আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চা (পর্ব-৯)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
যে সময়টায় হাসান ইবনে সাবা এবং তার অনুসারী হাসাসিনরা একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন এবং ইমাম গাজালি যুক্তির দর্শনের পথ পরিহার করে সুফিবাদে ধ্যান জ্ঞান উৎসর্গ করেও রক্ষনশীলদের পক্ষ নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছেন মুসলিম দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে, ঠিক সে সময়েও আল ফারাবী- ইবনে সিনা’র সুযোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে প্রথাগত আরব দর্শন/বিজ্ঞানের চর্চা করে গেছেন ওমর খৈয়াম, এমনকি অনেক যায়গায় পূর্বসূরিদের ছাড়িয়েও এগিয়ে গেছেন অনেকদুর। আগের পর্বেই উল্লেখ করেছি, একেবারে সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও শুধুমাত্র আগ্রহ এবং মেধার জোড়ে ওমর খৈয়াম তৎকালীন পারস্যের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ভূগোল, সংগীত, সাহিত্য এহেন বহু বিষয়ে প্রতিভার সাক্ষর রাখেন অল্প বয়সেই। ক্যালকুলাসের ভিত্তি রচনা হয় তাঁর হাতে। একই সাথে একজন উঁচু মানের বিজ্ঞানী এবং কালজৈয়ি কবি হওয়ার মতো বিরল প্রতিভার অধিকারি ছিলেন তিনি।

খৈয়ামের নিজের জবানিতেই জানা যায়, যে সময়টায় তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা চালিয়েছেন সেই সময়টা বিদ্যাচর্চার জন্য খুব একটা অনুকূল ছিল না। রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাপূর্ণ যে সময়টায় হতাশাগ্রস্ত আল-গাজালি উদ্বিগ্ন ছিলেন ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষায় দার্শনিকদের প্রতিহত করার উপায় নিয়ে সে সময়টায় ওমর খৈয়াম উদ্বিগ্ন ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে। এ প্রসঙ্গে তাঁর treatise on Demonstration of Problems of Algebra নামক গ্রন্থে তিনি বলেন - “ বীজগণিতের অধ্যয়নে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে এবং টানা মনোযোগ দিতে আমি ব্যর্থ হচ্ছিলাম, আমাদের সময়ের অনিশ্চয়তা আর ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে তৈরি হওয়া একের পর এক বাধা আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে। জ্ঞানী সব ব্যক্তিদের আমরা হারিয়েছি, যারা টিকে আছে তারা সংখ্যায় নগণ্য, বিপন্ন এবং বিভ্রান্ত, যারা প্রায় সবাই ভোগবাদী সুযোগসন্ধানী, যখন তাদের অবসর হয় শুধুমাত্র তখনি তারা বিজ্ঞান চর্চা করে। বেশিরভাগই দার্শনিক হওয়ার ভান করে এবং সত্যের সাথ্যে মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে।

এরা যা করে তা হলো জ্ঞানচর্চার অভিনয়, প্রতারণা। যতটুকু বিজ্ঞান তারা জানে তার ব্যবহারও তারা বস্তুগত এবং ভোগবাদী প্রয়োজন ছাড়া করে না। আর ন্যায়ের খোঁজ করছে, সত্যের চর্চা করছে, মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়ছে আর প্রতারণা অসততাকে পরিহার করছে, এমন ব্যক্তিকে নিয়ে এরা ঠাট্টা তামাসা করে”। ১০৭০ সালে তিনি নিশাপুর ছেড়ে সমরকন্দ চলে যান। এখানে তিনি সমরকন্দের কাজি ‘আবু তাহের’এর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

সমরকন্দে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর treatise on Demonstration of Problems of Algebra নামক গ্রন্থটি। পরে সুলতান মালিক শাহএর নির্দেশে এবং তাঁর মন্ত্রী নিজাম উল মূলক (দ্রঃ পর্ব ৭ ও ৮ ) এর আমন্ত্রণে তিনি ইসফাহানে একটি মানমন্দির গড়ে তোলেন। আটজন বিজ্ঞানীর একটি দল নিরলস গবেষণা চালায় এই মানমন্দিরে যাদের মধ্যে খৈয়াম ছিলেন নেতৃস্থানীয়। ইসফাহানের এই মানমন্দিরেই ওমর খৈয়াম কাটিয়ে দেন আঠারো বছর, যে সময়টাকে গণ্য করা হয় তাঁর গবেষণা কর্মের শ্রেষ্ঠ সময়। ১০৭৯ সালে ওমর খৈয়াম যে সৌর ক্যালেন্ডার তৈরি করেন সেই জালালি ক্যালেন্ডার এতোই নিখুত ছিল যার সাথে আধুনিক ক্যালেন্ডারের পার্থক্য খুবই সামান্য।

আধুনিক ইরানে যে ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হয় তা মূলত এই জালালি ক্যালেন্ডারেরই সামান্য সংশোধিত রুপ। এ মানমন্দিরে থাকাকালিন সময়েই খৈয়াম গড়ে তোলেন এক নক্ষত্র মানচিত্র। মধ্যযুগের অত্যন্ত বিখ্যাত এই মানচিত্র এখন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। পৃথিবী যে নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে তা প্রথম মডেল তৈরি করে দেখান খৈয়াম, সেই সাথে দাবি করেন যে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নক্ষত্রদের ঘোরার ধারণা একটা অসম্ভব ধারণা। সরাসরি হেলিওসেন্ট্রিক অর্থাৎ সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মডেলের কথা না বললেও ইবনে সিনা জিওসেন্ট্রিক অর্থাৎ পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্বের মডেলের বিপক্ষে ছিলেন এবং সেই হিসাবে হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্বের পথিকৃতদের একজন ছিলেন তিনি।

হাসাসিনদের হাতে নিজাম উল মুলকএর মৃত্যু (দ্রঃ পর্ব- ৭ ও ৮) এবং তার মাত্র এক মাস পরই সুলতান মালিক শাহএর মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায় ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত মানমন্দির। পরবর্তী সুলতান বন্ধ করে দেন মানমন্দির এবং এর গবেষণার অর্থ সরবরাহ। সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বিরোধীতায় নামে রক্ষণশীল আলেমরা। ওমর খৈয়ামের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিভঙ্গিকে অনৈসলামিক বলে চিহ্নিত করা হয়। আগে থেকেই রক্ষনশীলরা খৈয়ামের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত থাকলেও রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা কারণে খৈয়াম খুব বেশি বিপদাপন্ন হন নাই।

যদিও বিভিন্ন সময় ওমর খৈয়ামকে তার আপাত ধর্মবিরোধী বক্তব্যের জবাব এবং ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে ধর্মবেত্তাদের কাছে, তারপরও রক্ষনশীলদের কাছে থেকে সবচেয়ে বেশি বিরোধীতার সম্মুখীন হন খৈয়াম এ সময়টায়। নিজের এই সামাজিক অবস্থান নিয়ে খৈয়াম দুঃখ করেছেন রুবাইয়াতে - Indeed the idols I have loved so long Have done my credit in this world much wrong Have drown’d my glory in a shallow cup And sold my reputation for a song আমার যত প্রিয়, পূজনীয় এতকাল ধরে ধূলায় মিটালে মোরে দূর্নামেরই ভারে যশ সব ডুবে গেল অগভীর জলে মান বিকিয়ে দিলে ছন্দে সুরে তালে (অনুবাদ - ব্লগার রাত্রি২০১০ ) সকল প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা হারানোর পর ওমর খৈয়াম রাজ দরবারে নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা হিসাবে আগের ইরানী রাজাদের জীবন এবং কাজ নিয়ে লেখা শুরু করেন এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে পূর্বের ইরানী রাজারা সামাজিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান এবং পান্ডিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাদের সেই নীতি বর্জন করা উচিত হবে না। মালিক শাহ্ এর তৃতীয় পুত্র সানজার ক্ষমতায় আরোহণ করার পর তিনি মার্ভএ গমন করেন। সানজারএর পৃষ্ঠপোষকতা মার্ভএই তিনি গনিতের ওপর তাঁর স্বর্বশেষ পুস্তক গুলো রচনা করেন। মার্ভএ তিনি বেশিদিন অবস্থান করনে নাই।

কিছুদিন পরই তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমি নিশাপুরে। নিশাপুরে এসে তিনি পরেন নতুন বিপদে। কারণ এসময় নিশাপুর ছিলো চরম উত্তপ্ত এবং দার্শনিকদের জন্য বিপজ্জনক স্থান। সময়টা ১০৯৫ খ্রীস্টাব্দ। নিশাপুরে এসময় একের পর এক মাশা ই বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ দার্শনিকদের ইনকুইজিশনের মুখোমুখি করা হয়, চলে অত্যাচার এবং হত্যাকাণ্ড।

ওমর খৈয়াম ছিলেন মৌলবাদীদের অন্যতম টার্গেট। বাধ্য হয়ে তিনি হজ্জ করতে চলে যান মক্কায়। তাঁর সমসাময়িক লেখক ইবনে আল কিফতি উল্লেখ করেন যে খৈয়াম ধর্ম পালন করার জন্য হজ্জ করতে যান নাই, গেছেন ভয়ে, ইনকুইজিশন এড়াতে। ধর্মীয় উন্মাদনা শান্ত হওয়ার পরই তিনি নিশাপুর ফিরে আসেন। নিশাপুরেই তিনি তার বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।

জীবনের শেষ সময়টা তিনি কাটিয়ে দেন ইবনে সিনা’র দর্শন শিক্ষা দিয়ে। তবে খুব অল্প কিছু ছাত্রের সমাগমই হয়েছে তার কাছে এসময়। মুসলিম দর্শন এবং বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের এক নির্মম পরিসমাপ্তি চোখের সামনে দেখতে দেখতেই ১১৩১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন ওমর খৈয়াম। মুসলিম দুনিয়া থেকে প্রায় বিস্তৃত হয়ে যান খৈয়াম। এমনকি তার কবর’কে কেন্দ্র করে কোন স্থাপত্যও নির্মিত হয় নাই ১৯৩৪ সালের আগে।

ওমর খৈয়ামের ধর্ম ও দর্শনঃ ওমর খৈয়ামের ধর্ম ও দর্শন নিয়ে বিতর্কের অভাব নাই। এই বিতর্ক যেমন তার জীবদ্দশায় ছিল তেমনি টিকে আছে এখনো। বিতর্ক থাকলেও তার দর্শন বিষয়ক লেখা এবং তার কাব্যসমগ্র রুবাইয়াত থেকে অন্তত এটুকু জানা যায় যে তিনি হাদিস বা সুন্নাপন্থী মুসলমান ছিলেন না মোটেই। নিজের সময়ে ধর্ম বিরোধীতার অভিযোগ তাকে সইতে হয়েছে বারবার আর আধুনিক পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা তাকে অভিহিত করেছেন একজন নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী হিসাবে অন্যদিকে আধুনিক প্রাচ্যের পণ্ডিতরা তাকে একজন সুফি হিসাবে দেখতেই পছন্দ করেন। খৈয়ামের দর্শন বিষয়ক বেশিরভাগ পুস্তকই এখন আর পাওয়া যায় না।

কবি এবং বিজ্ঞানী ওমর খৈয়ামকে নিয়ে যতটুকু আলোচনা হয় ততটুকু আলোচনা হয় না দার্শনিক ওমর খৈয়ামকে নিয়ে। দর্শন বিষয়ক তার লেখনী থেকে যতটুকু জানা যায়, তিনি মোটামুটিভাবে ইবনে সিনার একজন অনুসারী ছিলেন এবং শেষ জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সিনার দর্শন শিক্ষা দিয়ে। পূর্ব নির্ধারণবাদের বিরোধীতায় তাঁর অবস্থান ছিল কট্টর। পূর্বসূরি আল-ফারাবি এবং ইবনে সিনার মতোই তিনি মৃত্যুর পরবর্তী দৈহিক পুনরুত্থানের ধারণা অস্বীকার করেন। তবে কবিতায় আরো একধাপ এগিয়ে মৃত্যুর পরবর্তী বিচার দিবস, বেহেশত এবং দোজখের ধারণাকেও তিনি সরাসরি অস্বীকার করেন।

আল-ফারাবি এবং ইবনে সিনা যেসব ধর্মীয় বিশ্বাসকে অস্বীকার করেছেন পরোক্ষ ভাবে ওমর খৈয়াম সেগুলোই অস্বীকার করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন- লোকে বলে বেহেশতের কথা, আসলে তো কোন বেহেশতো নাই, ঐখানে। লোকে বলে দোযখের কথা, আসলে তো কোন দোযখ নাই, ঐখানে। লোকে তার পরও বহু কথা বলে যায়, ভবিষ্যত জীবিত থাকে, ও আমার ভালোবাসা, নাই কোন পরকাল, আরেক জীবন, সব কিছু আছে- এইখানে। (রুবাইয়াত, অনুবাদঃ আমি) মৌল ইসলামের যেসব বিষয় নিয়ে ওমর খৈয়াম সংশয়বাদী প্রশ্ন উত্থাপন করেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি নিন্মরুপ - কেন আগে থেকেই পাপী হিসবে নির্ধারীত কাউকে তার কর্মফলের দোজখে শাস্তি দেয়া হবে ? - যেসব আনন্দ ফুর্তি বেহেশতে বৈধ করা হয়েছে সেগুলোই কেন আবার দুনিয়ায় অস্বীকার করা হয়েছে? - কেন সুনির্দিষ্ট নিয়মাধীন দুনিয়া তৈরি করার পরও আল্লাহ একজন মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলিতে হস্তক্ষেপ করেন, যেখানে মানুষ এমন একটা নগণ্য জন্তু যে এই সুবিশাল বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে নিজের অস্তিত্বের অবস্থান, শুরু এবং শেষ এবং মহাবিশ্বের তাবৎ লীলা খেলার মাঝে নিজের ভূমিকার ব্যাপারে খুব সামান্য জ্ঞানই রাখে? ইবাদত উপাসনা এবং দৈব জ্ঞানের অসারতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন - ওপরে তাকিয়ে লাভ নেই, কোন উত্তর ওখানে পাবে না, ইবাদতে কোন লাভ নেই, ইবাদত কেউ শুনবেনা।

নৈকট্য আল্লাহর যতটা নিকট ঠিক অতটাই দূরে, সমানে সমান। আর শোন, প্রতারণা, এইখানে, ঐখানে সমান সমান। (রুবাইয়াত, অনুবাদঃ আমি) পরকালের জীবন অস্বীকার করে পার্থিব সুখ সাচ্ছন্দ, মদ, প্রেমের প্রতি তার কামনা প্রকাশ করেছেন তিনি রুবাইয়াতের ছত্রে ছত্রে - এইখানে এই তরুর তলে তোমায় আমায় কৌতুহলে যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে সঙ্গে রবে সুরার পাত্র অল্প কিছু আহার মাত্র আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে (রুবাইয়াত, অনুবাদঃ সংগৃহিত) অথবা স্রষ্টা মোরে করল সৃজন জাহান্নামে জ্বলতে সে কিংবা স্বর্গে করবে চালান তাই বা পারে বলতে কে, করবনা ত্যাগ সেই লোভে এই শরাব সাকী দিলরূবা নগদার এ ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?(রুবাইয়াত, অনুবাদঃসংগৃহিত) রুবাইয়াতের এহেন বহু উদ্ধৃতি দেখে ওমর খৈয়ামকে একজন নাস্তিক মনে হলেও এবং রক্ষনশীলদের অনেকেই তাকে নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত করলেও তার দর্শন বিষয়ক রচনাগুলোতে তিনি নিজের যে মতামত প্রকাশ করেছেন তাতে তাকে ঠিক নাস্তিক বলা যায় না। শুধুমাত্র স্রষ্টায় অবিশ্বাস করাকেই যদি নাস্তিকতা বিবেচনা করা হয় তাহলে তিনি খুব সম্ভবত নাস্তিক ছিলেন না। মৌল ইসলামের সাথে অনেক যায়গায় দ্বিমত পোষণ করলেও তিনি স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন এর প্রমাণ তার অনেক লেখাতেই পাওয়া যায়।

ইবনে সিনার স্বর্গীয় একত্ত্বের ধারণা তিনি সমর্থন করতেন। তবে স্রষ্টা সম্পর্কে তার দার্শনিক তত্ত্বে সবচেয়ে বেশি ইসলাম বিরোধী যে তত্ত্বের উপস্থিতি দেখা যায়, তা হচ্ছে, ওমর খৈয়ামের মতে আল্লাহ দুনিয়া তৈরি করেছেন ঠিকই, তবে তিনি দুনিয়া তৈরি করেছেন এই কারণে যে তিনি দুনিয়া তৈরি করতে বাধ্য ছিলেন, আল্লাহ অভাবহীন না, নিজের অভাব মেটাতে এবং নিজের পূর্ণতার জন্যই তাকে দুনিয়া তৈরি করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে দেখা যায় যে ওমর খৈয়াম তার দার্শনিক রচনায় পূর্বসূরি দার্শনিকদের মতের ওপর আস্থা রেখেছেন কিন্তু কবিতায় বিশ্বজগত, স্রষ্টা, এবং মানুষের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের উদ্যেশ্য নিয়ে সংশয়বাদি অবস্থান প্রকাশ করেছেন। এতে অবশ্য অস্বাভাবিকতার কিছু নাই। দার্শনিক রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃত দার্শনিকের অবস্থান থেকে লিখেছেন আর কবি হিসাবে কবির অবস্থান থেকে।

তবে তাই বলে কেউ যদি খৈয়ামের কবিতা’কে নিছক কবিসূলভ আবেগ অনুভুতির প্রকাশ বলে মনে করেন তাহলেও ভুল হবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে ওমর খৈয়ামের কবিতাকে ভারতীয় উপমহাদেশের সুফি সাহিত্য বিশেষ করে বাঙলার বাউল গানের সাথে তুলনা করে বিচার করলে বুঝতে অনেক সুবিধা হবে। এধরণের শিল্পে একি সাথে অধ্যাত্মবাদ, নন্দনতত্ত্ব এবং সামাজিক ন্যায় অন্যায় বিচার একাকার হয়ে যায়। সেই সাথে বাড়তি আরেকটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে, আর তা হচ্ছে বিজ্ঞান এবং জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে তার দার্শনিক অবস্থান, এই ক্ষেত্রে তার সময়ে তিনি ছিলেন একেবারেই ইউনিক। বুদ্ধিবাদী আর অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের এক মধ্যবর্তি এবং ট্রাঞ্জিশনাল যায়গায় ছিলো তার অবস্থান যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী যুগের আরবদের মাঝে বজায় থাকলে ইউরোপীয় রেনেসার বহু আগেই আরব বিশ্বের আরো শক্তিশালী এবং অপেক্ষাকৃত ভালো বৈশিষ্টের রেনেসার সৃষ্টি হতো।

এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার ইচ্ছা থাকলেও এই লেখায় তা করা সম্ভব না। তাই আপাতত ক্ষান্ত দেই। খৈয়ামের সাথে তিনি আসলে কি ছিলেন এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তিনি হয়তো মদের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে আবৃতি করতেন - জাদুকরের শুরায় মাতাল, এই আমি পৌত্তলিক, অবিশ্বাসী, মূর্তিপূজক, এই আমি সব মাজহাবের ঘৃণার পাত্র, এই আমি আমি আমার আপন প্রভু, তাই আমি ভাই, যা আমি। (রুবাইয়াত, অনুবাদঃ আমি) (চলবে) (বেশি বড় হয়ে যায় বলে এই পর্বের পুরোটা পোস্ট করলাম না, বাকিটুকুও তৈরি করা আছে, পরে পোস্ট করে দেবো। পরের পর্বে ওমর খৈয়ামের পক্ষ বিপক্ষ এবং আরব বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের পতনের কাহিনির বাকি অংশ পাওয়া যাবে)
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.