হয় মুনাফার উদ্দেশ্যে এবং মুনাফা মানেই উদ্বৃত্ত মূল্য অর্থাৎ শ্রমিকের শ্রম শোষণ, ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা। এ মুনাফার প্রায় সবটাই যায় মালিকদের পকেটে। এর সাথে শ্রমিকদের এটাও বুঝতে হবে যে এ সমাজে বেতন-ভাতা যাই বাড়ুক না কেন, দ্রব্যমূল্য বাড়বে কয়েকগুণ। অর্থাৎ মজুরি বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে শ্রমিক যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থাকবে।

এ সমাজের এটাই নিয়ম। ফলে নিছক বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন শ্রমিকের ভাগ্য পাল্টাবে না। বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন শ্রমিককে অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি মজুরি দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা তথা শ্রমজীবী মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামেও আজ শ্রমিকদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শ্রেণী-সচেতন বিপস্নবী ট্রেডইউনিয়ন সংগঠন ও আন্দোলন।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।