রাত নেমেছে লাঠিটিলার জঙ্গলে। কয়েক দিন বাদেই অমাবস্যা। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় বনের অন্ধকার তো কমছেই না, উল্টো কেমন একটা ভৌতিক আবহ তৈরি করেছে। এক জায়গায় গাছপালা একটু হালকা। এখানে ছোট একটা পাড়ার মতো গড়ে উঠেছে।
বছর চলি্লশেক হলো জায়গাটায় এসে বসতি গেড়েছে কিছু মানুষ। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ঘুমে কাদা হয়ে আছে। জেগে আছে শুধু মন্তু কবিরাজ। অনেক বয়স হয়েছে তার। চার কুড়ি পেরিয়ে গেছে কবে।
এখন আর আগের মতো শুলেই ঘুম আসে না। হঠাৎ গ্রামের পাশ থেকে শুরু হলো ক্রুদ্ধ গর্জন। শিউরে উঠল কবিরাজ। মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের কথা। আবার শোনা গেল কলজে পানি করে দেওয়া চিৎকার।
চেঁচিয়ে উঠল মন্তু, 'কালো দেও খেপছে। সর্বনাশ হওয়ার আগেই তার জিনিস তারে ফিরাইয়া দাও। '
ডান পাশের জঙ্গল লাগোয়া বাড়িটায় থাকে আয়াজ আর তার স্ত্রী রেহানা। দুজনই ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। কয়েক দিন থেকে রাত হলেই গ্রামের চারপাশের জঙ্গলে কী যেন একটা চক্কর দেয় আর ভয়ঙ্কর শব্দে চিৎকার করে।
কেউ বলে শিকারির গুলিতে মারা পড়া জঙ্গলের কোনো প্রাণীর অতৃপ্ত আত্মা। তবে অনেকের মতোই রেহানার বিশ্বাস, এটা জঙ্গলের অপদেবতা। যেসব শিকারি লুকিয়ে হরিণ, খরগোশসহ বনের বিভিন্ন প্রাণী মেরে সাফ করছে তাদের শাস্তি দিতে এসেছে। ওই বাড়ির হাসেম খুব সাহসী। সেদিন জিনিসটা চিৎকার করতে করতে একেবারে তার বাড়ির কাছে চলে আসে।
তখন জানালা খুলে সরাসরি টর্চ মারে ওটার দিকে। পরে রেহানাকে বলেছে, 'কি কমু ভাবি। কালো কুচকুচে শরীর, আন্ধারের লগে মিশ্যা আছিল। আর চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলতাছিল। অমুন জীব দেহি নাই বাপের জন্মেও।
সাক্ষাৎ অপদেবতা। তয় ডাকটা কেমুন চেনা চেনা লাগছিল। ' দোয়া-দরুদ পড়ে নিজের আর স্বামীর বুকে ফুঁ দিল রেহানা।
ছোট্ট এই বসতি থেকে এক মাইলটাক দূরে একটা টিলার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কয়েকটা বাড়ি। বন বিভাগের অফিস আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই।
এরই একটা কাঠের দু'কামরা ঘর বন কর্মকর্তা রাশেদের আস্তানা। কালই শুধু জয়েন করেছেন এই বনে। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন কেবল। এমন সময় শুনতে পেলেন ডাকটা। আবার শোনা গেল।
ঠিক যেন করাত দিয়ে কাঠ চিরছে কেউ। কেমন চেনা চেনা লাগল ডাকটা। রোমাঞ্চিত হলো গোটা শরীর। ভাবলেন আগামীকাল ভালোভাবে খবর নিতে হবে।
সকালে বিট অফিসার আর ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, কয়েক দিন থেকেই রাতে এই ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন তাঁরা।
আর এটা শোনা যায় জঙ্গলের গ্রামটার কাছ থেকেই। ফরেস্ট গার্ড মাহতাব বলল, 'স্যার, আমার মনে হয় এটা নতুন ধরনের কোনো জানোয়ার। মানুষের বাচ্চা নেওয়ার জন্য তক্কে তক্কে আছে। কোনো দেও-দানোও হতে পারে। মন্তু কবিরাজ শুধু বলে, কালো দেও খেপছে।
তার জিনিস তারে ফিরায়ে দাও। মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝি না তার কথার। বয়স হইছে তো, পাগলামিতে ধরছে। '
'মন্তু কবিরাজ এসব বলে নাকি? তাহলে তো তার সঙ্গে কথা বলতে হয়। আজ বিকালে নিয়ে যেয়ো ওই গ্রামে।
দেখা যাক ঘটনা কী?'
মাহতাবকে নিয়ে যখন বের হলেন তখন সাড়ে চারটার মতো বাজে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এক মাইলের মতো হেঁটে আসার পর হঠাৎ পেঁৗছে গেলেন বসতিটার সামনে। চারপাশে জঙ্গলের মাঝখানে একটু খোলা জায়গার মতো, তাতে আট-দশটা ঘর। বেশির ভাগের দেয়াল খড়ের, চালা টিনের। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল বিশাল একটা টিয়ার ঝাঁক।
বন থেকে বানরের দলের ঝগড়া আর চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।
মাহতাবের হাঁকডাকে কয়েকজন বেরিয়ে এল ঘর থেকে। 'উনি আমাদের নতুন বন কর্মকর্তা। এখন থেকে তোমাদের ভালো-মন্দ দেখবেন' পরিচয় করিয়ে দিল সে। লম্বা, মিশমিশে কালো চেহারার এক লোক এগিয়ে এল সবার আগে, মুখে তোষামোদি হাসি।
লম্বা সালাম ঠুকে বলল, 'স্যার, আমি আলাউদ্দীন। যেকোনো দরকার হইলে কেবল একবার ডাক দিয়া দেইখেন। তুফান মেইলের মতো ছুইট্টা আমু। '
'চলো আগে বরং মন্তু কবিরাজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। '_বললেন রাশেদ।
তাঁকে নিয়ে গ্রামের মাঝখানের একটা ঘরে ঢুকে পড়ল মাহতাব। বুড়ো একজন মানুষ বসে আছে একটা মাদুরের ওপর। চুল-দাড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। সঙ্গে ঢোকা আলাউদ্দীন পরিচয় দিতেই পাশে বসতে ইশারা করল। তারপর বলল, 'বনবাবু আপনেই এর বিহিত করতে পারেন।
কালো দেওয়ের জিনিস ছিনাইয়া আনছে। তাড়াতাড়ি তারে ফিরাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। না হইলে ছারখার কইরা ফেলব পুরা গাঁও। আলাউদ্দীন তরে কই রাতে বন-বাদাড়ে আকাম-কুকাম কইরা বেড়াইবি না। '
'কালো দেওটা আবার কে? তার কী জিনিস ফিরিয়ে দিতে হবে?'
'আপনে বুদ্ধিমান মানুষ।
আমার মনে হয় এর চেয়ে বেশি কিছু কইতে হইব না। তবে গ্রামের বাড়িগুলো একটু ঘুইরা-ফিরা দেইখেন। আগের বয়স থাকলে আমিই কাজটা শেষ করতাম। আর মনে রাইখেন কালো দেও থাকে দূরের আসমানি পাহাড়ের গুহায়। '
তারপর গেলেন আলাউদ্দীনের বাড়িতে।
তাকে কিছুটা অপ্রতিভ মনে হলো। তার স্ত্রীকে দেখেও মনে হলো কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। ঘরের এক কোণে কি একটা দেখে সন্দেহ হওয়ায় সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর টান দিয়ে বের করে আনলেন জিনিসটা। ধারালো একটা বর্শা।
'আলাউদ্দীন শিকারটিকার করো না তো?'
'কী কন স্যার। বনে কত বিপদ-আপদ আছে। তাই বাড়িতে এসব রাখতে হয়। '
তার কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না রাশেদ। কারণ বেড়ার ছিদ্র দিয়ে পাশের কামরায় একটা হরিণের চামড়াও দেখেছেন তিনি।
তবে কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে এলেন।
বুড়ো মা আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকে রমজান মিয়া। বারবার এই আজব প্রাণী কিংবা অপদেবতার হাত থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য কাকুতি-মিনতি করতে লাগল সে। বের হয়ে আসার সময় হঠাৎ মেঝেতে চোখ আটকে গেল রাশেদের। কতগুলো কালো লোম।
রমজানকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি একটা কাগজে লোমগুলো ঢুকিয়ে পকেটে পুরে নিলেন রাশেদ।
তারপর চটজলদি পাড়ার আরো কয়েকটা বাড়ি ঘুরেফিরে দেখলেন। এর মধ্যে হাসেম একটা অদ্ভুত তথ্য দিল। যেদিন অপদেবতা প্রথম হাজির হয়, তার আগের দিন গভীর রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হয় সে। এ সময় হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তিকে জঙ্গলের দিক থেকে আসতে দেখে।
হাতে কী যেন একটা ছিল। সে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই লুকিয়ে পড়ে।
পাড়া থেকে বের হয়ে গ্রামের চারপাশে জঙ্গলের মধ্যে কিছু একটার খোঁজ করতে লাগলেন রাশেদ। একসময় উবু হয়ে বসে মাটিতে কী যেন দেখলেন। যখন উঠলেন তখন বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো তাঁকে।
তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দেখে মাহতাবকে নিয়ে ফিরে গেলেন বাংলোয়।
রাতে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কিছু প্রস্তুতি সেরে নিলেন। একটু পরেই গ্রামের কাছ থেকে ভেসে এল সেই কলজে কাঁপানো ডাক। ত্রুদ্ধদ্ধ কণ্ঠ অনবরত ডেকেই চলেছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে গেল চিৎকার।
একেবারে সুনসান হয়ে গেছে বন। কয়েক মিনিট পরই দূরে জঙ্গলের মধ্য থেকে একটা মায়া হরিণের মরণ চিৎকার শুনতে পেলেন। তবে মাত্র একবারই। তাড়াতাড়ি রাইফেল আর টর্চটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। যেখান থেকে ডাকটা এসেছে সেখানে পেঁৗছতে আধঘণ্টার মতো লাগল।
একটু দূর থেকে হাড় চিবানোর মড়মড় শব্দ শোনা গেল। কাছের একটা উঁচু জামগাছে উঠে পড়লেন। কপাল ভালো ওটা টের পায়নি এখনো। আওয়াজটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে টর্চ টিপে দিলেন। কালো কুচকুচে বিশাল একটা দেহ, জ্বলজ্বলে চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
পরমুহূর্তে কান ফাটানো শব্দে গর্জন করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটু পর গাছ থেকে নেমে বাংলোয় ফিরে এলেন রাশেদ। মনে যা-ও একটু সন্দেহ ছিল দূর হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়েছে কালো দেও রহস্যের। এমনিতে গায়ে ফোটা থাকার কথা থাকলেও এটা অল্প কিছু ব্যতিক্রমের একটি।
পরদিন ভোর থাকতেই গ্রামের একটা বাড়ির সামনে হাজির হলেন রাশেদ। একজন লোক দরজা খুলতেই বললেন, 'আর লুকিয়ে লাভ নেই, দিয়ে দেন। ' তারপর ওটা নিয়ে রওনা হলেন দূরের আসমানি পাহাড়ের দিকে। মন্তু কবিরাজ পথের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন। কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল।
সেদিন রাতে আর গ্রামে জ্বালাতন করতে এল না কালো দেও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।