আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বর্ষায়

(....আকাশে তখন বৃষ্টি নেই। মেঘ ভার করে আছে। ঝির ঝির বাতাস। বৃষ্টির পানিতে চারদিকে ধুয়ে সবুজ চকচক করছে। নদীর পানিতে দুলতে দুলতে আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছি।

সবার মুখে হাসি আর ভিতরে উত্তেজনা। কী অদ্ভুদ অনুভূতি!....) অনেক ছোটবেলার কথা। ভাসা ভাসা মনে আছে। সোনার গাঁয় নানার বাড়ি যাচ্ছিলাম। তখন বর্ষাকাল।

কেওঢালা গিয়ে দেখা গেল বন্যায় রাস্তা ডুবে গেছে। যেতে হবে নৌকায়। নৌকায় রওয়ানা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ভারি বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া। বর্ষার ভরা নদী। একেকবার বাতাসের ঝাপটায় নৌকা যেন আকাশের দিকে উঠছে আবার নামার সময় মনে হচ্ছে যেন সোজা গিয়ে পানির ভিতর ডুবে যাবে।

আমি পরিবারের অন্যদের সাথে নৌকার ছাউনির ভিতরে ছিলাম। মাঝি ছাউনির দুই দিকের খোলা অংশটুকু প্লাসিকের পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। বাইরে থেকে বৃদ্ধ মাঝি বৈঠা দিচ্ছে আর জোরে জোরে দোয়া পড়ছে। বলছে, ‘সকলে আল্লাহ্রে ডাকেন, আল্লাহ্রে ডাকেন। ’ বর্ষা আসলেই এই ঘটনাটি আমার মনে পড়বে।

ঘটনার সময় খুব ভয় পেয়েছিলাম। এ্যাডভেঞ্চার বলতে যদি বোঝানো হয় গা ছমছমে অনুভূতি, তাহলে ঘটনাটি এখন মনে পড়লে সেরকম বোধ করি। প্রতি বর্ষাতেই মনে হয় যে এরকম একটা ট্রিপ দেয়া দরকার। আর দেয়া হয় না। না হওয়ার পেছনে কারণ আছে।

এখন গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নত হয়ে গেছে। বাঁধ দিয়ে তৈরি উঁচু রাস্তা দিয়ে বর্ষার সময়ও গাড়ি চলাচল করে। কেউ এখন নৌকার খোঁজ করে না। সেই ঘাট নেই, নৌকা নেই, মাঝিও নেই। এক বর্ষায়, তখন মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি।

অফুরন্ত সময়, কোন টেনশন নেই, মনে ফুরফুরে ভাব। দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল, এরকম বর্ষায় ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। বৃষ্টির মধ্যে কোন ভরা নদীতে গিয়ে নৌকা নিয়ে ঘোরঘুরি করা দরকার। আমার একদল জুনিয়ার ফ্রেন্ড আছে (এরা সবাই আমার ভাইয়ের মত আপনজন)।

ওদের গিয়ে বললাম, ‘ এমন দিনে ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। নৌকা নিয়ে কোন নদীতে ঘুরতে যাওয়া উচিত। ’ ঘোরাঘুরির ব্যপারে তাদের বিরাট উৎসাহ। বলার সাথে সাথে সবাই রেডি হয়ে গেল। বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য সবার হাতে একটা করে ছাতা।

শুধু শাওনের হাতে কোন ছাতা নেই। এসব বৃষ্টিতে-টৃষ্টিতে তার কিছু হয় না। শাওন হচ্ছে পাহাড়ের মত একটা ছেলে। রেসলারদের মত বল্ডি বিল্ডিং করা শরীর। তার গায়ে ছিল শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি।

সবাই শুধু তার দিকে ঘুরে ঘুর তাকাচ্ছিল। তাকানোর মতই একটা বডি সে বানিয়েছে। শাওন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টির মধ্যে ছিল। সে একটা হাঁচি পর্যন্ত দেয় নি। সবাই মিলে কাইক্যার টেক, ব্রহ্মপুত্র নদীতে গেলাম।

নদী থেকে একটা শাখা সোজা মেঘনার দিকে গিয়েছে (সম্ভবত)। দুই পাশে গ্রাম। তার মাঝখানে, নদী দিয়ে আমাদের নৌকা চলছে। খোলা নৌকার মধ্যে সবাই। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।

জেলেরা নৌকা থেকে জাল ফেলে মাছ ধরছে। ছোট ছোট ছেলেরা ভিজে কাক হয়ে তাদের বাবাকে জাল টানায় সাহায্য করছে। আমরা কখনো কোথাও ছাপড়া কোন দোকানে গরম গরম চা খাচ্ছি, কখনও আলুর চপ। নৌকার মধ্যে চলছে তুমুল হৈ চৈ। গ্রামের লোকজন উৎসুক হয়ে আমাদের দেখছে।

এরকম পাগলের দল তো আর সচরাচর দেখা যায় না। মহিলারা ফাঁক ফোঁকর থেকে উকিঝুকি দিচ্ছে। এক বয়স্ক মহিলা ঘাটে ছুটে এসে বলল, ‘এগুলি কেডায় রে?’ আমাদের মাঝখান থেকে দেলোয়ার বলল, ‘চাচি আমরা বেড়াইতে আসছি আপনাদের এলাকায়। ’ ‘বেড়াইতে আইছেন, বাড়িতে আসেন। চা-নাস্তা খাইয়া যান।

’ ‘পানি খাওয়ানো যাবে নাকি?’ ‘কত পানি খাইবেন? আসেন। ’ আমরা ঐ মহিলার ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে গেলাম পানি খেতে। টিউবওয়েল থেকে বরফের মত ঠান্ডা পানি বের হচ্ছে। আমি খেয়াল করে দেখলাম টিউবওলেটি আর্সেনিক মুক্ত। গায়ে সবুজ রঙের আঁচর।

মহিলা এর মধ্যে মিষ্টিও জোগার করে ফেলেছে। সবাইকে খেতে হবে। ঐ গ্রামটির নাম ছিল মঙ্গলের গাঁও। মুড়ি ভাজার জন্য বিখ্যাত। নারায়ণগঞ্জ শহরে মুড়ির যে সাপ্লাই হয় তার বেশিরভাগই আসে ঐসব এলাকা থেকে।

মাঝে মাঝে এই সব ঘটনা গুলো মনে পড়ে যায়। কত ঘটনা, কত গল্প, কত মানুষের কথা। এমনও মানুষ আছে যাদের সাথে জীবনে একবারই দেখা হয়েছে। আর কখনও দেখা হবেও না। অনেকের কথাও হয়ত মনে নেই।

কিংবা কোন ছবিও মনে করতে পারব না। কী বিচিত্র এই জীবন! কয়েকদিন আগের কথা। ‘মহাসেন’ ফেরত যাওয়ার পর থেকে দুই দিন ধরে তুমুল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর মধ্যেই আমার কলিগরা সবাই ধরল যে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পুরো শহর ছোটখাট বন্যায় ভাসছে।

বৃষ্টির মধ্যেই সবাইকে নিয়ে গেলাম নারায়ণগঞ্জ সাবদির ব্রহ্মপুত্র নদীতে। চমৎকার একটা নদী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং বিশাল নদী। নদীর টলটলে পানি। ঠিক হল নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরব।

আমি বললাম, ‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। ’ আমার মাথায় যে সবসময় কোন না কোন অদ্ভূদ প্ল্যান ঘোরা ফেরা করে সেই সম্পর্কে ইতিমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে। সেই প্ল্যান গুলো প্রথমে শুনতে অদ্ভূদ শোনালেও পরে খুব মজা হয়। এবারও কোন প্ল্যান থেকে মজার কিছু যে হবে সেই উত্তেজনায় সবাই একসঙ্গে বলল, ‘কী প্ল্যান?’। ‘আমরা নদীর মাঝখানে ভাসতে ভাসতে দুপুরের লাঞ্চ করব।

’ ব্যপারটা ভাবতেই সবার ভেতরে যে একটা এক্সাইটমেন্টের ঢেউ বয়ে গেল, সেটা বোঝা গেল। মেয়েরা বলল, ‘কিন্তু খাবার পাব কোথায়? খাব কিসে করে?’ আমি বললাম, ‘সেটা কোন সমস্যা না, ব্যবস্থা করা ওয়ান-টু’র ব্যপার। ’ অথচ তখন আমি নিজেও জানি না যে কিভাবে ব্যবস্থা হবে। আমার মধ্যে এই একটা ব্যপার আছে যে আমার মধ্যে যে ইচ্ছাগুলো হয় সেটা পুরণ করা কখনওই আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয় না। এবং শেষ পর্যন্তÍ হয়েও যায়।

আমি গ্রামের একটা বাজারের ঘাটে নৌকা থামিয়ে কলিগ চঞ্চলকে নিয়ে বাজারের মধ্যে একটা হোটেল খুঁজে বের করলাম। পুরো বাজারের মধ্যে ভাতের হোটেল একটাই। সেই হোটেলে আইটেম আছে - ভাত, গরুর মাংস, ডিমের ভূণা, লাউ দিয়ে মসুর ডাল। হাড়ির ঢাকনা তুলে দেখলাম গরুর মাংসের চেহারা ভয়ংকর। হলুদ-মরিচে লাল টকটক করছে।

গরুর আইটেম বাদ দিয়ে অন্যগুলো নেয়া হল। বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে সবার জন্য হোটেল প্লেট,বোউল সব নেয়া হল। দুপুরের খাবারের কমপ্লিট আয়োজন। আকাশে তখন বৃষ্টি নেই। মেঘ ভার করে আছে।

ঝির ঝির বাতাস। বৃষ্টির পানিতে চারদিকে ধুয়ে সবুজ চকচক করছে। নদীর পানিতে দুলতে দুলতে আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছি। সবার মুখে হাসি আর ভিতরে উত্তেজনা। কী অদ্ভুদ অনুভূতি! আমি বললাম, ‘মনে হয় কিছুটা ঝাল হলে ভাল হত।

’ মাঝি বলল, ‘মইছ আছে তো। এই যে মইছের (মরিচ)ক্ষ্যাত, এগুলি আমগই। ’ নদীর পাড় ঘেষে লাগানো এক মরিচের ক্ষেত থেকে মরিচ তুলে এনে নদীর পানিতে ধুয়ে দিল। সবার হাতে একটা করে মরিচ, ঝালে চোখে পানি আর মুখে হাসি। ওহ্! কী আনন্দময় বর্ষা ভ্রমণ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।