আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বর্ষায় বগালেক ও কেওক্রাডাং: পর্ব ২ (বগা লেকের পথে পথে)

বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...

৯ জুলাই ২০১০ ‘মামারা উঠে যান, আপনাদের গাইড চলে এসেছে’, হোটেল মালিকের ডাকাডাকিতে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। গাইডকে বগা লেক যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করতে বলে আমরা রেডি হয়ে নিলাম। এখানে একটু বলে রাখা দরকার বগা লেক যাওয়ার দু’টো পথ রয়েছে। একটি গাড়িতে যাওয়ার পথ। এ পথে হেঁটেও যাওয়া যাবে।

হেঁটে যেতে সময় লাগবে কিন্তু ঝুঁকিহীন পথ। আরেকটি হচ্ছে ঝিলের পথ। এ পথে গেলে সময় কম লাগবে আর বোনাস হিসেবে পাবেন রুমা খাল আর ঝর্নার মনোরম সৌন্দর্য। তবে পথ কিছুটা দুর্গম। অন্তত: বর্ষাকালে তো বটেই।

আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে বগা লেক যাবো। রওয়ানা হওয়ার আগে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে নিজেদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে আসলাম। বগা লেক যেতে হলে গাইড ঠিক করা ও সেনাবাহিনীর কাছে নাম রেজিস্টার করা বাধ্যতামূলক। আমরা সবাই কাঁধে একটা করে ব্যাগপ্যাক নিলাম। ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন পানির বোতল, গ্লুকোজের বোতল, স্যালাইন, ব্যান্ডেজ, স্যাভলন, ঔষধ, হালকা খাবার ইত্যাদি।

গায়ে ‘অডোমস’ মেখে নিয়েছিলাম। কারন এ অভিযানের সবচেয়ে বড় আতংকের নাম ছিলো মশা আর জোঁক। অডোমস মশা থেকে সুরক্ষা দেয়। এ মৌসুমে মশার কামড় ম্যালেরিয়া বাধিয়ে দিতে পারে। জোঁক প্রতিরোধের জন্য ছিলো লবণ।

পায়ে পড়েছিলাম রবারের জুতো। রুমা বাজারে রবারের জুতো কিনতে পাওয়া যায়। দাম একশো থেকে দেড়শো টাকা। প্রথম দিকে আমরা উঁচু পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। একটু পর আবার ঢালু নামার পথ।

এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর পেলাম প্রথম ঝিল। বগা লেকে যাওয়ার পথে আমাদের প্রায় পঞ্চাশবারেরও বেশি ঝিলপথ পাড়ি দিতে হয়েছিলো। এ ঝিল মূলত রুমা খাল ও বগা মুখের অংশ। পথে অরো পেয়েছিলাম শীতল পানির অনেকগুলো ঝর্ণা। ঝর্ণাগুলো থেকে আমরা খাবার পানি ভরে নিতাম।

টানা দুই ঘন্টা কখনও উঁচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তা, কখনও ঝোঁপঝাড়, পিচ্ছিল পথ আর ঝিল পেরিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটা ছোট্ট দোকান পেলাম। মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার রওয়ানা হলাম। এভাবে আরো চার ঘন্টা হাঁটলাম। টানা হাঁটায় আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলাম। আমাদের তেমন কষ্টও হয়নি।

কারন বেশিরভাগ সমতল পথ আর ঝিলের রাস্তা। তবে ঝিল পার হওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হয়। নিচের পাথরগুলো পিচ্ছিল হওয়ায় পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। আমাদের মধ্যে একজন পড়ে গিয়ে পায়ে চোটও পেলো। তবে হেঁটে না আসলে বগা লেকের আসার মজাটাই পেতাম না।

এ আসার পথে আপনি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাবেন। সামনের বগা লেক আর কেওক্রাডাংয়ের সৌন্দর্যের কথা না হয় বাদই দিলাম। সব মিলিয়ে ছয় ঘন্টা হাঁটার পর আমরা একটা ঝর্ণার কাছে চলে এলাম। এর মধ্যে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। কিওক্রাডাং যাওয়ার পথে পুরোটা পথ জুড়ে বৃষ্টি বাগড়া বাধিয়েছে।

ঝর্ণার কাছে এসে কোন পথে যাবো বুঝতে পারলামনা। গাইড আমাদের যে পথটা দেখালো তা দেখে ভয়ের একটা শীতল স্রোত আমার শীরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো। যে পাশ থেকে ঝর্নার পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার দিকে উপরে আমাদের হাঁটতে হবে। পুরোটাই পাথুরে পথ আর পিচ্ছিল। গাইড বললো যেখানে যেখানে আপনাদের পা রাখতে বলবো সেখানে সেখানে পা ফেলবেন।

প্রায় দশমিনিট ধরে আমরা উঠে গেলাম। কীভাবে উঠেছিলাম আমার জানা নেই। তবে আমরা সবাই বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গাইড জানালো শীতকালে পথটা এত পিচ্ছিল থাকেনা। মোটামুটি সহজেই ওঠা যায়।

এভাবে আরো দুই ঘন্টা আমাদের উপরের দিকে উঠতে হয়েছে। আমাদের অভিযানের শেষ দু’ঘন্টাই ছিলো অনেক কষ্টের আর কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ । প্রায় সতেরো কিলো আর আট ঘন্টা হাঁটার পর কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছালাম। আহ! বগা লেক। দেখেই মন জুড়িয়ে গেলো।

না বগা লেক দেখে না। গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি তাই। তখন আমাদের শরীরে এতটুকুন শক্তি অবশিষ্ট নেই। পা গুলো ভীষণ ভারী মনে হচ্ছিলো। আমরা উঠলাম লারাম রেস্ট হাউজে।

গাইডকে খাবার দিতে বলে আমরা নেমে পড়লাম লেকে। গোসল সেরেই খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমরা খাওয়া দাওয়া করেছিলাম সিয়াম দিদির রেস্ট হাউজে। খাবারের মেনুতে ছিলো মোটা লাল চালের ভাত, ডাল, ডিম ভাজা আর এক রকমের পাহাড়ি শাক। একেকজন গোগ্রাসে খেলাম।

এমন অমৃত খাবার আর কোনদিন খাইনি বলে মনে হলো। মজার বিষয় রাতে ঠিক একই ধরনের খাবার আমাদের মুখে দিতেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমরা একটা ভুল করেছিলাম। বগা লেকে একই রেস্ট হাউজে থাকা-খাওয়া করলে খরচ অনেক কম পড়ে। আমরা সেটা করিনি।

খাওয়া দাওয়া শেষে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম আমাদের উপস্থিতি জানান দিতে। এরপর সন্ধ্যা অবধি ঘুরে বেড়ালাম আর উপভোগ করলাম বগা লেকের পাগল করা রূপ। সঙ্গে চলতে থাকলো ফটোশেসন। বগা লেকের আয়তন প্রায় ১৫ একর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ২৭০০ ফুট।

এ লেক নিয়ে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস এ লেকের মাঝে ড্রাগন দেবতা বাস করে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন প্রায় দুই হাজার বছর আগে সৃষ্ট এ স্বচ্ছ জলের মনোরম সরোবরটি মূলত মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। এপ্রিল-মে মাসে লেকের পানি প্রাকৃতিকভাবে ঘোলাটে হয়ে যায় যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও কৌতুহল রয়েছে। জোছনা স্নাত রাতে বগা লেক রহস্যময় নৈসর্গিক রূপ লাভ করে বলে অধিবাসীরা জানান।

এখানকার অধিবাসীরা ব্যোম উপজাতি। বগা লেকের বেশিরভাগ বাড়িই কাঠের তৈরি। রাতে আবারো নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। পরদিন সকালে আমাদের কিওক্রাডাং যাওয়ার পরিকল্পনা। বৃষ্টির রূপ দেখে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম সকালে এ আবহাওয়া থাকলে এখানেই অভিযানের সমাপ্তি টানবো।

কার্ড খেলে আর গল্প করে সময় কাটাতে লাগলাম। কিন্তু সময় যেন কাটছেই না... (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।