গত ১০ জুন ২০১০ বৃহস্পতিবার ভোরের কাগজে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সম্পর্কে জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীর লেখাটি পড়লাম। তার লেখায় উক্ত ঘটনায় তার রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও সেই সঙ্গে যে মনোকষ্টের চিত্র ফুটে উঠেছে, তার সঙ্গে অনেকেই ঐকমত্য পোষণ করেন। ইসরায়েলের এই জঘন্য কর্মটি সারা বিশ্বেই কমবেশি নিন্দিত হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা হয়েছে। যে খুঁটির জোরে ইসরায়েল এই জঘন্য কাজটি করতে পেরেছে সেই খুঁটি যুক্তরাষ্ট্রের সাদা ভবনের সামনেও বিক্ষোভ হয়েছে।
বাংলাদেশে কিছুই হলো না, এটা তার মনোকষ্টের প্রধান কারণ। সিপিবি ও জাসদ, মুক্তমঞ্চে যে বিক্ষোভ মিছিলটি বের করেছিল, তা দুএকটি কাগজের ভেতর পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়ায় সেটা তার চোখে পড়েনি। পড়লেও তার মনোকষ্টের যথেষ্ট যুক্তি আছে। আসলে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম স্টেট হলেও জাতিসংঘের খাতায় সেটা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের সাহায্যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। ইসরায়েল সে স্বার্থ এ পর্যন্ত ভালো ভাবেই পাহারা দিয়ে এসেছে। তাই তো নিরাপত্তা পরিষদে উক্ত জঘন্য ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব গৃহীত হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সে ঘটনায় ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির পক্ষেই কথা বলেছেন। অর্থাৎ যারা সন্ত্রাস করেছে, তারাই সে সন্ত্রাসের তদন্ত করবে।
ভারতে কেবল কম্যুনিস্ট পার্টি নয়। শাসক কংগ্রেস দলও বিক্ষোভ করেছে। অথচ বাংলাদেশে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত না করায় তিনি ক্ষুব্ধ। আসলে এরকম এক ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ ওপর সরকারি প্রতিক্রিয়া সবাই আশা করে। কিন্তু আমাদের সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
আমাদের মনোকষ্টের আরো অনেক কারণ আছে। সেগুলোর কথা একটু স্মরণ করা যাক। ‘ফ্রিডম ফ্রোটিলায়’ জীবন বাজি রেখে জাহাজে উপস্থিত ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মেইরিড কোরিগান ম্যাগুইর। অবরুদ্ধ গাজায় শিশুদের জন্য শিশুখাদ্য, খেলনা, নারী-বৃদ্ধদের জন্য ওষুধপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃত নয় জনের মধ্যে তার নামটিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো।
আমাদের দেশেও একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী লোক আছেন। ৩১ মের মানবতাবিরোধী, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজো তার মুখ থেকে একটি সহানুভূতিপূর্ণ শব্দও উচ্চারিত হলো না, নিন্দা তো দূরে থাক। বেসামরিক পোশাক পরা দুবছরের সামরিক শাসনামলে যে সুশীল সমাজকে দারুণ একচিত্ত দেখা গিয়েছিল। তারাও যেন তল্পিতল্পা নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন। আমরা আজ যেন কোনো অন্যায়, কোনো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
কিছু মানুষ ছিলেন। তারা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সারা বিশ্বকে এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের সম্মুখীন করেছে। তার ভয়ে আমরা সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত।
কেন আমাদের ভয়? ভারতের ক্ষমতাসীন দলের যদি বিক্ষোভ প্রদর্শন করার ক্ষমতা থাকে, আমরা পারি না কেন? এর ঐতিহাসিক কারণ আছে।
তার অন্যতম কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল কংগ্রেস। আর মুসলিম লীগের কৃতিত্ব হলো ভারতের মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং সাম্রাজ্যবাদের দালালি শিক্ষা দেয়া। দেশ ভাগের পরও পাকিস্তান সে ঐতিহ্য থেকে সরে আসতে পারেনি। সিয়াটো, সেন্টো ইত্যাদি প্যাক্টের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের চাকরে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে না হলেও পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ যে দীর্ঘ শহীদের মিছিল তৈরি করেছে, তার প্রভাব একেবারে মাঠে মারা গেছে বলা যায় না।
সে শহীদের মিছিল আমাদের পথ চলার প্রেরণা। কিন্তু আমরা যেহেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, ব্রিটিশ বা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয়, তাই পাকিস্তানের প্রতি আমাদের ঘৃণা ও আক্রোশ যতোটা তীব্র, ব্রিটিশ/আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের মনোভাব ততোটা তীব্র নয়। একাত্তরে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও আমরা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে প্রবেশ করেছি। দেশের স্বার্থে নয়। এ দেশের শাসক শ্রেণীর স্বার্থে।
কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি এ দেশের সরকারের একটি কূটনৈতিক অবস্থান আছে। তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও সরকার গত ৩১ মের ইসরায়েলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি স্ট্যান্ড নিতে পারতো। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই ইসরায়েলের এই সন্ত্রাসবাদ পছন্দ করে না। কিন্তু তারা মূক-বধির। যাদের প্রতিবাদ করার কথা তারা নানা কারণে চুপচাপ আছে।
এ দেশের অনেক মানবাধিকার সংস্থা আছে বলেই জানি। তাদেরই গোত্রের মানুষ অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলের সন্ত্রাসের সম্মুখীন হন। নয়জন মারা যানÑ বহু আহত হন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের তাদের সহযোদ্ধা মানবাধিকার কর্মীদের অবস্থান কি সেটাও আমরা জানতে পারলাম না।
তাই বলছিলাম জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীর মনোকষ্টের যথেষ্ট কারণ আছে।
তবে তাকে এই বলে আশ্বস্ত করতে পারি যে তার মনোকষ্টের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন, এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে কম নয়। ব্যর্থতা তাদের নয়। ব্যর্থতা এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ধ্বজাধারী ব্যক্তি ও দলসমূহের।
শেষে বলি এ দেশের মানবাধিকার সংস্থাসমূহ যদি গাজায় অবরুদ্ধ শিশু-নারী-বৃদ্ধদের জন্য এক জাহাজ ভর্তি দুধ, শিশুখাদ্য, বাচ্চাদের খেলনা, কাপড়-চোপড় ও ওষুধপত্র নিয়ে গাজার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার ঘোষণা দেয়, তাহলে দেশবাসী আনন্দিত হবেন।
শহিদুল ইসলাম : প্রাক্তন অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।