আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনস্বার্থে মামলা এবং সাংবাদিকতা: অধিকারের প্রহরী

গল্প লিখতে ভালোবাসি

এক. ২১ মে ২০১০। ১০১টি দোররা মারা হলো এক তরুনীকে। ঘটনা ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার। পরদিন প্রথম আলো সে সংবাদ পৌঁছে দিল সারাদেশে। সে সংবাদ ঝড় তুললো তিন আইনজীবীর হৃদয়ে।

ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক, এডভোকেট কে এম হাফিজুল আলম এবং ব্যারিস্টার এম ইমরানুল হাই প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি নজড়ে আনলেন হাইকোর্টের। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর শুনানী শেষে রুল ইস্যু করেন। ইসলামি শরীয়া বা ফতোয়ার নামে বিচার বহির্ভূত শাস্তি কেন অবৈধ ঘোষনা করা হবেনা তার কারণ জানাতে এই রুল ইস্যু করা হয়। তাছাড়া বিচার বহির্ভূত শাস্তি নিরুৎসাহিত করতে পাঠ্য পুস্তকে এই সর্ম্পকিত শিক্ষা উপকরণ বা প্রবন্ধ কেন অন্তর্ভূক্ত করা হবেনা-তারও কারণ জানাতে বলে হাইকোর্ট। তাৎক্ষনিক কিছু ব্যবস্হাও নেন আদালত।

ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার জেলা প্রশাসককে ঘটনা তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ভিকটিম নারীকে আদালতে হাজির করতে বলেন। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের জন্য কিছু আচরণবিধিও দেয়া হলো আদালতের তরফে। ষ্পস্ট বলা হলো গণমাধ্যম যেন ভিকটিমের ছবি বা নাম ঠিকানা প্রকাশ না করে। এ মামলায় আদালতের বিভিন্ন ফিসও জমা দিতে হয়নি আইনজীবীদের।

হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চই এসবের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। একটি অধিকার হারানোর খবর প্রকাশ করে এতোগুলো প্রতিকারের পথ করে দিয়েছে একটি সংবাদপত্র। আরো ষ্পষ্ট করে বললে, বলতে হয় একজন সাংবাদিক । এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি উচ্চ আদালতে যতগুলো জনস্বার্থে মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই দায়ের করা হয়েছে কোন না কোন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে।

উদাহরণ হিসেবে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশের একটি মামলার কথা বলা যায়। গাড়ী রিক্যুইজিশনের ক্ষমতা দেয়া ডিএমপি আধ্যাদেশ কেন বাতিল হবেনা –তা জানাতে সম্প্রতি রুল ইস্যু করে হাইকোর্ট। মামলাটি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ভিত্তি করে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয় অধ্যাদেশের অপব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি জনস্বার্থে যত মামলা বা রিট হয়েছে তার আধিকাংশই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ভিত্তি করে, একথা আগেই বলা হয়েছে।

এক্ষেত্রে সাংবাদিক দুটি আইনী কাজ একসঙ্গে করছেন। প্রথমত, মানুষের জানার অধিকার রক্ষা করছেন। আর অপরটি হলো অধিকার হারানোর প্রতিকার পাবার পথ করে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের সহযোগি হিসেবেই বিবেচনা করা যায় গণমাধ্যমকে। অবশ্য দুর্নীতি-অনিয়ম প্রকাশ করে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশী সহায়তা করে নির্বাহী বিভাগকে।

তবে, গণতন্ত্রের সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যম বিচার বিভাগের বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশেও কুন্ঠাবোধ করেনি। সংবাদ প্রকাশ করে আদালত অবমাননার মামলায় জড়িয়ে পড়ার নজিরও এদেশের সংবাদপত্রের রয়েছে। জনস্বার্থমূলক মামলা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজটি সাংবাদিকরা নতুন করছেন এমন নয়। ক্ষেত্র প্রস্তুতের পাশাপাশি সাংবাদিক নিজেই মামলা করেছেন এমন ঘটনাও আছে। একটি গুরুতর অনিয়ম খুঁজে বের করে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেয়া মানেই দায়িত্ব শেষ, এমনটা একজন সাংবাদিক নাও মানতে পারেন।

দুর্নীতির খবর তুলে এনে প্রতিকার পেতে আদালতে যাবার একটা ঘটনা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। সেটি হলো, সৈয়দ বোরহান কবীর বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য (রিট আবেদন নং ৭০১/১৯৯৩)। ১৯৯২ সালে বোরহান কবীরের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হয় আজকের কাগজে। বিষয় বস্তু প্যারাসিটামল সিরাপে বিষাক্ত পদার্থ। শিশু হাসপাতালের একজন চিকীৎসককে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেখান, বেশী মুনাফার লোভে বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানী ডাইইথিলিন গ্লাইকল নামে বিষাক্ত উপাদান প্যারাসিটামলে মিশিয়ে বিক্রি করছে।

আর এতে বিপন্ন হতে বসে ছিলো হাজার হাজার শিশুর জীবন। সৈয়দ বোরহান কবীর শুধু রিপোর্ট করেই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেননি। তিনি এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জনস্বার্থে মামলা করেন হাইকোর্টে। হাইকোর্ট সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছিলেন। তবে, এ পর্যন্ত জনস্বার্থমূলক মামলায় সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পেরেছেন।

টিভি সংবাদ এ ক্ষেত্রে তেমন একটা ভূমিকার রাখতে পারেনি। দুই. যে জনস্বার্থমূলক মামলায় সাংবাদিকদের এতো ভূমিকার কথা বলা হলো এতোক্ষণ, সে মামলার বিষয়ে এবার কিছু বলা যাক। জনস্বার্থমূলক মামলা শব্দটি ইংরেজি পাবলিক ইন্টারেষ্ট লিটিগেশন এর অনুবাদ। সংক্ষেপে এই মামলাকে বলে পিআইএল। সাধারণত মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিকারের জন্য আদালতের কাছে যান।

কিন্তু জনস্বার্থমূলক মামলায় অনেকের একজন মামলাটি করেন। এক্ষেত্রে মামলা করার অধিকার বা লোকাস স্ট্যান্ডাই থাকতে হয়। নানা বিধিবিধান ও নজিরের কারণে বাংলাদেশের উচ্চ আদলতের বিচারপতিরা দীর্ঘদিন লোকাস ষ্ট্যান্ডাই বা সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রক্ষনশীল মনোভাব পোষন করেছেন। জনস্বার্থমূলক মামলার ক্ষেত্রে এটি একটি বাঁধা ছিলো। যাহোক, কাজী মুখলেসুর রহমান বনাম বাংলাদেশ মামলায়, বাংলাদেশে প্রথম সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তির প্রশ্নটি উত্থাপিত এবং পরীক্ষিত হয়।

এটি বেরুবাড়ি মামলা নামেও পরিচিত। তবে সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে আপীল বিভাগ থেকে ড. মোহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ বা ফ্যাপ-২০ মামলায়। রায়ে বলা হয়, কোন সংক্ষুব্ধ ব্যাক্তি বলতে ব্যাক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তিকে বোঝায়না। বরং এটা জনসাধারন পর্যন্ত বিস্তৃত, অর্থাৎ সমষ্ঠিগত বা জোটবদ্ধ ব্যাক্তিত্বকেও বোঝায়। যদি কোন আবেদনকারী সৎ উদ্দেশ্যে ও জনস্বার্থে জনগনের কোন দাবি উত্থাপন করেন, তাহলে তিনি আদালত কর্তৃক তার শুনানি গ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করেন।

এই মামলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে জনস্বার্থমূলক মামলা বা পিআইএল এর আনুষ্ঠানিক বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতি মেলে এবং একটি সুসংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারা গড়ে ওঠে। জনস্বার্থমূলক মামলার বিকাশে ড. মোহিউদ্দিন ফারুকের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশে পিআইএল অপেক্ষাকৃত নতুন একটি ধারা। উপমহাদেশে জনস্বার্থমূলক মামলায় অগ্রনী দেশ হলো ভারত। ১৯৮০’র শুরু থেকে Krishno আয়ার ও ভগবতী’র মতো দুরদর্শী ও সমাজ সংস্কারক বিচারপতিদের ভূমিকার কারণে ভারতে পিআইএলের প্রসার ঘটে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ব্যাক্তির সমবেত চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনস্বার্থমূলক মামলার ধারণার সূত্রপাত হয়। তিন. নিরক্ষর, অসচেতন, দুস্হদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া যদি লক্ষ্য হয় তবে বিচার বিভাগ এবং সাংবাদিকদের লক্ষ্য এক, একথা বলা যায়। তবে এক্ষেত্রে কাজের ধরণ ভিন্ন। সাংবাদিক কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করতে পারেননা। জনতাকে ক্রমাগত জানিয়ে সচেতন করে, তিনি কেবল জনমত তৈরী করতে পারেন।

গণতন্ত্রে যেহেতু অধিকাংশের মতামতেই সব হয়. এমনকী সরকার পরিবর্তন বা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ পর্যন্ত। তাই গণতন্ত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলও একটি দেশের সামগ্রিক অবস্হা সম্পর্কে জানতে পারে। আর বিশ্বায়নের এসময়ে, তথ্যের অবাধ প্রবাহের এসময়ে জনমত নির্বাহী বিভাগকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত, কখনো কখনো বাধ্য করতে পারে। বিচার বিভাগের বাধ্য করার ক্ষমতা রয়েছে।

অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কাজ করবেন না বলে বিচারপতিরা শপথ নেন কাজ শুরুর আগেই। কাজেই তাঁরা যখন কারো অধিকার ফিরিয়ে দেবার কাজ করেন, তখন তা করেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যেই । এখন, জনস্বার্থমূলক মামলায় দেয়া নিদের্শনা বা রায় বাস্তবায়নে সরকার যদি ব্যার্থ হয় কোন কারনে, কিংবা যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় লাগে রায় বাস্তবায়নে, সেক্ষেত্রে সাংবাদিকের ভূমিকা কী হতে পারে? সাংবাদিক নিজে যেহেতু কোন প্রতিকার দিতে পারেননা, তিনি বিলম্ব বা ব্যর্থতা প্রকাশ করে দিতে পারেন। বারবার । এতে বিচার বিভাগের জানা হবে যে তাদের রায় বাস্তবায়িত হয়নি।

তখন অবমাননার আভিযোগ এনে বা নতুন করে ডেকে নিয়ে ঘটনার একটি মীমাংসা আদালত করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, নির্বাহী বিভাগ উদ্যোগী হয়ে, দ্রুত সেটি বাস্তাবায়ন করতে পারে। প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়েই এক্ষেত্রে সাংবাদিকের দায়িত্ব শেষ হলো-বলা যায়। এতে কেউ কেউ মনে করতে পারেন সাংবাদিক বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন। বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিলে ভালো।

কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল যে সাংবাদিকের ওপর বিরুপ-ভাজন হবেন না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। তখন তিনি সাংবাদিকের কর্মতৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির মনে করেন গনমাধ্যম কাজ করে জাতির বিবেক হিসেবে। কাজেই জনস্বার্থমূলক মামলায় আদালতের দেয়া রায় নির্বাহী বিভাগ বাস্তবায়ন করলো কীনা তা পর্যবেক্ষন করবে সাংবাদিকরা এটা স্বাভাবিক। তবে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকলে, জনস্বার্থমূলক মামলার নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিষয়ে আদালত প্রতিবেদকদের ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ছাড়া অন্যকোন ভূমিকা রাখার সুযোগ বন্ধ হয়ে আসবে।

একথা অবশ্য বলা যায় অংকের হিসাব না কষেই। প্রথম প্রকাশ..মিডিয়া ওয়াচ..জুন ২০১০ @আনোয়ার সাদী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.