সকাল আটটা। ফোন করলেন হুমায়ূন কবীর, ‘ভাই, আমি এখন সায়দাবাদে। আর কিছুক্ষণ পর বালুর মাঠে আসতাছি। আপনি আসেন। রাইতে তো ঘুমাই নাই।
আপনার লগে কথা বইলা তারপর ঘুমামু'।
দ্রুত বেরিয়ে পড়ি আমরা। ঢাকার কমলাপুরের বালুর মাঠে সৌদিয়া পরিবহনের গ্যারেজ খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। সমস্যা হলো হুমায়ূনকে খুঁজে পাওয়া। বারবার ফোন করেও ওপাশ থেকে কোনো সাড়া নেই! অনেকক্ষণ পর একজন ফোন ওঠালেন, ‘হুমায়ূন ভাইয়ে মোবাইল চার্জে দিয়া কই জানি গেছে'।
আমরা ধারণা করলাম, চট্টগ্রাম থেকে সারা রাত বাস চালিয়ে এসে মানুষটা নিশ্চয়ই ক্লান্ত, হয়তো ঘুমাচ্ছেন। খানিক বাদে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, সৌদিয়া পরিবহনের আরেক হেলপার যখন আমাদের হুমায়ূনের কাছে নিয়ে গেলেন। শুকনা লিকলিকে মানুষটা একাই দিব্যি একটা চাকা খুলছেন। আমাদের দেখে মুখে বিশাল একটা হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভাই, চাকাটা ফিট কইরাই কথা বলি'? আমরা ‘অবশ্যই অবশ্যই’ বলে তাঁর কাজকর্ম দেখতে থাকি। হুমায়ূন কেমন উসখুস করেন, বলেন, ‘ভাই, আপনেরা বাসের ভিতরে বসেন।
ফ্যান চালায় দিতাছি'। বাসের ভেতরে ঢুকতেই বুকটা ধক করে ওঠে! সামনের গ্লাসটা ফেটে চৌচির। বিশেষ আঠা আর ছোট ছোট গ্লাস দিয়ে জোড়াতালি দেওয়ার পরও মনে শঙ্কা—এই বুঝি গ্লাসটা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে!
বাসে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়! তাই বাসের বাইরে এসে আমরা আবার হুমায়ূনের কর্মযজ্ঞ দেখি। কর্মযজ্ঞই তো, একাই একটা আজদাহা চাকা খুলে, সব ঠিকঠাক করে আবার একাই চাকাটা ফিট করা মোটেও ছেলেখেলা নয়। অথচ কী অবলীলায় না কাজটা সেরে ফেললেন সৌদিয়া পরিবহনের হেলপার হুমায়ূন কবীর।
কাজ শেষে গোসল করে উঠে এলেন বাসে। চালক আসনের বাঁয়ের ইঞ্জিন কভারটা দেখিয়ে বললেন, ‘ঠিক এইখানটায় ধপাস কইরা পইড়া গেছিলেন ওস্তাদে। খুব ভালো মানুষ আছিলেন। আমারে খুব ভালো পাইতেন'।
হুমায়ূনের ওস্তাদ অর্থাৎ বাসটির চালক আবু তাহের (আসল নাম আবুল হোসেন।
কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি সহকর্মীদের কাছে আবু তাহের নামে পরিচিত ছিলেন। ) আর পৃথিবীতে নেই। গত ২৫ জুলাই ফেনীতে নিজের জীবন দিয়ে ডাকাতদের কবল থেকে যাত্রীদের রক্ষা করেছেন মানুষটি। আর হুমায়ূন তাঁর যোগ্য সহকারীর মতো দ্রুত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেরে ফেলেন বাকি কাজটুকু। হুমায়ূনের ভাষায়, ‘গাড়ি চালানো শিখছিলাম মনে করেন ২০০৪ সালে।
তারপর অনেক দিন চালাই নাই। হাতটা বইসা গেছিল'।
সাহসী প্রাণ:
হুমায়ূন কবীরের‘হাত বসে গেলেও’ হুমায়ূন সেদিন বসে থাকেননি। চোখের সামনে ওস্তাদের মৃত্যু; ডানে, বাঁয়ে আর পেছনে ডাকাতদের আক্রমণ—তারপরও কেবল মনের জোরেই সৌদিয়া পরিবহনের ৬৯৭ নম্বর গাড়িটি টেনে নিয়ে চলেন ৩২ বছর বয়সী এ মানুষটি। বেঁচে যান বাসের ৩২ জন আরোহী।
বাস নম্বর ৬৯৭
গত ২৫ জুলাই চট্টগ্রামের ৩২ জন ব্যবসায়ী ভাড়া (রিজার্ভ) করেন সৌদিয়া পরিবহনের ৬৯৭ নম্বর গাড়িটি। বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা দিতে দিতে ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে ১১টা। ঈদের বাজার করতে নরসিংদীর বাবুরহাটে যাচ্ছিলেন এই ব্যবসায়ীরা। পাইকারি কাপড় কিনতে যাচ্ছিলেন সবাই। স্বভাবতই সবার সঙ্গে ছিল বেশ মোটা অঙ্কের টাকা।
তাই বাসে আর অন্য কোনো যাত্রীও তোলেনি বাস কর্তৃপক্ষ।
হুমায়ূন তখন ভীষণ ক্লান্ত। তার আগের রাতে একটুও ঘুম হয়নি। তাঁর ভাষায়, ‘শইল ভাইঙ্গা আসতেছিল। বুধবার রাইতে গাজীপুর থেইকা চট্টগ্রাম আসছিলাম।
আসার পর সারা দিনে বাসের চাইরটা চাকার ব্রেকশু পাল্টাইছি। সব ধোঁয়ামোছা করছি। রোজা ছিলাম, ইফতার কইরা আর ঘুমানোও হয় নাই'।
হুমায়ূনের অবস্থা টের পাচ্ছিলেন চালক আবুল হোসেন। তাই বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন কভারে ঘুমাতে বললেন হুমায়ূনকে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতির উপদ্রব তাঁদের অতি পরিচিত। বাসের দরজাটা লক করতে ভুললেন না হুমায়ূন। ইঞ্জিন কভারের ওপর রাখা যাত্রীদের ব্যাগগুলো বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়লেন আরাম করে। শুয়ে পড়তে না-পড়তেই তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে।
মধ্যরাতের আততায়ী
‘রাইত দুইটার মতো তখন।
গুড়ুম কইরা একটা শব্দ হইল। হুড়মুড় কইরা উইঠা বসলাম। মনে হইতে লাগল কোনো বিয়াবাড়ির সামনে দিয়া যাইতেছি। মনে হইতেছিল, আকাশে বাজি ফুটতাছে'! বলছিলেন হুমায়ূন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মহিপাল বাইপাস এলাকায় তখন তীব্র যানজট।
যানজট এড়াতে ফেনীর লালপুর থেকে পুরানা মহাসড়কে (গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড) ঢুকে পড়েছিলেন চালক। এগিয়ে যাচ্ছিলেন শহরের দিকে। আর ঠিক দাউদপুর সেতু এলাকাতেই বিপদ। ওত পেতে ছিল ১০ থেকে ১২ জনের একটি ডাকাত দল।
‘কিছুক্ষণের মধ্যে বুইঝা ফেললাম ডাকাইতের দল ফায়ার করতেছে'।
হুমায়ূনের চোখে তখনো বিস্ময়, ‘বাসের সামনের গ্লাসটা ইট-পাথর দিয়া ফাটায় ফেলছে। ওস্তাদের ডাইনে যে গ্লাসটা ছিল, সেইটা রাম দা দিয়া কোপায় ভাইঙ্গা ফেলছে ততক্ষণে। বাসের সামনে একটা কাভার্ড ভ্যান দাঁড়ায় পড়ল, বাস তার পরও থামাইলেন না ওস্তাদে। ডাকাইতের দল ওস্তাদের দিকে একটা বন্দুক তাক কইরা মুখ খারাপ কইরা বাস থামাইতে বলতেছে। বাসটাও একেবারে রাস্তার কোনা দিয়া চলতাছে।
রাস্তাটা অনেক উঁচা, একটু এদিক-সেদিক হইলে কয়েক ফুট নিচে গড়ায় পড়ব! এইভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা ধইরা বাজাবাজি চলল। ওস্তাদ একসময় উইঠা দাঁড়াইলেন, তখনো বাঁ হাত দিয়া স্টিয়ারিং ধইরা আছেন। পিছনে একপলক তাকায় দেখি, একটা যাত্রীরও মাথা দেখা যায় না। সবাই সিটের নিচে লুকাইছেন, সুপারভাইজার সাহেবও লুকাইছেন। বাসের বাঁ পাশে তাকায় দেখি, আরেকটা ডাকাইত বন্দুক উঁচায়া দাঁড়ায় আছে।
যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হইতে পারে'।
হলোও তা-ই। চালক আবুল হোসেনকে গুলি করে বসল এক ডাকাত! ‘“ও মা গো!” বইলা পইড়া গেলেন ওস্তাদ'! কথাটা বলে ইঞ্জিন কভারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন হুমায়ূন। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আমরা ভিতরে যেন কী হইল! এক লাফে ওস্তাদের চেয়ারে বইসা পড়লাম। স্টিয়ারিং হাতে নিয়া চাপ দিলাম গিয়ারে'!
ভাগ্য কী ভালো, ঠিক সেই সময় ডাকাতেরা বাসের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা কাভার্ড ভ্যানটাও সরিয়ে নিল।
তারা হয়তো ভেবেছিল, চালক যখন নিকেশ হয়েছেন, তখন বাস আর চলবে কীভাবে? প্রমাদ গুনল নিশ্চয়ই তারা, সৌদিয়া পরিবহনের ৬৯৭ নম্বর গাড়িটি তখন খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো ছুটতে শুরু করেছে। ভোজবাজির মতো চালকের আসনে বসে গেছে আরেকজন।
হিম্মতওয়ালা
রাত প্রায় তিনটা। বাঁ পাশে অস্ত্র উদ্যত ডাকাতটাকে ধাক্কা মেরে বাস ছোটালেন হুমায়ূন। তাঁর কথায়, ‘স্টিয়ারিং ধইরাই খোদাকে ডাকলাম—খোদা, আমি তোমার কাছে কোনো দিন তেমন কিছু চাই নাই।
আজকে আমাদের রক্ষা করো। খোদা যে ওই রাতে আমারে কী শক্তি দিছিলেন, বুঝাইয়া বলতে পারব না! বাসের গতি উঠাইলাম ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। পেছন থেইকা তখনো ইট-পাথর ছুইড়া মারতে লাগল ডাকাইতের দল। একটা পাথর লাগল আমার গালে আর আরেকটা ডাইন ভুরুর ওপরে'। এখনো ঈষৎ ফুলে থাকা জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছিলেন হুমায়ূন, ‘বারবার খালি রিয়ারভিউ আয়নায় তাকাই।
বাসটা নতুন, গতিও সেই রকম। ওরা আর পাত্তা পাইল না। মেইন রোডে উঠতে না-উঠতেই দেখি অনেক মানুষ। বাস না থামায়া দিলাম আরও জোরে টান'।
পেছনে ডাকাত, আকাশ কালো, ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে।
প্রায় বছর তিনেক বাদে স্টিয়ারিং হাতে নিলেও একটুও ভুল করলেন না হুমায়ূন। বেশ কয়েকটা বাস-ট্রাক কাটিয়ে রাত তিনটার দিকে গিয়ে পৌঁছালেন ফতেপুরের স্টারলাইন ফিলিং স্টেশনে। বাস থেকে কোলে করে নামালেন ওস্তাদ তাহেরকে। ছুটে এলেন পুলিশ, র্যাব ও সাংবাদিক। হুমায়ূনের শরীর কাঁপছে থর থর করে।
রাতের শেষে
গত ২৬ জুলাই, সকাল। টেলিভিশনে স্বামীর ছবি দেখে আঁতকে উঠলেন হুমায়ূনের স্ত্রী আলেয়া। সাড়ে তিন বছর বয়সী সন্তান হাসিবুল ইসলাম আর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ছুটলেন স্বামীর কাছে। ততক্ষণে হুমায়ূনের মা সখিনা বেগম, বাবা মো. আবুল কাশেম, চার ভাই, দুই বোন আর ভগ্নিপতিরাও উপস্থিত। সবার একটাই জিজ্ঞাসা, ‘এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আমাদের জানাইলি না'? হুমায়ূনের মুখে ম্লান হাসি, ‘আরে আমার তো কিছুই হয় নাই।
হইলে না খবর দিমু'।
হুমায়ূন মানুষটা এমনই। জন্ম খাগড়াছড়ির কদমতলী গ্রামে। বিয়ে করেছেন ফেনীর পশুরাম উপজেলার মধুগ্রামে। স্ত্রী-সন্তান সেখানেই থাকে।
চার-পাঁচ মাসে একবার বাড়ি যান, কিছুদিন কাটিয়ে ফের ঢাকা টু চট্টগ্রাম—কখনো কখনো কুতুবদিয়া, কক্সবাজারে। মাস শেষে আয়-রোজগার কখনো বা আট হাজার, কোনো কোনো মাসে কিছু বেশি। তার পরও হুমায়ূনের মুখে হাসি। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি, তাই চান ছেলেটা অনেক পড়াশোনা করবে। আর চান, ‘ভাই, আমার তেমন কিছু চাওয়ার নাই।
বেশি লোভ নাই, খোদায় যা দিছে, তাতেই খুশি আমি। পারলে মানুষের ভালো করি। এতগুলা মানুষ যে সেদিন ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরছেন, এইটা দেইখা কী যে ভালো লাগছে'!
হেলপার হুমায়ুন ও তার উস্তাদ বাসটির চালক আবু তাহেরকে সেলুট ! ! !
(ফেবু হতে সংগৃহীত)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।