আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হজের জন্য লোনঃ দরিদ্র বাঙালির ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে দরিদ্রতর করার পায়তারা

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম। এদেশের আর আট-দশটি সাধারণ মুসলিম পরিবারের মতোই আমার পরিবারের জ্যেষ্ঠজনেরা অর্থাৎ নানা, দাদা, বাবা, চাচারা ধর্মীয় বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর ছিলেন। তাঁদের অনেকেরই ইচ্ছা ছিল আমি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হই। সে কারণেই সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে প্রথমে আমাকে আরবি শিক্ষা দেয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে আমার মা এবং আমার ইচ্ছার কাছে এ প্রচেষ্টা হার মানে।

এ অবধি যতটুকু শিক্ষা লাভ করে থাকিনা কেন, আমি অন্তত এতটুকু দাবি করতে পারি যে, এ শিক্ষার মাধ্যমে আমি প্রগতি সম্পর্কে ভাবার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রগতির ধারে-কাছে হয়তো এখনো যেতে পারেনি, তবে আমার শিক্ষা অন্তত প্রগতির উত্তরোত্তর উন্নতিকে সমর্থন করার মানসিকতাকে পোক্ত করেছে। যেহেতু ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেছি তাই ধর্ম সম্পর্কে বেসিক জ্ঞান আমার আছে। আমি খুব অল্প বয়সে আরবি পড়া সম্পন্ন করেছিলাম। আরবি ভাষার পবিত্র কোরআন একসময়ে দেখে দেখে পড়তে পারতাম।

হয়তো এখনো পারব। যদিও সে শিক্ষার সঙ্গে যুক্তিসঙ্গ কারণে বহুদিন কোন সম্পর্ক নেই তথাপি ধর্মের মূল বিষয়গুলো আমার শিশুমনে এমনভাবে আবিষ্ট ছিল যে এখানো ধর্ম সম্পর্কিত (অন্তত বেসিক) কোন আলোচনা হলে আমি তাতে অংশগ্রহণের সাহস রাখি। এবার মুল আলোচনায় আসা যাক। আমরা জানি ইসলামের প্রধান স্তম্ভ বা পিলার পাঁচটি, যথাঃ কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত। প্রথম তিনটি প্রত্যেক সাবালক ও সুস্থ নর-নারীর জন্য আবশ্যিকভাবে পালনীয়।

পরের দুটি'র প্রথমটির জন্য সামর্থ্যের (সামর্থ্য বলতে এখানে আর্থিক সামর্থ্য) সাথে সাথে শারীরিক যোগ্যতা এবং সর্বশেষটির জন্য আর্থিক সামর্থ্যের প্রয়োজন। অর্থাৎ এই পাঁচটি করণীয় আবশ্যিকভাবে ব্যক্তির উপর আরোপিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত আছে। আমার এ আলোচনার বিষয় যেহেতু হজ তাই প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে আলোচনাটা শুধুমাত্র হজের ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। পূর্বের আলোচনা হতে এটা পরিস্কার যে, ব্যক্তির উপরে হজ ফরজ হওয়ার জন্য তাঁর আর্থিক সংগতির পাশাপাশি শারীরিক যোগ্যতারও প্রয়োজন আছে। আর্থিক যোগ্যতা থাকলে আরেকটি স্তম্ভ অর্থাৎ যাকাতও ব্যক্তির উপর ফরজ।

কিন্তু আপনি খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের মুসলমান সমাজে হজের প্রতি যে আকর্ষণ যাকাতের প্রতি ততোটা নেই। খুব কমসংখ্যক লোককেই দেখবেন যে, যাকাত পরিশোধ করছে। অথচ যাকাতের প্রথাটি যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করা যেত তাহলে তা সমাজের দারিদ্রতা দূর করতে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু এটা কখনোই হবেনা। কারণ আমাদের ধ্যান, মন পড়ে আছে হজের উপরে।

সামর্থ নেই এমন ব্যক্তিও সর্বস্ব বিক্রি করে হজে যাচ্ছেন, এমন দৃশ্য আমাদের সমাজে সাধারণ। বহু সাধারণ কর্মচারিকে দেখা যায় নিজের সন্তান, পরিজনকে বঞ্চিত করে জীবনের শেষ অবলম্বন পেনশনের টাকাটি দিয়ে হজ সমাপন করে আসতে। আর্থিক অসংগতির কারণে হজে যেতে না পারায় নিজের নানা, দাদাকেও অনেক সময়ে হা-হুতাশ করতে দেখতাম। এর একটাই কারণ- তাঁদের ধারণা এই কর্মটি করতে পারলে পূর্বের সমস্ত পাপ মুছে যাবে এবং তাঁরা বেহেস্ত লাভ করবেন। নিজের পরিবার তথা সন্তানের স্বচ্ছলতা বা খেয়ে,পরে বাঁচা তাঁদের কাছে মুখ্য নয়।

বাঙলায় একটি প্রবচন আছে যে, "এমনি নাচুনী বুড়ি, তার উপর ঢোলের বারি"। বাঙালির অতি ধর্মানুরাগ ও একে উস্কে দিয়ে কতিপয়ের সুবিধালাভের প্রচেষ্টা দেখলে আমাদের দেশের সাপেক্ষে উল্লেখিত প্রবচনটির প্রাসঙ্গিকতা সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক এমনই একটি নজির গতকাল আমার দেশ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের সংবাদে দেখতে পেলাম। সংবাদটির সারকথা হচ্ছে, সামর্থ্য আছে কিন্তু নগদ অর্থ নেই এমন মুসলমানদের হজের জন্য লোন হিসেবে টাকা দিবেন হজ ফাইন্যান্স কোম্পানী লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গতকাল (১৮/৭/২০১০ খ্রিঃ) জাতীয় প্রেসক্লাবে 'হজপালনে অর্থায়ন' শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার আহছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট কাজি রফিকুল আলম একথা জানান।

হজ ফাইন্যান্স কোম্পানী লিমিটেড মালয়েশিয়া ও ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকার আহছানিয়া মিশনের যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। নিজেদের এ কর্মকান্ডকে জায়েজ করার জন্য সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্যোগের সমর্থনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের বিতর্কিত খতিব মাওলানা মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের মতামত উপস্থাপন করা হয়। সংবাদটি যদি সাধারণভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে বুঝা যায় নিশ্চিতভাবে ফেরত পাবেন এমন লোকদের তারা হজের জন্য লোন দিবেন। টাকা দেওয়ার পূর্বে তাঁরা বন্ধক হিসেবে এমন কোন কিছুই বুঝে নিবেন যার মুল্য তাঁদের প্রদেয় টাকার সমান অথবা বেশি। সুতরাং তাঁদের এ উদ্যোগ যে কোন অবস্থায়ই স্বার্থহীন নয় তা উপলব্ধি করার জন্য বেশি জ্ঞান খরচের প্রয়োজন পড়বেনা।

অন্তত এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে প্রশাসনিক ব্যায়ের প্রয়োজন পড়বে তা তাঁরা কোননা কোনভাবে ঠিকই ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করে নিবে। অর্থাৎ সংগঠনটি কোন অবস্থায়ই স্বেচ্ছাসেবী বা অলাভজনক নয়। বরং বাঙালির মন-মানসিকতা বিচারে এটি হবে অত্যন্ত লাভজনক একটি বাণিজ্য। কারণ আমাদের দেশের ধর্মপাগল মুসলমানেরা সব পাপ ধুয়ে-মুছে যাবে এবং মৃত্যুর পর নিশ্চিত বেহেস্ত লাভ করতে পারবেন এই ধারণার বেড়াজালে আবদ্ধ থাকার কারণে শেষ বয়সে যেকোন উপায়েই হজ সম্পাদন করতে অত্যন্ত উদগ্রীব থাকেন। আমি জানি হজ শুধু তাঁর উপরেই ফরজ যার আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য আছে।

ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির উপর হজ বা যাকাত ফরজ নয়। অথচ এইভাবে হজের টোপে ফেলে সাধারণ মানুষকে ঋণগ্রস্থ করে হাজি সাহেব বানানো কতোটা ধর্মসংগত তানিয়ে প্রশ্ন তুলাই যেতে পারে। ধর্মীয় নিয়মের বিষয়টি বাদ দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিলেও এ উদ্যোগ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তুলা যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে হজ করতে গেলে একজন হাজির দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাগে। স্বচ্ছলতা নেই এমন একজন মানুষকে ধর্মীয় অনুভূতির টোপে ফেলে এতো বিপুল অর্থের ঋণে জর্জরিত করে তাঁকে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অমানবিকও বটে।

দেশের সার্বিক অবস্থা, ধর্মীয় নিয়ম, সর্বোপরি জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় এনে এ ধরণের উদ্যোগের বিষয়ে বিতর্কের যথেষ্ট সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। ---------------------------------------------------------------------------------- Related Link (Click This Link)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।