অদ্ভূত বিষয়গুলোতে বিস্ময়াভূত হওয়া একটি চমকপ্রদ ব্যাপার!! প-এ পায়েল, প-এ পায়েল
পঞ্চম পর্বের জন্য ক্লিকান এখানে
৭।
সকাল বেলা বাড়িতে হৈচৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল পায়েলের। তারপর পর-ই ওর ঘরে জোরে জোরে কড়া পরার শব্দ হল। পায়েল ধরফর করে ওঠে বসে। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে ও।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই সাথে সাথে পায়েলকে জড়িয়ে ধরে কুসুম। ভয়ে কাপছে ও। পায়েল তারাতারি ওকে বিছানায় বসায়। ভয়ে তখনো কাপছে কুসুম। ভয়ে পায়েলের চোখও বড় বড় হয়ে যায়।
বলে, কি হল কুসুম? কি হয়েছে তোর।
কুসুম কোন কথা বলে না। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয় জানালা। দৌড়ে পায়েল জানালার কাছে যায়। কাজলের ঘরের সামনে বাড়ির সকলে ভীর করে আছে।
ধ্বক করে ওঠে ওর বুক। কিছু বুঝে উঠতে পারে না ওর কানে আসে সুর করে কেউ কাঁদছে যেন। কি হয়েছে কাজলের? অসাড় হয়ে আসতে চায় অর হাত পা। তবুও জোর করে নিজেকে টেনে নিচে নামে ও। এগিয়ে যায় কাজলের ঘরের দিকে।
ভীর ঠেলে এগিয়ে যায় সামনে। দেখে কাজল মাথা নিচু করে বসে আছে খাটে। ওর হাত পা বেধে রাখা হয়েছে। গায়ে প্রচুর মার ধরের চিহ্ন। নিচের ঠোট বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নিচে পড়ছে।
পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে কারো।
পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল কাজলকে। রসুমিয়া তখনো চিৎকার-চেচামেচি করে যাচ্ছে। চিৎকার করে করে বলছে, আমার বউয়ের হাত দিস তুই? আমার বউয়ের গায়ে? হারামীর বাচ্চা। তোকে যদি ফাঁসিতে না ঝুলাইছি তো আমার নাম রসুমিয়া না।
বারবার এ কথাগুলো বলতে বলতে রসুমিয়া আতাউর সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। বলল, ভাইসাব, ভাইসাব, আমি এর বিচার চাই। আপনে আমারে সাহায্য করবেন। ওর ফাঁসি দিবেন ভাইসাব। ফাঁসি দিবেন।
আতাউর সাহেব রসুর কাধ ধরে উঠে দাঁড় করায়। বলেন, শান্ত হও রসু, শান্ত হও। আমি এর যথাযথ ব্যবস্থা নিব। শান্ত হও তুমি।
নিথর হয়ে ঘরে বসে আছে পায়েল।
ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে কুসুম। তাঁর পাশেই চুপচাপ বসে আছে রবি। প্রচন্ড ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে গেছে পায়েলের। একটা মানুষ এতটা নিচ আর জঘণ্য হতে পারে ভাবতে পারেনি ও। রাগে দুঃখে কান্না চলে আসে ওর।
এতটা জঘণ্য হতে পারে কেউ ভাবতে পারেনি পায়েল। তাহলে কাজল কি ওকেও সেই চোখেই দেখতো! ভাবতেই গা গুলিয়ে আসে ওর। কুসুমকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় পায়েল। চোখ মুছে জানালার ধারে যায়। আবারও চোখ ভিজে ওঠে ওর।
কেন জানি বিশ্বাস হতে চায় না। কুসুম উঠে এসে পায়েলের পাশে দাঁড়ায়। বলে, বুবু, আমি সবসময়-ই অনর্থক কথা বলি। কাজল স্যার আসলে পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা মানুষ না।
দুদিন যাবৎ রেহানা সারাদিন ঘ্যানর ঘ্যানর করছে আতাউর সাহেবের সাথে।
ঘ্যানর ঘ্যানরের কারন হল তিনি চাচ্ছেন না রসু ও তাঁর বউ আর এ বাড়িতে থাকুক। তিনি বলেন, নষ্টা মেয়েমানুষ এ বাড়িতে থাকা মানে বুঝেন আপনি? ঘরে বিবাহ যোগ্য মেয়ে আছে। মানুষের কানে এসব কথা গেলে আর মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে? দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘরে আছে, ওরা কি আর ভাল থাকবে মনে হয় আপনার? এই তো সেদিনও রবিটা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল মাস্টারকে কেন ধরে নিয়ে গেছে? রসুর বউ কেন বসে বসে কাঁদে। আমাদের বাড়িতে রসুমিয়া আর তাঁর বউ থাকলে যে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ একেবারে নেই। বাড়িতে পুরোপুরি একটা অসুস্থ পরিবেশ এখন।
কিন্তু এই কথাগুলো একেবারে কানেই তুলছেন না আতাউর। তিনি কাজলের শাস্তি যাতে বেশি হয় সে ব্যাপারে দৌড়াদৌড়ি করছেন। কোর্টে তোলা হবে মামলাটি। রেপ কেস বলে কথা। এত সহজে আসামি পার পাবে না।
আর এজন্য প্রয়োজন রসুমিয়ার বউয়ের স্বাক্ষী। আতাউর সাহেব রসুমিয়ার ঘরের সামনে এল। বাইরে থেকে রসুমিয়াকে ডাকলে সে বেরিয়ে আসে। আতাউর বলে,
তোমার বউকে বলো কোর্টে যেতে হবে।
রসু কাচুমাচু মুখে বলে, সে বলেছে যাবে না।
আতাউর সাহেব ধমকে উঠে, যাবে না বললেই হবে? বলো আমি বলছি যেতে।
সাথে সাথে ভিতর থেকে আবারও সুর করে কান্নার আওয়াজ আসে। আতাউর সাহেব বিরক্ত হয়ে চলে যান। ভাবেন, কাকে দিয়ে রাজি করানো যায়। তা না হলে কেসটা মিটে যাবে সহজেই।
তখনি তাঁর মনে হইয় পায়েলের কথা। পায়েলকে বলে দেখা যেতে পারে, মেয়ে নিশ্চই রসু্র বউকে রাজি করাবে। এটা একটি নারী অধিকার বিষয়ক ব্যাপার। তাঁর শিক্ষিত মেয়ে নিশ্চই ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝবে। আতাউর সাহেব গেলেন পায়েলের ঘরে।
বাইরে থেকে মেয়েকে ডাকতে ডাকতে ঢুকলেন ঘরে। আতাউর সাহেব সচরাচর এ ঘরে আসেন না। আজ বাবাকে দেখে একটু অবাকই হয় পায়েল। আতাউর সাহেব চেয়ার টেনে বসেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন।
তারপর পায়েলকে বলেন, মা। একটা কথা বলব তোর সাথে।
বলো বাবা।
মাস্টার জেলে। তুই-ই বল ওর কি শাস্তি হওয়া উচিত না?
পায়েল জবাব দেয় না।
আতাউর সাহেব আবার বলেন, আর এজন্য রসুর বউয়ের সাক্ষী দরকার। কিন্তু সে রাজী হচ্ছে না। তাঁর লজ্জার কথা কোর্টে সবার সামনে কি করে বলবে তাই ঘরে বসে বসে সে ভাবছে। আরে অপরাধীর শাস্তি না হলে তো কাজল ছাড়া পেয়ে যাবে আর এ ঘটনা আরো ঘটাতে থাকবে।
শেষের কথাটায় গা গুলিয়ে উঠল পায়েলের।
আতাউর সাহেব মেয়ের অভিব্যাক্তি লক্ষ্য করছেন। তিনি আরো বললেন, তাই তোর কাছে আসলাম। এ কথা শুনে চমকে উঠল পায়েল। জিজ্ঞেস করল, আমাকে কি করতে হবে?
আতাউর সাহেব হাসলেন। বললেন, তেমন কিছু না।
তুই শুধু রসুর বউকে রাজি করাবি। পারবি না মা?
রসুমিয়ার বউকে এই প্রথমবার দেখছে পায়েল। সুন্দর, ছোট একটা মেয়ে খাটে পা তুলে বসে আছে। মেয়েটি পায়ে সুন্দর একটি পায়েল। এমন একটি মেয়েকে রসুমিয়ার বউ এটা ভাবতে কষ্ট হয় ওর।
আরো কষ্ট হয় এই ভেবে যে কিছুদিন আগে এর ওপর হয়েছে নির্মম অত্যাচার। কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে কালি পরে গেছে মেয়েটার। বড্ড মায়া লাগল পায়েলের। মেয়েটার হাত ধরল ও। টপ করে ওর চোখের পানি পড়ল পায়েলের হাতে।
পায়েল নিজ হাতে মেয়েটার চোখের পানি মুছে দিল। তারপর বলল, তুমি আমাকে চেনো?
মেয়েটা মাথা নাড়ল। আস্তে করে বলল, আপনি পায়েল আপা।
রসুচাচার বউ তাঁকে ডাকছে আপা। শুনতে বেখাপ্পা লাগলেও এ মেয়েটার কাছে নিজেকে আপা বলেই মনে হচ্ছে পায়েলের।
পায়েল বলল, কে বলল তোমাকে?
ও একবার ঘুরে পিছনে তাকালো। সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই দেখে গলা নিচু করে বলল, কাজল ভাইজান।
কথাটা শুনে একমুহুর্ত থমকে গেল পায়েল। যে মানুষটা ওর এত বড় ক্ষতি করে গেছে তাঁকে সে আবার ভাইজান বলে সম্বোধন করছে, কথাটা একটু কানে বাজল। তাছাড়া কাজলের সাথে ওর আগেও কথা হয়েছে জেনে একটু অবাক হল পায়েল।
বলল, কি বলল উনি আমার সম্পর্কে। বলল, আপনি বেশ ভাল মানুষ।
পায়েল চোখ ছোত করল। আরো কিছু জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রইল সে। বলল, আর কি বলেছে?
মেয়েটি আবারও মাথা ঘুরালো।
কাজল বুঝল ও কথাগুলো গোপনে বলতে চাচ্ছে। পায়েল উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলো। মেয়েটা ধীরে ধীরে বলা শুরু করল, কাজল ভাইজান বলেছেন আপনি খুব ভাল মানুষ। তাই আপনার চারপাশের খারাপ গুলো আপনি দেখেন না।
পায়েল জিজ্ঞেস করল, কি খারাপ?
মেয়েটি বলল, আমি সঠিক জানি না কি খারাপ। তবে উনি আপনাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন।
পায়েল ভাল করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ও তোমার সাথে কথা বলত? মেয়েটা মাথা নাড়ল। হ্যা কথা বলত, উনি (রসুমিয়া) বাইরে চলে গেলে আমি মাঝে মাঝে উনার সাথে কথা বলতাম।
উনি এ ঘরে আসত?
না। বেড়ার ফাক দিয়ে কথা বলতাম। এতক্ষনে পায়েল খেয়াল করে এই দু ঘরের মাঝখানে শুধু একটি বেড়ার পার্টিশান দেয়া। স্বামী-স্ত্রী যে ঘরে ঘুমায় আর যার পাশের ঘরেই থাকে একটা যুবক ছেলে, এর মাঝে সামান্য একটা বেড়ার পার্তিশান কি করে দেওয়া হয়। পায়েলের রাগ গিয়ে পড়ে ওর বাবার ওপর।
বাবার নিশ্চই এটা বোঝা উচিত ছিল।
মেয়েটি আবারও বলে, উনি একদিন পড়ছিলেন আমি তখনো নতুন বউ। বেড়ার ফাক দিয়ে উনাকে বললাম চা খাবেন? উনি বলে না। আমি বললাম, কি পরেন, উনি বললেন এই তো পড়াশুনা আরকি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলো না বলে আমি বললাম, আমাকে আপনি দেখছেন? উনি বললেন, দেখছি।
আপনি যখন এ বাড়িতে আসেন তখন দেখছি। আমি বললাম, তাহলে ওদিক ফিরা আছেন কেন? এদিক ফিরেন। উনি আমার দিকে তাকালেন। তারপর হাসলেন। তারপর থেকে উনার সাথে মাঝে মাঝে কথা হত।
উনি খুব ভাল মানুষ।
শেষের কথাটা শুনে রাগ হয়ে যায় পায়েলের। ও বলে, ভাল মানুষটাই তো তোমার ক্ষতি করল। আর তুমি তাঁকে কিনা বলছো ভাল মানুষ।
মেয়েটা সাথে সাথেই বলে উঠল, না।
উনি আমার কোন ক্ষতি করেন নাই। আপনি কাউকে বলবেন না। বললে উনি (রসুমিয়া) আমাকে মেরে ফেলবেন। আমি জানি না সেদিন কিভাবে কি হইছে? ভোর বেলা কাজল ভাইজান ব্যাগ পত্তর গুছাইয়া রওনা দিছেন চলে যাবেন। ঘরের উনি জোর করে উনারে এ ঘরে নিয়ে আসলেন এই বলে যে নাস্তা করাবেন।
এতদিন একবাড়িতে ছিলেন একবেলাও খাওয়ান নাই, তাই উনি জোর করে কাজল ভাইরে ধরে আনছেন। আমিও খুশি হইছিলাম। কাজল ভাইজান এসে বসলেন খাটে। এমন সময় উনি কাজল ভাইজানকে বললেন, আপনি খান, আমি পানি নিয়ে আসি। জগ নিয়া বের হয়ে গেছেন উনি।
কিছুক্ষন পর হঠৎ দরজা বাইরে থেকে লাগাইয়া দিলেন। আর অমনি চিৎকার তাঁর। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম কি হইছে হইছে? উনি খালি চিৎকার দেয় আর সাবাইকে ডাকে। পরে বুঝলাম উনি সবাইকে বলছেন, কাজল ভাই নাকি আমাকে নষ্ট করছে। কি লজ্জার কথা।
বলেই আবারও কান্না শুরু করে দিল বউটা। কাদতে কাদতে বলতে লাগল, সারা দুনিয়ার মানুষ ঘরের সামনে আনছে। সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে আমি নাকি নষ্টা।
নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না পায়েল। ওর চোখ বিস্ফোরিত হবার যোগার।
কয়েক মুহুর্ত শিরদাড়া সোজা করে বসে রইল ও। রসুচাচা ইচ্ছে করেই এ কাজ কেন করল ওর মাথায় আসছিল না। আর কাজলকে এরকম একটা মামলায় জড়ানোর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? উঠে দাড়ালো পায়েল। দাঁড়িয়ে প্রায়ই দৌড়ে বেড়িয়ে গেল পায়েল।
এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এল ও।
একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরল বাইরে। গাড়ি ছাড়া কখনো বের হয়নি মেয়েটা। আজ গাড়ি ছাড়াই বের হল। উদ্দেশ্য থানা।
চলবে........
শেষ পর্বঃ সকল রহস্যের উন্মোচন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।