আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাঁচের বাক্সে জীবন আর কতগুলো হিসাব-নিকাশ

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

ওখানে আমার প্রায়েই যেতে হয়। কিন্তু সত্যি বলছি, যেতে একেবারেই ভালো লাগে না। থাকতে হয় হয়তো একটানা ঘন্টা দু’য়েক। ওই দুই ঘন্টা আস্তে আস্তে আমার মনে চোরাগুপ্তা বিষণ্নতারা ঢুকে যায়।

প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন কাঁচের বাক্সের ভিতরের বিশজনের একজন ছিল এঞ্জেলা। প্রথম দিনের দুরু দুরু বুকে, রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম দুই স্কয়ার ফিটের ছোট্ট কাঁচের বাক্সের ভিতরে রাখা ছোট্ট এঞ্জেলাকে। ছোট্ট মানে সত্যিই ছোট্ট। প্রথম দিনই সাবধানে মেপে দেখলাম, ওর পুরা পায়ের পাতা আমার মধ্যমা আঙ্গুলের এক কড়ের সমান ছিল। যেখানে আর সবাই দিব্যি চল্লিশ সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় মায়ের পেটের ভিতর, এঞ্জেলা সেখানে মাত্র পঁচিশ সপ্তাহ পরেই বের হয়ে গেল।

তখন তো আর নি:শ্বাস নিতে পারে না, ফুসফুস ভর্তি পানি। চোখ ফুটে তাকাতে পারে না, চোখের মনি তখনও দেখার জন্য পুরাপুরি তৈরি হয় নি ওর। মুখ দিয়ে খেতে পারে না, ওর নাড়ি ভূড়ি তখনও তৈরি হয় নি দুধের জন্য। ওর ছোট্ট শরীরটাকে তখন ওই কাঁচের বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। ওর ছোট্ট নাক দিয়ে নল ঢুকানো হলো ওকে অক্সিজেন দিতে।

মুখ দিয়ে খাবারের নল ঢুকে গেল সোজাসোজি পেট পর্যন্ত। তবে ছবির বাবুটার মত ওর পায়ের নিচটা এত মসৃন ছিল না। ছোট্ট শরীরে কত শত অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছে, সে সব দেখার জন্য ওর পা থেকে রক্ত নেয়া হচ্ছে মাঝে মাঝেই। পায়ের নিচটা তাই মোরব্বার মত ঝাঝড়া হয়ে ছিল। এত সব রক্ত নেয়া, নল ঢুকানোতে বড় মানুষেরাই কেঁদে অস্থির হয়ে যায়, কিন্তু এঞ্জেলা কি সুন্দর দেবশিশুর মত ঘুমাচ্ছে! অবাক হয়ে ডক্টর কীকে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলেন কাঁচের বাক্সের উপরের ছোট্ট সিরিঞ্জগুলো।

একটায় মরফিন, আরেকটা ক্যাফেইন। প্রতিদিন ভারী ডোজের ঘুমের অষুধ দিয়ে ওকে, ওর মত আর সব শিশুগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে চব্বিশ ঘন্টা। এঞ্জেলার ছোট্ট শরীরটা থেকে শুধু রক্তই নিচ্ছিল শুধু ডাক্তাররা। কিন্তু কোন রক্ত দিতে পারছিল না। ফুসফুসের একটা জটিল অপারেশন দরকার ছিল ওর।

দরকার প্রচুর রক্ত। কিন্তু এঞ্জেলার বাবা মা জেহোভাস উইটনেস। ওরা বিশ্বাস করে মানুষের রক্তেই আত্মা থাকে। কোন মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিবে, আত্মায় মিশ্রন হয়ে যাবে! প্রতিদিন গিয়ে গিয়ে দেখতাম, ছোট্ট এঞ্জেলা আরও ছোট হচ্ছে। হাপড়ের মত ওঠা নামা করছে বুক।

ওর ছোট্ট হৃদপিন্ডটা প্রানপণে কাজ করে যাচ্ছে, ছোট্ট শরীরের অল্প রক্তগুলোই এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক করতে। এঞ্জেলার বিছানাটা খালি হয়েছিল ওর পাঁচ সপ্তাহ ছয় দিন বয়সে। ডাক্তার আর বাবা মা একমত হয়ে ওর অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে ফেলেছিল। কিন্তু রবার্টের অক্সিজেন সাপোর্ট খুলে ফেলার জন্য ওর মাকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করতে পারে নি প্রথমে ডাক্তাররা। রবার্টের মাথা ভর্তি পানি, ওর হার্টের সব রক্ত উল্টো দিকে যাচ্ছে, বেঁচে থাকলেও বিকলাঙ্গ হবে… কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।

অনেক পরে রাজি হয়েছিল ওর মা। ওর জমজ ভাই জেসন ছিল বলে রাজি হয়েছিল হয়তো। রবার্ট আর জেসনের ওদের পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী মা সন্তান ধারণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন গত দশ বছর। অনেকগুলো ভ্রুন ওঁর শরীরে বুনে দেয়া হয়েছিল গত কয়েক বছরে। কোন ভাবেই ভ্রুনগুলো থাকছিল না।

শেষ মেষ রবার্ট আর জেসন থাকল। কত অসুখ নিয়ে জন্মালো দু’জনেই, কিন্তু জেসনের রবার্টের চেয়ে কম। ওর শুধু জন্ম হয়েছে পেটের নাড়ি ভুড়ি শরীরের চামড়ার বাইরে, অপারেশন করে সেগুলোকে ভিতরে ঢুকাতে হলো। ওর ছোট্ট শরীরটা বুকে নিয়ে ওর মা কি ভীষণ খুশি! অথচ, জেসনের একেবারে পাশের বিছানার ডেভিডকে দেখুন। ডেভিডেরও জন্ম মাত্র সাতাশ সপ্তাহে।

জন্মের পর থেকে ওর ছোট্ট শরীরে কত কাঁটা ছেঁড়া, কত নল ঢুকানো, রক্ত বের করা, রক্ত ঢুকানো। কিন্তু ও তবু দিব্যি দুই মাস কাঁটিয়ে দিল হাসপাতালে। তারপর একেবারে ঝরঝরে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। বাড়ি যেতে প্রস্তুত।

কিন্তু কোন বাড়ি যাবে? ওর মায়ের তো কোন বাড়ি নেই। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, নেশা করে, আজ এর ঘরে থাকে তো কাল ওর ঘরে। এসটিডি কিলবিল করছে শরীরে। এত এত অনাচার সহ্য করতে না পেরেই তো ডেভিড বের হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। কিন্তু ও মরলো না।

ওর আগে আরও তিন ভাই বোন হয়েছে ওর মায়ের, কেউই মরে নি। কিন্তু এখন আর কারো হদিশ নেই ওর মায়ের কাছে। হাসপাতাল থেকেই সরকার নিয়ে গিয়েছিল, এদিক সেদিক সন্তানহারা মানুষের বুকে তুলে দিয়েছে হয়তো। কিন্তু ডেভিডদের কেউ নিতে চায় না। মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই তার শরীরে যত ড্রাগ গিয়েছে, ওর শরীরের ভিতরের অনেক কিছুই আর দশটা শিশুর মত নেই।

জন্মের আগে থেকেই নিজের জন্মদাত্রীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে ওর অস্তিত্বের জন্ম, ভিতরটা ভেঙেচুড়ে আছে ওর, কিন্তু যুদ্ধ করতে করতে সর্বংসহা ও, ওকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ বুঝি? তারই পাশের রেইচেল--লাল গালের গুটগুটে একটা মেয়ে। দারুণ স্বাস্থ্য, জন্ম হয়েছে একেবারে ঠিক সময়ে। কিন্তু নি:শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল বলে ওকে একটা মেশিনের সাথে লাগিয়ে দিল ডাক্তাররা। তাতে ওর পঁয়ত্রিশ বছরের মায়ের তাতে ভীষণ রাগ! মহিলা একজন নামকরা রিসার্চার। সারা জীবন ব্যর্থতার মুখ দেখেন নি।

হাসপাতালে যেভাবে আসেন গটগটিয়ে, ইস্ত্রি করা শার্ট নিপূণ ভাবে ইন করে, বুঝাই যায় না এক সপ্তাহ আগে মা হয়েছেন। তারপর বুকের উপর হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। নাকে নল দেয়া সন্তানকে তিনি ছুঁয়েও দেখতে চান না। রেইচেল ওর পারফেক্ট লাইফে বিশাল এক ইম্পারফেকশন! স্বামীর সাথে শীতল গলায় ঝগড়া করে যান সন্তান সংক্রান্ত এই অনাহূত ঝামেলা। স্বামী বেচারা অপরাধী মুখে মাথা নিচু করে বসে থাকে।

আমি ডেভিডের মাথায় পাতলা চুলগুলো আস্তে আস্তে এলোমেলো করে দেই, রেইচেলের তুলতুলে মুঠিতে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেই। কাঁচের বাক্সের যান্ত্রিক উত্তাপের মাঝে আমার মানবীয় উষ্ণতা দিয়ে ওদের এই অদ্ভূত পৃথিবীতে অনাহূত আগমনকে স্বাগতম জানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।