সুখ চাহি নাই মহারাজ—জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ। ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা কুরুপতি! দীপ্তজ্বালা অগ্নিঢালা সুধা জয়রস, ঈর্ষাসিন্ধুমন্থনসঞ্জাত,সদ্য করিয়াছি পান—সুখী নহি তাত, অদ্য আমি জয়ী।
ছোট বেলায় একবার আপ্পুর (আমি নানীকে আপ্পু বলে ডাকি) সঙ্গে চট্রগ্রাম যাছি ট্রেনে চেপে। সারারাত দীর্ঘ জার্নি। সেই প্রথম ট্রেনে চড়া।
আমি ট্রেনে চড়েই জানালা দখল করে বসি। আমার পাশে আপ্পু। তিনি উলের কাঁটায় অবিরাম কি যেনো বুনে চলেছেন।
আমি জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখি ফিকে বিকেলে একেকটি নগর, গ্রাম, গাছপালা, গরুর পালসহ রাখাল বালক...সবকিছু কি আশ্চর্য দ্রুততায় দৌড়ে দৌড়ে পেছনে চলে যায়। ...
আমি আপ্পুকে জিজ্ঞেস করি ওরা সবাই দৌড়ে পেছনে যায় কেনো? কেনো সামনে যায় না? শুনে আপ্পু হাসেন।
আমাকে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের নানান কথা ব্যাখ্যা করেন।
বেতের বাক্স থেকে একটি কমলা লেবু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, বাবু জানালা দিয়ে অতোটা বাইরে ঝুঁকো না। ট্রেনের ধোঁয়ার সাথে উড়তে থাকা কয়লার গুঁড়ো এসে চোখে পড়বে।
নাম না জানা ছোট্ট একটি স্টেশনে ট্রেন থামতে জানালার ছোট্ট খোপ দিয়ে দেখি মফস্বলের মানুষ, গঞ্জের মানুষ, নানান গন্তব্যের মানুষ আর হরেক রকম হকারকুল। আমার অবশ্য সবচেয়ে নজর কাড়ে কচি কলাপাতা রঙের পোষাক পরা বন্দুক হাতে একদল লোক।
ট্রেনের যাত্রীদের প্রতি তাদের সতর্ক দৃষ্টি।
আবারো প্রশ্ন, আবারো কৌতুহল। আপ্পু বলেন, ওরা হচ্ছে রক্ষী বাহিনী! বাবু, অতোটা বাইরে ঝুঁকোনা। চোখে কয়লার গুঁড়ো এসে পড়বে। ...
তিনি খানিকটা ত্রস্ত হয়ে আমাকে জানালা থেকে সরিয়ে বসাতে চান।
গোঁয়াড় আমি সরে আসি না। একঝাঁক সশস্ত্র টিয়ে পাখির মতো সুশৃংখল রক্ষী বাহিনী দেখি; মনে মনে আউড়াতে থাকি, রক্ষী বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, রক্ষী বাহিনী । ...
ট্রেন চলতে শুরু করলে একজন উটকো যাত্রী বিড়ি খাবেন তাই আপ্পুকে বলে আমাকে জানালার পাশ থেকে সরাতে চান। আমি তা-ও সরে আসি না। আপ্পু জোর করলে আমার চোখে পানি চলে আসে।
বয়স্ক মতন লোকটি অপ্রস্তুত হন। বলেন, থাক মা, ও ছেলে মানুষ।
আমি তখনো টিয়ের ঝাঁক রক্ষী বাহিনী খুঁজে বেড়াই ...
ভোরের দিকে ট্রেন এসে থামে স্টেশনে। আমরা যখন চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে বের হচ্ছি তখন সামনে এসে দাঁড়ায় লাল সালুর লুঙ্গি পরা দোতরা হাতে এক বাউল, "মা আমাকে এক বেলা খাবারের টাকা দেবেন? বাবুকে গান শোনাবো। "
হাত ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলে বাউল গান ধরেন, "রাত্রি করে ঝিকিমিকি কোকিলা করে রাও, শ্বেতকাক বলে রাত্রি, প্রভাও প্রভাও..."
মুহুর্তে তাকে ঘিরে ভীড় জমে যায়; বাউলকে আর দেখা যায় না।
শুধু ভেসে আসে তার ভাঙ্গা গলায় কি এক গান, আর টুংটাং দোতরার আওয়াজ।
আমার ঘোর লেগে যায়, ঘোর লেগে যায়, ঘোর লেগে যায় । ...
না জীবনে প্রথম ট্রেনে চড়ার আনন্দে নয়; রক্ষী বাহিনী বা বাউল গানের সুরেও নয়। আমার ঘোর লেগে যায় এই ভেবে, গানের বিনিময়ে এক বেলার খাবার পাওয়া যায়!
চট্টগ্রামে দুই দিন থাকার পরে আমি যাই নানার বাড়ী ফেনীতে। বাস থেকে নেমে নানীর এক পরিচিত রিক্সায় চেপে মজুমদার বাড়ী (আমার এক নানু হচ্ছেন সাইদ ইস্কান্দার মজুমদার।
তাঁর নামেই বাড়ীর নাম। ) পৌঁছে যাওয়া। বিশাল এক আমবাগান পেরিয়ে, সাইক্লোন সেন্টারের পাশে মজুমদার বাড়ী। বাগানের সঙ্গেই বাঁধানো পারিবারিক পুকুর। সেখানে পা ভেজালাম।
নানার বাড়ী পৌঁছে আদর-আপ্যায়ন, চারপাশের মানুষের ভিড়ে আমি খেই হারিয়ে ফেলি। বহু মানুষের ভীড়ে বিরাট এক রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসি। সেখানে এক পাশে বাড়ীর বউ ঝি’রা ঢেঁকিতে চিড়া কুটছে তখন। সেই প্রথম আমি ঢেঁকি দেখি; দেখি ধান কুড়া কুড় শব্দে কেমন সুন্দর ছন্দে চিড়া কোটা হচ্ছে!
রান্নাঘরে বড়ো বড়ো সব মাটির চুলায় সব সময় বড় এক কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। আরেকটিতে ফুটছে দুধ।
সেখানে বসে বাড়ির এক তরুণী বউ চা সাপ্লাই দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
আমার নানুর বাড়ীর চারদেয়ালে ঘেরা প্রতিটি বাসার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলের এক একজন জাঁদরেল বাহাদুর। আর তাঁর বাড়ীটাও খুব সুন্দর, একেবারে ব্রিটিশ আমলের লাল ইটের খিলান করা একতলা পাকা বাড়ী। বাড়ী থেকে কিছুদুর হেঁটে গেলে দিগন্ত জোড়া সর্ষে ফুলের ক্ষেত।
এক অলস দুপুরে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলাম সেই সর্ষে ফুলের ক্ষেতে।
জীবনে সেই প্রথম সর্ষে ফুল দেখা। আমি তো একসঙ্গে এতো ফুলের সমারোহ দেখে খুশিতে একেবারে আত্মহারা। আর না চাইতেই হলুদ হলুদ ফুলের রেণু লেগে যাচ্ছে আমার চোখে মুখে, এমন কি লাল ফ্লানেলের কামিজেও। ভাবলাম, কিছু ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাই, বাড়ীর সবাইকে দেখাবো আমার এই মহা আবিস্কার। হঠাৎ কোথা থেকে যেনো বোমারু বিমানের মতো উড়ে এলো আশ্চর্য সুন্দর ঝাঁক ঝাঁক সোনালী রঙের কিছু পোকা।
সেইসব পোকা দেখেও আমি ভীষণ খুশি। আসলে সেই সব পোকার ঝাঁক ছিলো মৌমাছি, হুলে যার তীব্র বিষ।
এদিকে এতক্ষণ ক্ষেতের একপাশে দাঁড়িয়ে আমার কান্ড কারখানা আবাক হয়ে দেখছিলো এক দরিদ্র কৃষাণ। সে ছিলো নানা বাড়ীর এক বাঁধা দিনমজুর, কামলা আর কি! আমাকে কিন্তু সে ঠিকই চিনেছে, আমি শহর থেকে বেড়াতে আসা এক পুঁচকে, খান বাহাদুরের নাতনি-ইত্যাদি। তো সেই কামলা এক দৌঁড়ে আমাকে মৌমাছির কবল থেকে “উদ্ধার” করে কোলে করে পৌঁছে দেয় নানা বাড়ী।
আমার মনে আছে একবার আমি নানাবাড়ীর ঘাট বাঁধানো পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ আমার পা থেকে নুপুর খুলে পানির নীচে পড়ে যায়। সেই নুপুর খুঁজে আনার জন্যে ডাকা হয় বড় বড় সব জালুয়াদের। পুকুরে বেড় দিয়ে জাল ফেলে নিয়ে আসা হয় আমার নুপুর। জমিদারের নাতনী বলে কথা!!!!
বোকা চাষা আর জেলেরা অতি ক্ষমতাধর! গ্রাম্য জমিদারের একেবারে শেষ উত্তরসুরির বংশধরকে চিনেছিলো ঠিকই।
কিন্তু ব্যাটা খবর রাখেনি হায়, বালিকা মনের তীব্র উল্লাসের!
ধূসর শৈশবের সেই সপ্নমাখা টুকরো স্মৃতির পাযেল, এই আমি এখন এত বছর পর আবার জোড়া দিতে বসেছি। জাগতিক বিবিধ কর্দমাক্ত নোংরামি, ক্ষুদ্রতা আর বিবমিষার বাইরে আমি আমার সমস্ত মনোসংযোগ সংশ্লেষিত করেছি- গ্ল্যাক্সো বেবী মিল্ক, ওভালটিন, গুঁড় মেশানো চা, মিঃ কুকি আর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুটের সৌরভ মাখা গন্ধময় দিন ফিরিয়ে আনবো বলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।