অন্তরালের মানুষ
ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে আমাদের মত যারা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই অমুক সন্ত্রাসী গ্রেফতার, অমুক রাজনৈতিক নেতা দূর্নীতির দায়ে আটক, অমুক জঙ্গির ফাঁসি ইত্যাদি খবরে আশায় বুক বাঁধতেন তাদের সময়টা মনে হয় ইদানিং খুব সুবিধের যাচ্ছেনা। তবে এসকল রাজনৈতিক বেখবরের মধ্যে তারা মনেহয় সবচেয়ে বেশি ধাক্কাটা খেয়েছেন গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সদ্য ভোরবেলা পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে। কয়েক সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর চার মাসের টানা আন্দোলন, আমরন অনশন আর নিপীড়িত ছাত্রীদের চোখের জল উপেক্ষা করে সিন্ডিকেটে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও ণাট্যতত্ত্ব বিভাগের সেই শিক্ষকের নিঃশর্ত মুক্তির খবর। শুধু ধাক্কাই নয়, একেবারে গলাধাক্কা।
ছেলেবেলা থেকেই আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে সবসময়ই প্রগতিশীল চিন্তার চর্চা আর শুভবোধ বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে জেনে এসেছি।
অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানো আর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কঠোর নৈতিক অবস্থান আমাদের সবসময়ই নাড়া দিয়েছে। আর এ কারনেই হয়তো ছাত্রী নিপিড়নের মতো সাংঘাতিক একটি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যাতিক্রমী অবস্থান আমাদের কষ্টটাও দিয়েছে খুব বেশি।
আমাদের যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় ঢু মারার একটু আধটু সুযোগ হয়েছে, ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়বেলা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ খোজখবর রাখি তাদের হয়তো ছাত্রী নিপীড়নের বিষয়টি অজানা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্রীরা রাজনৈতিক মুখোশধারী ছাত্রনেতাদের হাতে উত্যক্ত হয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে। আবার এ কারনে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বহিস্কার করার অনেক নজিরও রয়েছে।
তবে শিক্ষদের হাতে ছাত্রী নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্তদের বহিস্কারের নজির খুব একটা বেশি নেই। এমনকি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও পূর্বে আরও এমনি কয়েকটি অভিযোগ ধামাচাঁপা দেয়ারও নজির রয়েছে।
আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়টির বাইরে অবস্থান করি তারা হয়তো ভাবতে পারি যা কিছু হচ্ছে তা হয়তো কতিপয় উশৃঙ্খল শিক্ষার্থীর ফায়দা লোটার একটা কৌশল। কিন্তু এবারের বিষয়টি যে একটু দৃষ্টিকটু ছিল তা বুঝতে দ্বিধা হচ্ছেনা। সাধারনত বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া একটি মেয়ে নিপীড়নের মানেটা খুব ভালো করেই বোঝেন।
আর এ বিষয়ে বিচার চাইতে গিয়ে তার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে ধারনাটাও স্পষ্ট। আর শিক্ষকের বিরুদ্ধে চার ছাত্রীর বিচার চাওয়া, আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, মানবন্ধন আর আত্মহুতির জন্য আমরন অনশন কি শুধুই লোকদেখানো? ইচ্ছে করেই কোন মেয়ে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি এমনি লোকদেখানোর জন্য বিসর্জন দিবে, ঢামাঢোল পিটিয়ে সকলকে জানাবে, পত্রিকায় ফলাও করে খবর ছাপানোর সুযোগ করে দেবে, ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে মানবন্ধন করবে, বিচার না পেলে আত্মহুতির হুমকি দিবে, ঘেরাও করবে-সেটা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার জন্যই অনেক শিক্ষার্থীকে রাত অবধি শিক্ষকের কাছে অবস্থান করতে হয়। আর গবেষনারত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তো এ বিষয়টি আরও প্রকট। আর এখানেই যদি ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তাহলে আমাদের নারী শিক্ষার অগ্রগতি যে মুখ থুবড়ে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রগণ্য খাত হিসেবে ঘোষনা করে আমরা লক্ষ্য নির্ধারন করেছি। তবে নারী শিক্ষাকে ব্যহত করে যে নারীর ক্ষমতায়ন কোন ভাবেই সম্ভব নয় এটাও বোদ্ধারা বিশ্বাস করেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষা ব্যহত হলে এমডিজির কতটুকু আমরা অর্জন করব তা প্রশ্নই থেকে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি কয়েকজন ছাত্রীর এধরনের নিরব নিপীড়নের ঘটনা শুনেছি। বাধ্য হয়েই পড়াশোনা ছেড়ে বিয়ে করার ঘটনাও জেনেছি।
কিন্তু তারা কখোনো সমাজ আর পরিবারের কথা চিন্তা করে বিচার চাওয়ার সাহসও পায়নি। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সকল প্রতিকূলতা কাটিয়ে সমাজ আর পরিবারকে বিসর্জন দিয়ে বিচার চাইল, তার বিচার করতে ব্যার্থ হওয়া, ব্যাক্তিস্বার্থ আর রাজনৈতিক চাপের মুখে সত্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ শোনা বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য কতটুকু সুখকর তা বোধগম্য হচ্ছেনা।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষের দেয়া রায়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে অব্যহতিতে কিন্তু দুটো রায় দেয়া হয়ে গেছে, (১) তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমানিত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট শিকক্ষকে অব্যহতি ও (২) অভিযোগকারী চার ছাত্রীকে সমাজ ও পরিবার থেকে আজীবন ঘৃনা আর অপবাদ প্রদান। কর্তৃপক্ষ যদি অভিযোগ প্রমানিত করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে বহিস্কারও করত তখন কিন্তু শুধু ১ নম্বর রায়টিই পরিবর্তন হত, ২ নম্বরটি তখনও একই থাকত। তাহলে কোন লাভের আশায় ঐ ছাত্রীরা বিচার চাইল, কেনই বা আন্দোলন করল।
আমাদের কাছে সে প্রশ্নটিরও কোন সুরাহা হয়নি।
বর্তমান গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম, প্রশাসনিক রাজনীতিকরনের এবার একটি সুরাহা হবে। কিন্তু আমাদের সেই প্রত্যাশা এখোনো আধারেই থেকে গেছে। প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মেধার চেয়ে রাজনীতিই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর এধরনের প্রশাসনিক কাঠামোর নিকট হতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চোখের জল ফেলানো সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কি ই বা প্রত্যাশা করা যায়।
তবে কষ্ট এখানেই যে আলোর পথে যে মশালটি সবচেয়ে বেশি অগ্রসর ছিল গত বছর ১৩ আগষ্ট সন্ধ্যা সাতটায় সে মশালটিও নিভে গেল। চারদিকে এখন শুধুই অন্ধকার দেখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।