পতাকায় ফালগুন মানচিত্রে বসন্ত
চলমান সময়ের দীর্ঘপ্রস্থে সাতানব্বই বছর আগে ১৯১৩ সালে একজন বাঙালি হিসেবে কেন রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল প্রদানের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, কেন বা বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারের জন্য গীতাঞ্জলিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এর উত্তর বাঙালিমাত্রই কম-বেশি জানে। তবু বারবার মনে প্রশ্ন জাগে- কী ছিল সেই গ্রন্থের মধ্যে?
যা-ই থাক তা মানুষের জন্য, মানবতার জন্য যে সুসংবাদ বয়ে এনেছিল, তা বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। তাই আমারা অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসাতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। অথচ হয়তো অনেকেই জানি না, গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে বাংলা গীতাঞ্জলির একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। এই গ্রন্থে বিন্যাসিত ১০৩টি গান/কবিতা গীতিমাল্য, খেয়া, নৈবেদ্য সর্বোপরি বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে সংকলিত করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলা গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গান/কবিতা থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে (Song Offerings) মাত্র ৫৩টি স্থান দিয়েছেন। বাকি ৫০টি বেছে নিয়েছেন গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, চৈতালি, উতসর্গ, স্মরণ ও অচলায়তন থেকে। গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালি থেকে ১টি, উতসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন থেকে ১টি কবিতা/গান নিয়ে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির বিন্যাস করেছেন। অর্থাত ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে তিনি মোট ৯টি গ্রন্থের কবিতা/গানের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।
সংকলনের সময় গীতিমাল্য-এর ২৩ নম্বর কবিতা/গানটি তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে শীর্ষে স্থান দিয়েছেন-
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব। ’
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রায় অর্ধেক কবিতা/গান বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে সংকলিত হলেও এর ৭৮ নম্বর কবিতা/গানটি তিনি দ্বিতীয় হিসেবে স্থান দিয়েছেন। প্রথম হিসেবে স্থান দেয়া গীতিমাল্য-এর গান/কবিতাটি গীতাঞ্জলি থেকে স্থান দেয়া দ্বিতীয় গান/কবিতার সঙ্গে অর্ন্তগত মিল, প্রার্থনার সুর কিংবা অতিক্রমণের অভিন্ন মাত্র খুঁজে পাওয়া যায়-
‘তুমি যখন গান গাহিতে বল
গর্ব আমার ভরে ওঠে বুকে;
দুই আঁখি মোর করে ছলছল,
নিমেষহারা চেয়ে তোমার মুখে। ’
তৃতীয় কবিতার সংকলনে তিনি পুনরায় বাংলা গীতাঞ্জলির আশ্রয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় কবিতা/গানের সঙ্গে তৃতীয় কবিতা/গানের ভাব-ভাষার সেই একই সমন্বয়, আত্মার সঙ্গে মহাত্মার যোগাযোগ এমনভাবে সমন্বিত হয়েছে যে একটু গভীরে নিমগ্ন হলে এর মমার্থ সহজেই অনুধাবন করা যায়-
‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি’
চতুর্থ গান/কবিতা সংযোজনে তিনি বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে হঠাতই নৈবেদ্য-এর কাছে ফিরেছেন।
এই ফেরার মধ্যে কাব্যভাষার পরিবর্তনও ঘটেছে। পাশাপাশি উপলরে ভিন্নতা বিশেষভাবে লণীয়-
‘আমার সকল অঙ্গে তোমার পরশ
লগ্ন হয়ে রহিয়াছে রজনী-দিবস’
নৈবেদ্য থেকে পুণরায় গীতিমাল্য। গীতাঞ্জলির পঞ্চম কবিতা/গান সাজাতে তিনি এর ২০ নম্বর গান/কবিতাটি সংযোজন করেছেন। আগের গান/কবিতার সঙ্গে এই গান/কবিতার ভাব-ভাষা, আত্মনিবেদনের অন্তরযোগ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন তিনি। তাই দুটি স্তবকে এর বিষয়বস্তু সাজালেও অর্থ সমন্বয়ে অব্যর্থ হওয়ার কেনো সুযোগ নেই।
‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ণেক তরে’
চতুর্থ কবিতাটি নিজেকে উতসর্গ করে পঞ্চম কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই সমর্পিত হতে চেয়েছেন। নিজের সঙ্গে নিজের এ যেন এক অদ্ভুদ যোগাযোগ। ষষ্ঠ গান/কবিতা সংযোজনে তিনি বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে ৮৭ নম্বর সযত্নে হাতে তুলে নিয়েছেন। এই কবিতা/গানটির অন্তর্নিহীত বোধে ঝড়ে পড়ার আগে যেন কারও স্পর্শ প্রার্থনায় করুণ সুর ধ্বনিত হয়েছে, হোক সে স্পর্শ আত্মাকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার মতো কোনো কিছু। তবু কবির কাছে তা-ই আরাধ্য হয়ে উঠেছে-
‘ছিন্ন করে লও হে মোরে
আর বিলম্ব নয়।
ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি
এই জাগে মোর ভয়। ’
সপ্তম গান/কবিতাও তিনি থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে সংযোজন করেছেন। বাংলা গীতাঞ্জলির ১২৫ নম্বর গান/কবিতায় তিনি নিজেকে বিশ্বনিয়ন্তার কাছে নির্লোভ-শর্তহীন সমর্পণ করেছেন নির্মোহ জীবনের উচ্চারণে-
‘আমায় এ গান ছেড়েছে তার
সকল অলঙ্কার
তোমার কাছে রাখেনি আর
সাজের অহঙ্কার। ’
ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথ আট থেকে উনিশ নম্বর গান/কবিতা সংকলনে বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে ‘রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে’ (১২৭), ‘আর আমায় আমি নিজের শিরে’ (১০৫), ‘যেথায় থাকে সবার অধম’ (১০৭), ‘ভজন পূজন সাধন আরাধনা’ (১১৯), ‘অনেক কালের যাত্রা আমার’ (১৪), ‘হেথা যে গান গাইতে আসা আমার’ (৩৯), ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই’ (২), ‘আমি হেথায় থাকি শুধু’ (৩১), জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ (৪৪), ‘প্রেমের হাতে ধরা দেব’ (১৫১), ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ (১৬), ‘ওগো মৌন না যদি কও’ (৭১) সংযোজন করেছেন। এ সব কবিতা/গানের মূলভাব ও ভাষায় পারস্পরিক সমন্বয় বিশেষভাবে ল করা যায়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতা, হতাশা কিংবা আশালোকের উচ্চারণ কখনো কখনো একে অপরের সমার্থক, বা ব্যত্যয় ঘটলেও কখনো মনে হয় না এই ক্রমসংযোজন আরোপিত; বরং এর একটি অর্থবহ নির্দেশে আমরা আদিষ্ট হই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি গীতাঞ্জলি সাজাতে গান/কবিতার মাধ্যমে বহুবর্ণে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছেন। মুক্তি, যুক্তি, শুক্তি- যা-ই বলি না কেন, তিনি মানব-আত্মাকে বারবার বিশ্ব মানবতামুখী করে আবার পরমাত্মার কাছে সমর্পণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ২১ নম্বর কবিতা/গান সংযোজনে বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে বের হয়ে হঠাৎ আবার গীতিমাল্য-এ প্রবেশ করেছেন। নতুনরূপে তরী ভাসানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
সম্ভাবনাময় সময়কে যথাযথ ব্যবহারে একদিকে যেমন ব্যাকুল হয়েছেন অন্যদিকে নিজেকে আত্মবন্দী করে মুক্তির প্রত্যাশী হয়েছেন। তিনি আত্ম-সমালোচনায়ও যে দ্বিধা করেননি, তা আমরা দেখতে পাই, গীতিমাল্য-এর ২০ নম্বর কবিতা/গানে। নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে রাখার বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করেছেন, তাই গীতিমাল্য-এর এই কবিতা/গান দুটির মর্মার্থ ১৯ নম্বর পর্যন্ত বর্ণীত গান/কবিতার মূল সুর থেকে ভিন্ন। এই পর্যায়ে তিনি কিছুটা বস্তুতান্ত্রিকও হয়েছেন।
‘এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার
এই তরী
তীরে বসে যায় যে বেলা
মরি গো মরি।
’
গীতিমাল্য থেকে আবার বাংলা গীতাঞ্জলি। ফিরেছেন ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর গান/কবিতা নিয়ে, ‘আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোরে’ (১৮), ‘আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ (২০), ‘দিবস যদি সাঙ্গ হল’-এর (১৫৭) মধ্য দিয়ে।
আগের কবিতা/গানগুলোর সঙ্গে পরের এই তিনটি কবিতার যদি অর্থগত দিক খোঁজা হয়, তবে অদ্ভুদ একটি সমন্বয় ল করা যাবে। রবীন্দ্রনাথ দিবস শেষে ঝড়ের রাতের অভিসারে তরী ভাসাতে চেয়েছেন, আবার শ্রাবণ-ঘন বরষার কথাও বলতে চেয়েছেন। অর্থাত তিনি তাঁর ইংরেজি গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো সাজাতে এতটাই বিচিত্র মননের আশ্রয়ী হয়েছেন যে বিস্মিত হতে হয়।
অবাক হতেই হয়, যখন তিনি গান/কবিতাগুলোর সংযোজনে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংশ্লেষ ঘটাতে সম হয়েছেন।
অকস্মাত যেন থমকে যাওয়ার মতো বিষয়- কাঁদামাটির পথে হেঁটে হঠাতই পাহাড়ি পথে পা রাখা। ইংরেজি গীতাঞ্জলির কবিতা বাছাই ও সংযোজনে বরীন্দ্রনাথ কেন এই বৈচিত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার বিশ্লেষণে একটি বিষয় স্পষ্ট যে তিনি কবিতা/গানের বর্ণিল জগতে বসবাস করেছেন; এবং মানব আদালতে তার প্রকাশ দেখতে চেয়েছেন। এসব কবিতা/গানের বিষয়-বৈচিত্র্যে তিনি নিজেকে আত্মা থেকে পরমাত্মায় মিলতে চেয়েছেন। এই পর্যায়ে তিনি ২৫ নম্বর কবিতাটি নৈবেদ্য (৯৮) থেকে নিয়েছেন, যেখানে শত সহস্র বাধায়ও দৃঢ় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন-
‘মাঝে মাঝে কভু যবে অবসাদ আসি
অন্তরের আলোকে পলকে ফেলে গ্রাসি,
মন্দপদে যবে শ্রান্তি আসে তিল তিল
তোমার পূজার বৃন্ত করে সে শিথিল
ম্রিয়মাণ- তখনো না যেন করি ভয়,
তখনো অটল আশা যেন জেগে রয়
তোমা-পাণে।
’
২৬ থেকে ৩০ নম্বর পর্যন্ত কবিতা/গান সংযোজনে পুনরায় তিনি বাংলা গীতাঞ্জলিতে ফিরেছেন।
‘সে যে পাশে এসে বসেছিল’(৬), ‘কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো’ (১৭), ‘জড়িয়ে আছে বাঁধা ছাঁড়ায়ে যেতে চাই’ (১৪৫), ‘আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে’ (১৪৩), ‘একলা আমি বাহির হলাম’ (১০৩)Ñ কবিতা/গান সংযোজন শেষে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে হঠাত ‘খেয়ার বন্দী’ (৩১) শিরোনামের কবিতা/গানটি স্থান দিয়েছেন। ইংরেজি গীতাঞ্জলি বিন্যাসে এ পর্যন্ত যে আবহ বিরাজমান ছিল ‘বন্ধু’ কবিতায় এসে তা হঠাতই যেন এক ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়, যে স্বাদ পাওয়া, না-পাওয়ার এক অসম সমীকরণের উপকরণ।
‘বন্দী তোরে কে বেঁধেছে
এত কঠিন করে!
প্রভু আমায় বেঁধেছে যে
বড্ড কঠিন ডোরে। ’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নৈবেদ্য-এর কবিতা/গান- ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’ (৭২), ‘তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন’ (৯৯), ‘দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি; অতিদীর্ঘ কাল’ (৮৬), ‘তখন করিনি নাথ; কোনো আয়োজন’ (৩৩), ‘একাধারে তুমিই আকাশ তুমি নীড়’ (৮১), ‘শরীরের শিরায় শিরায়’ (২৬), বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি’ (৩০), ‘মর্ত্যবাসীদের তুমি যা দিয়াছ প্রভু’ (৪৪), ‘প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী’ (৩), ‘মাঝে মাঝে কতবার ভাবি কর্মহীন’ (২৪), ‘হে রাজেন্দ্র তব হাতে কাল অন্তহীন’ (৩৯), ‘পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত’ (১৮) এবং ‘জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ণে’ (৮৯ ও ৯০)- কবিতা/গান তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে যথাক্রমে ৩৫, ৩৬, ৪০, ৪৩, ৬৭, ৬৯, ৭৩, ৭৫, ৭৬, ৮৬, ৯৫ নম্বরে সংযোজন করেছেন।
বাংলা গীতাঞ্জলি ও নৈবেদ্য-এর কবিতা/গানের মাঝে পারস্পারিক সর্ম্পকায়নে খেয়ার কবিতাগুলো অত্যন্ত অর্থপূর্ণভাবে সংযোজিত হয়েছে। ‘কোথা ছায়ার কোণে দাঁড়িয়ে তুমি’ (প্রচ্ছন্ন), ‘তখন আকাশ তলে ঢেউ তুলেছে’ (নিরুদ্দমে), ‘আমি ভিা করে ফিরতেছিলাম’ (কৃপণ), ‘ভেবেছিলাম চেয়ে নেব’ (দান), ‘কাশের বনে শূন্য নদীর তীরে’ (অনাবশ্যক), ‘বধি যেদিন ্যান্ত ছিলেন’ (হারাধন), ‘আমি শরত শেষের মেঘের মতো’ (লীলা)- গান/কবিতা ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ৪১, ৪৮, ৫০, ৫২, ৬৪, ৭৮, ৮০ নম্বরে সংযোজন করেছেন। ‘তোমাকে চিনি বলে আমি করেছি গরব’ (৬)- উতসর্গ-এর এই কবিতাটি তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ১০২ নম্বরে সংযোজন করেছেন। ‘উতসর্গ’ কবিতাটি সত্যিকার অর্থেই অসীমের উদ্দেশে উতসর্গিত হয়েছে। বস্তুত এর মাধ্যমে তিনি নিজেই উতসর্গিত হয়েছেন।
আত্মজিজ্ঞাসায় সিক্ত হয়েছেন তার প্রতিটি বাক্যে, শব্দে-
“তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব
লোকের মাঝে।
মোর আঁকাপটে দেখেছি তোমায়
অনেক অনেক সাজে।
কত জনে এসে মোরে ডেকে কয়
‘কে গো সে’ শুধায় তার পরিচয়-
‘কে গো সে’
তখন কী কই, নাহি আসে বাণী
আমি শুধু বলি, ‘কী জানি। কী জানি!’
তুমি শুনে হাসো, তারা দুষে মোরে
কী দোষে। ”
গীতিমাল্য-এর বাকি ১০টি কবিতা/গান ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে সংযোজিত হয়েছে ৪৪, ৫৩, ৫৬, ৬৮, ৭১, ৭২, ৮৯, ৯৩, ৯৪, ৯৯ ক্রমানুসারে।
গীতিমাল্য-এর ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’ (৭), ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি’ (৩০), ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ (১২১) গান/কবিতাগুলো পরবর্তী সময়ে গান হিসেবে বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাণের গানে পরিনত হয়। অধিকন্ত ‘তব রবিকর আসে কর বাড়াইয়া’ (২৯), ‘আমি আমায় করব বড়ো’ (১৫), ‘কে গো অন্তরতর সে’ (২২), ‘কোলাহল তো বারণ হলো’ (৮), ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই’ (২৬), ‘এবার তোরা আমায় যাবার বেলাতে’ (২১) এবং ‘আমি হাল ছাড়লে তবে’ (৬) কবিতা/গানগুলো পরমাত্মিক গুণে সমৃদ্ধ হয়। আপন-পর বিভাজনের নৈতিক সমাধানের পাশাপাশি মীমাংসাহীনতায় অগ্রসর হয়েছে -
‘যা পেয়েছি, যা হয়েছি, যা কিছু মোর আশা
না জেনে ধায় তোমার পানে সকল ভালোবাসা। ’
অচলায়তন থেকে নেওয়া ‘আলো আমার আলো’ গানটি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ৫৭ নম্বরে সংযোজিত হয়েছে। শিশু থেকে নেওয়া ‘ভূমিকা’ কবিতা/গান ‘জগত পারাপারের তীরে’ সংযোজিত হয়েছে ৬০ নম্বরে।
রবীন্দ্রনাথ ‘খোকার চোখে ঘুম যে আসে’ (খোকা) কবিতা/গান ৬১ নম্বর এবং ‘রঙিন খেলনা দিলে ও রাঙা হাতে’ (কেন মধুর) কবিতাটি ৬২ নম্বরে সংযোজন করেছেন। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে এই তিনটি শিশু-বিষয়ক কবিতা/গান সংগত কারণেই তিনি পাশাপাশি সংযোজন করেছেন। এই শিশুকে তিনি নিজের কোলে আগলে না রেখে বিশ্ব চরাচরে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছেন-
‘খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুম ঘোরে-
কোন দেশে যে জনম তার
কে কবে তাহা মোরে।
গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, চৈতালি, উতসর্গ, স্মরণ এবং অচলায়তন থেকে বাছাই করা ১০৩টি কবিতা/গানে ইংরেজি গীতাঞ্জলির বিষয়বস্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্বসাহিত্য পরিসরে বোদ্ধাদের চেতনাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। বিদেশে ইন্ডিয়া সোসাইটি ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু কবিতা ও গানের স্বকৃত ইংরেজি গদ্যানুবাদ নিয়ে গীতাঞ্জলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ধারাবাহিকতায় ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিেত্য বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব-আসনের সম্মানশিখরে তুলে ধরেন।
সুইডিস একাডেমি ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দেয়া প্রসঙ্গে বলে- ‘তাঁর কবিতা গভীর সংবেদনশীল সতেজ ও সুন্দর, যা পরম নৈপুণ্যের সঙ্গে ইংরেজি ভাষান্তরের মাধ্যমে চিন্তা-চেতনাকে তিনি প্রতীচ্যের সাহিত্যের একটি অংশে পরিণত করেছেন। ’ বরীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির পুরোটাই বিশ্ব কবির বিশ্ব চেতনার বহিঃপ্রকাশ, যা যুগে যুগে মানবাত্মার ভাষায় বিশ্ব মানবতার কথা বলছে এবং বলেই যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।