হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
ওমর খৈয়ামের পক্ষ বিপক্ষঃ এই সিরিজের আগের পর্বটি যারা পড়েছেন তারা আরব ভূখন্ডের সর্বশেষ বড় মাপের দার্শনিক/বিজ্ঞানী ওমর খৈয়ামের ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে জেনেছেন। সেই সাথে তার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি সম্বন্ধেও ধারণা পেয়েছেন। ঠিক ভাবে বলতে গেলে ওমর খৈয়ামের সত্যিকারের বন্ধু তার সময়টায় কেউ ছিল না, খৈয়াম নিঃসন্দেহে ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন ব্যক্তিত্ব। তার সময়ের ক্ষয় শুরু হওয়া আরব সমাজে তাকে ঠিক মত বোঝা বা মাথায় তুলে রাখার মতো লোকের সংখ্যা কমই ছিল। তারপরও ঠিক ঐ সময়টাতে ওমর খৈয়ামের মত ব্যক্তিত্ব এবং তার কিছু সহকর্মীর নিরলস বিজ্ঞান সাধনা আরব ভূখন্ডে জ্ঞান বিজ্ঞানের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য একটা সেতুবন্ধ হিসাবে ঠিকই কাজ করতে পারত।
সেই সুযোগ তৈরিও হয়েছিল সাচুক তুর্কিশ সুলতান মালিক শাহ'এর অপেক্ষাকৃত সেকুলার শাসন ব্যবস্থা এবং তাঁর বিদ্যানুরাগী মন্ত্রী নিজামুল মুলকএর সহযোগিতায়। ওমর খৈয়ামের মনীষা সঠিক খবর না রাখলেও এই দুইজন খৈয়াম এবং তৎকালীন আরো অনেক জ্ঞানপিপাষুকেই পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।
অন্যদিকে খৈয়ামের বিপক্ষ শক্তি তখন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তার বিপক্ষ শক্তিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়, এই দুই ভাগই ছিল তৎকালীন মুসলিম জগতের দুই প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠী, কট্টরপন্থী সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠী এবং মৌলবাদী সিয়া ইসমাইলিয়া গোষ্ঠী। ইসমাইলিয়া হাসাসিনদের হাতে নিজামুল মুলকএর মৃত্যু (৭ ও ৮ পর্বে বিস্তারিত) এবং এর মাত্র একমাস পরই মালিক শাহ এর মৃত্যুতে তিনি অভিভাবক হন।
ওমর খৈয়ামের বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণটা তাই আসে ইসমাইলিয়াদের পক্ষ থেকেই। এরপরই তাকে পরতে হয় সুন্নি মৌলবাদীদের ক্ষোভের মুখে। ইনকুইজিশন এড়াতে হজ্জ করতে বাধ্য হন তিনি। পরিস্থিতি শান্ত হলে যখন নিশাপুরে ফিরে আসেন আরব ভূখন্ডের চেহারাই তখন পালটে গেছে। জীবনের শেষ বছর গুলোতে তার আশেপাশে জমা হওয়া অল্প কিছু ছাত্রকে ইবনে সিনার দর্শন আর গণিত শিক্ষা দিতে দিতে ১১৩১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি দেহত্যাগ করে বিশ্বমানবতার প্রতিরূপ হিসাবে অমরত্ব লাভ করেন।
ওমর খৈয়াম পরবর্তী সময় এবং মহাপতনঃ ওমর খৈয়ামের মৃত্যুর পরবর্তী সময়টাতেই শুরু হয় আরবদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় মহাপতন। ওমর খৈয়াম, আল গাজালি এবং হাসান ইবনে সাবা একসূত্রে গাথা পরেছে ১১ শতকের আগে পরের সময়টায়। এই ঘটনাবহুল সময়ের শেষ হয় এক নিদারুণ ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে। ওমর খৈয়ামের পরবর্তী সময়টায় গাজালি ইসলামী জ্ঞানচর্চায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ইবনে সিনা, আল ফারাবির সময়ে মৌলবাদীরা দর্শন এবং দার্শনিক বিরোধিতায় সুবিধা না করতে পারলেও গাজালির দার্শনিক বিরোধিতা এবং যুক্তির মাধ্যমে যুক্তির বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায় রক্ষনশীলদের দার্শনিক বিরোধিতার মূল হাতিয়ার।
কয়েক দশকের মধ্যে সিনা, ফারাবি, রাজির দর্শন তিরোহিত হয় ইসলামি শিক্ষালয়গুলো থেকে, ধর্মবিরোধীতার অভিযোগে। দর্শন, গণিত, অধিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জায়গা দখল করে নেয় শাফি ও হাম্বলি ধর্মতত্ত্ব। যার ধারাবাহিকতায় ১৪ শতকে পুরো বিদ্যায়তনটাকেই দখল করে নেয় নব্য হাম্বলিবাদ। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ইসলামের জায়গা দখল করে নেয় সুফিবাদ, বিশেষ করে তুর্কি, ইরান এবং ভারতবর্ষে। এই মহাপতনের প্রকৃত চেহারা খৈয়াম এবং গাজালির পরবর্তী প্রজন্মের দুইজন ব্যক্তি সম্পর্কে সামান্য আলোচনা ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
এদের একজনকে বলা হয় গাজালির যোগ্য উত্তরসুরি, তিনি হলেন, ফখরউদ্দিন আল-রাজি (১১৪৯-১২০৯) এবং বড়পীর হিসাবে পরিচিত আবদুল কাদের জিলানি। ফখরউদ্দিন আল-রাজি গাজালির মতই শাফি ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এবং আবদুল কাদের জিলানি উঠতি সুফিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেন।
গাজালির মতোই দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, সুফিবাদ এহেন বহু পরস্পরবিরোধী বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছিল ফখরউদ্দিন রাজির চিন্তা এবং কর্মে। তবে দিনশেষে তিনি ছিলেন একজন পুরো মাত্রার আশারিয়াবাদী এবং গাজালির মতোই প্রবল ভাবে মুসলমান দার্শনিকদের বুদ্ধিবাদের বিরোধিতা করেন তিনি। গাজালির মতোই তিনি রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্বের প্রতি করে গেছেন অকুণ্ঠ সমর্থন।
আর এ কারণেই পরবর্তী প্রজন্মের ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও অধিবিদ্যায় গাজালির ঠিক পাশেই অবস্থান করে নেন ফখরউদ্দিন আল-রাজি। এসময়ের মুসলিম বিদ্যাশিক্ষায় অধিবিদ্যা আর দর্শনের যে ব্যবহার শুরু হয় তা ছিল শাফি ধর্মতত্ত্বের পক্ষে যুক্তির পক্ষে দর্শন ও অধিবিদ্যার ব্যবহার। ইনকোয়ারি বা জিজ্ঞাসু মনোভাব যা ছিল মুতাজিলাদের সময় থেকে মুক্তবুদ্ধিচর্চার পতাকাবাহী দার্শনিকদের মূল হাতিয়ার, তা নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুড়। যুক্তির ব্যবহার টিকে থাকে শুধুই বিশ্বাসের সমর্থন দেয়ার জন্য। যার ফলশ্রুতিতে যুক্তি জিনিসটাই একসময় হারিয়ে ফেলে এর প্রকৃত অর্থ।
ইসলামী বিদ্যা শিক্ষায় এহেন অবস্থার যখন সূত্রপাত সাধারণ মানুষের মাঝে তখন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সুফিবাদ। তৎকালীন দ্বিধাবিভক্ত এবং বিভ্রান্ত গনমানুষের মাঝে অপেক্ষাকৃত মানবতাবাদী সুফি'রা কিছুটা হলেও শান্তি এবং মুক্তির সুবাতাশ বয়ে আনতে সক্ষম হন, যদিও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পুনর্জাগরণে বেশিরভাগ সুফির জীবন বিরাগী দর্শন কোন ভুমিকা রাখতে পারেনি। জুনায়েদ, বায়েজিদ, হাল্লাজ, শিবলির পথ ধরে এসে হাজির হন আবদুল কাদের জিলানি (১০৭৭-১১৬৬) এবং পরিণত হন তার সময়ের আরব ভূখন্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ হিসাবে। আল গাজালি চেষ্টা করেছিলেন সুফিবাদকে ইসলামে সম্মানজনক স্থান দেয়ার। কিন্তু রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং জন বিচ্ছিন্নতার কারণে এই চেষ্টায় তিনি খুব একটা সফল ছিলেন না।
কিন্তু এই কাজে পুরোপুরি সফলতা পান আবদুল কাদের জিলানি, সুফিবাদকে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেন তিনি। জিলানির মতাদর্শ প্রচারের কেন্দ্র ছিল বাগদাদ। বাগদাদ তখন ইসলামী দুনিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ শহর, যদিও আগের জৌলুস তার অনেকখানিই হারিয়েছে। জিলানির সময়কালে ক্রুসেডাররা হামলা চালায় আরব ভুখন্ডে। ভুমধ্যসাগর তীরবর্তি শহরগুলোর অনেক শরণার্থী তখন আশ্রয় নিয়েছে বাগদাদ এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে।
জনগণের এহেন দুরবস্থা সত্ত্বেও এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অবস্থায় তখন ছিল না ইসমাইলিয়া-সুন্নি বিরোধীতায় বিভক্ত এবং অন্তর্দন্দে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম শাসক গোষ্ঠী। বিভ্রান্ত জনগণের মাঝে এসময় মুক্তির আশ্বাস নিয়ে আসেন আবদুল কাদের জিলানি। জিলানি ছিলেন একজন কারিসমাটিক ব্যক্তিত্ব, বাগ্নি হিসাবে খ্যাতি ছিল তার। খুব দ্রুতই তার নাম ডাক ছড়িয়ে পরে চারদিকে। রাজনৈতিক মুক্তির বদলে তার আধ্যাত্মিক মুক্তির ধারণা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কঠোর শরিয়তি জীবন ব্যাবস্থার চেয়ে তিনি গুরুত্ব দেন উচ্চতর আধ্যাত্মিক জীবনের। এক্ষেত্রে রক্ষণশীল সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে তার বিরোধিতার সূত্রপাত হলেও জনপ্রিয় এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস কেউ পায় নাই। সুফিবাদ কখনই ভিন্ন মতের প্রতি আক্রমনাত্বক না হলেও এবং জিলানি কখনো সরাসরি দার্শনিকদের বিরোধিতা না করলেও জিলানির মতবাদ বস্তুবাদী দর্শন চর্চার বিরুদ্ধে গনমানুষের মাঝে বেশ কিছু ধারণা তুলে ধরতে সমর্থ হয়। "ফুতুহ আল গায়েব" নামক জিলানির ৮০টি ভাষনের সংকলনে দেখা যায় জিলানি তৎকালীন সমাজের অবক্ষয় ও অস্থিরতার জন্য দায়ী করেছেন বস্তুবাদী জীবনাদর্শকে। তিনি দাবি করেন, তৎকালীন মুসলিম সমাজ আধ্যাত্মিক জীবনাদর্শের চেয়ে বস্তুবাদী জীবনাদর্শের প্রতি আস্থা রাখাতেই অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
একদিকে যেখানে ফখরউদ্দিন রাজি এবং তার গোষ্টির লোকজন ইসলামী বিদ্যায়তন থেকে ঝেড়ে পুঁছে বিদায় করছিল দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চা ঠিক সেই একই সময়ে জনসাধারণকে লৌকিক আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস, এবং লৌকিক জ্ঞানচর্চা করতে নিরুৎসাহিত করছিলেন জিলানি এবং তার অনুসারিরা। আরব ভুখন্ডের পরবর্তী ইতিহাস এরই ধারাবাহিকতা।
আরব ভুখন্ডে দর্শন আর বিজ্ঞান চর্চার সমাপ্তি এর পর থেকেই। পরবর্তিতে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রচেষ্টা ছাড়া বড় কোন জাগরণ দেখা যায় নাই আর একবারও। তবে আরব ভুখন্ডে যখন জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কাল পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে স্পেনের মুসলিম ভূখন্ডে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা তখন পার করছে মধ্য দুপুর।
আগামী পর্ব থেকে স্পেনে মুসলমানদের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হবে।
(চলবে)
[এই লেখাটা বহু আগেই লিখেছিলাম। পর্ব-৯ দেয়ার কয়েকদিন পরে দেব বলে ভেবেছিলাম। হার্ডডিস্ক ক্রাশ করায় আর পোস্ট করতে পারিনি। একি জিনিস দুইবার লেখা খুবি কষ্টকর।
ডেডলক শুরু হয়েছিল তারপর থেকেই। অবশেষে মুক্তি পেলাম। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।