seremos como el Che
Steve Jobs এর মত প্রথমেই বলতে চাই – Truth be told, আমি বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতি সম্পর্কে খুবই কম জানি। ইতিহাস সম্পর্কে কম জানি এজন্য যে আমি এমন একটি সময়ে বেড়ে উঠেছি যখন নানান কারণে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে এমন একটা টানাহ্যাঁচড়া টাইপ এর ব্যাপার হয়েছে যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল এ বিষয় নিয়ে ওই অল্প বয়সেই সন্ধিহান ছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে সেই ধোঁয়াশা ভাব আজও পুরোপুরি যে গেছে তা জোর দিয়ে বলতে পারি না। আর বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তথা বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রম ও দেশের সামগ্রিক উন্নতির উপর আমার কোনদিনই আস্থা ছিল না। আর আশে-পাশে সবাই দেখতাম সেই ধুঁকে ধুঁকে চলা জীবনটাকে নিয়তি বলে মেনে নিয়ে সেখান থেকেই ফায়দা লুটার কাজে ব্যাস্ত।
তাই যখন কলেজ এ পড়তাম তখন দেশের কথা কোন আলোচনায় উঠলে আমার একটা fixed dialogue ছিল। আমি বলতাম ‘যে দেশের মানুষ তাদের জাতির জনক কে হত্যা করে, যে দেশে একটি বিশেষ শ্রেনীর মানুষ সে দেশটির জন্মের বিরোধিতা করেও সে দেশের শাসন ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় এবং যে দেশের মানুষ কাশির ওষুধ খেয়ে নেশা করে – সে দেশের কোনদিন উন্নতি হতে পারে না।
আমাকে বলা হয়েছে তাজউদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য – তার সম্পর্কে আমার কি ধারণা, আমি কি বুঝলাম – এইসব। সর্বপ্রথম আমার যেটা মনে হয়, তাজউদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের আরও যে দু’টি বিষয় সম্বন্ধে অবশ্যম্ভাবীভাবে জানতে হয় তা হল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। এদের একটিকে বাদ দিয়ে অন্য দু’টি কল্পনা করা যায় না।
না বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে তাজউদ্দীন, না তাজউদ্দীনকে বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু, না এ দু’জনকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, না বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে ওঁনারা দু’জন – কোনটিই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ – এর বাইরে ওঁনার সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহ আগে কখনো ছিল না, আসলে সত্যি কথা হল ওভাবে আলাদা করে ঠিক ভেবে দেখাও হয়নি কোনদিন। আগ্রহটা হঠাৎ করেই হল এবং বেশ বেশী করেই হল। ঘটনাটি হল, গত ১৪-১৬ই ডিসেম্বর, খুলনা ফিল্ম সোসাইটি এর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল ‘Tanvir Mukammel Retrospective’, যেখানে তানভীর মোকাম্মেল স্যার এর কিছু চলচিত্র ও Documentary প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনীর প্রথম দিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে উপস্হিত হবার এবং সেদিন প্রথম যে Documentary টি প্রদর্শিত হয় সেটি ছিল ‘তাজউদ্দীন আহমেদঃ নিঃসঙ্গ সারথী’।
রুদ্ধশ্বাস আগ্রহ নিয়ে দেখা শেষ করলাম এবং তারপর নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগতে লাগল, এইজন্য লাগল যে ইতিহাস কম জানলেও এটুকু ঠিক এ জানতাম যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তান কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং তার অবর্তমানে এত বড় মুক্তিযুদ্ধ কে পরিচালনা করেছিলেন তা কোনদিন ভেবে দেখিনি বলে। মনে গভীরভাবে দাগ কাটল Documentary-র শেষে বলা তাজউদ্দীন আহমেদের এই কথাটি যা তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সহকর্মীদের বলতেন – ‘আসুন আমরা দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করি যেন ভবিষ্যতে যখন ঐতিহাসিকেরা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করবে তখন যেন আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয়’। তখনই ইচ্ছা হয়েছিল ওঁনার সম্পর্কে আর জানার কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিভাবে সেটা করা সম্ভব। তারপর ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ কথাটিকে সত্যি প্রমান করার জন্যই হয়ত ২৪শে জানুয়ারী ’প্রথম আলো’-তে আমার চোখে পড়ল ‘তাজউদ্দীন আহমেদ পাঠচক্র’ এর আহবান যখন তার একদিন পরেই ছিল সেটায় যোগ দেবার শেষ তারিখ। এরপর আমি কি করলাম সেটা আর না লিখলেও চলবে।
আমি কাকে সম্মান করব এটা ঠিক করার আমার একটা নিজস্ব Criteria আছে। কেউ যদি আমাকে এমন একটি কাজ করে দেখাতে পারে যেটা আমি করতে পারব না তাহলেই আমি তাকে সম্মান করি, সে হোক আমার থেকে বড় অথবা ছোট। এর উল্টোটাও অবশ্য সত্যি। আর তাজউদ্দীন আহমেদ-কে সম্মান করার ব্যাপারে বলতে হয় যে তার মত করে খবরের কাগজ পড়ার যোগ্যতাও আমার নেই, অন্য সব কিছু তো আমার চিন্তারও উর্দ্ধে।
আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে কোন মানুষকে বুঝতে হলে, তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে হয়।
ভাবতে হয় ওই একই পরিস্থিতিতে আমি কি করতাম, আর এই মানুষটি কি করেছে। আর এ দু’টির পার্থক্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওই মানুষটির আসল চরিত্র। আমি এই একইভাবে তাজউদ্দীন আহমেদকে বোঝার চেষ্টা করেছি। কতটুকু কি বুঝেছি সেটা বলতে পারব না তবে এটা জানি যে আমার নিজের মত করে তাকে আমি ঠিকই বুঝেছি।
আমাকে প্রচন্ডভাবে মুগ্ধ করেছে তাজউদ্দীন আহমেদ এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।
তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে যা বলেছেন তা সবই ভবিষ্যতবাণীর মত। তিনি যে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন যে ‘দেশ যেদিকে যাচ্ছে তাতে দেখা যাবে রাজাকাররা সব দখল করে নিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোন নাম নেই’ – এই কথাটি কি আশ্চর্যভাবে আজকের এই বাংলাদেশেও সত্যি। মোঃ আনিসুর রহমান এর মতে, তাজউদ্দীন স্বাধীনতা সংগ্রামের চিন্তা করেছিলেন ১৯৪৮ সালে, আরহাম সিদ্দিকী’র কথাতেও দেখা যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তাজউদ্দীন আহমেদ একই কথা ব্যাক্ত করেছিলেন। এটা করতে কতটুকু রাজনৈতিক মেধার প্রয়োজন তা সহজেই অনুমেয়। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এর মাধ্যমে আমরা তার রাজনৈতিক চেতনার পুর্ণ প্রকাশ দেখতে পাই, এমনকি সেসময় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল তিনি নিয়ন্ত্রন করেছেন নিপুনভাবে।
‘মুজিব বাহিনী’ সম্পর্কে তার মতামত শেখ মণিকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেবার মাধ্যমে আমরা এ প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ পাই। আবার খন্দকার মোশতাক এর ষড়যন্ত্র বিফল করে দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করেন অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও তার এ ধারা অব্যাহত ছিল। তিনি কথা প্রসঙ্গে মতিউল ইসলাম কে বলেছিলেন, ‘আমরা কি ভুলই করলাম নাকি! স্বাধীনতার পর উচিত ছিল বেশ কিছু অপরাধীকে মেরে ফেলা, তা হলে হয়ত আমরা অনেক ভাল থাকতাম’। তিনি হয়ত এ কথা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে যারা তখন বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত করার কাজে তৎপর ছিল।
তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা কি করতে যাচ্ছে। বাকশাল সম্পর্কে তিনি আগেই বলেছিলেন ‘এটা থাকবে না, রাশিয়া এবং বিভিন্ন লোকের বুদ্ধিতে এটা করানো হয়েছে, কিন্তু এটা টিকবে না’। কিন্তু একই সাথে তিনি এও বলেছিলেন যে ‘আমি সারাজীবন তার(মুজিবের) সঙ্গে ছিলাম, আমি এ অবস্থায় তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। মুজিব ভাই হয়ত খুব বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। এতে তিনি নিজেও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারেন, সাথে আমরাও মারা পড়ব’।
আবু সাইদ চৌধুরী-কে সাক্ষী রেখে তিনি ফোনে বঙ্গবন্ধুকে যা বলেছিলেন সেটা হয়ত তার শেষ চেষ্টা ছিল বঙ্গবন্ধুকে তার ভুল ধরিয়ে দেবার, এটা ছিল তার চুড়ান্ত ভবিষ্যতবাণী। তিনি বলেছিলেন ‘এতবছর যে গনতন্ত্রের কথা আমরা বলেছি, আজকে আপনি একটি কলমের খোঁচায় সেই গনতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যাবস্থা করতে যাচ্ছেন, আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি দ্বিমত পোষন করছি। By taking this step you are closing all the doors to remove you peacefully from your position, এই কথাটি আমি আমার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরাবার কোন গনতান্ত্রিক পথ আপনি খোলা রাখছেন না। তখন একটাই পথ থাকবে আপনাকে সরাবার- আর সেটা হল বন্দুক’।
শেষে তিনি বলেন ‘কিন্তু মুজিব ভাই, সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কি ঘটবে জানেন, আপনাকে এত নিষেধের পরেও আপনার সাথে ওই বন্দুকের গুলিতে আমরাও মারা যাব। আপনি তো শুধু মারা যাবেন না, দেশটারও ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে’। এত বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যত বলতে আর কাউকে কোনদিন শুনিনি আমি।
তাজউদ্দীন আহমেদ এর রাজনৈতিক নীতিও ছিল অন্যদের থেকে ভিন্ন। আমি আর কোন রাজনীতিবিদ এর কথা শুনিনি যিনি কিনা স্তুতিবাক্যের চেয়ে কটু কথা শুনতে বেশি পছন্দ করেন।
তিনি আসলে চাইতেন কটু কথাও মাধ্যমে দেশের পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলো জানতে যাতে তিনি পদক্ষেপ নিয়ে সেগুলো দূর করতে পারেন। তিনি কোনদিন কমিউনিস্ট পার্টি না করলেও দেখা যায় যে কমিউনিস্টদের প্রতি তার আলাদা ভালবাসা ছিল, আবার দেখা যায় তিনি ছিলেন মিশ্র অর্থনীতির সমর্থক। এ বিষয়ে খান সারওয়ার মুরশীদ এর কথায় দেখা যায় ‘তাজউদ্দীনকে সোশালিষ্ট বলা যাবে না, তিনি মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলতেন, আমরা সংসদীয় গনতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ, অঙ্গীকারাবদ্ধ, সুতরাং সেই সমাজতন্ত্র করতে পারব না যেখানে ভোটারকে অগ্রাহ্য করা যায়। তিনি মানুষের সমতার কথা ভাবতেন।
আবার এটাও পরিষ্কার বুঝতেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক স্বার্থে একটি অংশ সমতা চাইতে পারে না’। তাজউদ্দীন আহমেদ এর মধ্যে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব, তাই দেখা যায় তিনি ছিলেন মুসলীম লীগ এর প্রগতিশীল অংশের সদস্য। ম, ওয়াহিদুজ্জামান এর মতে ‘মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীন ছিল তুলনাহীন। সে রাজনীতি করত মানুষের জন্য। তার রাজনীতি ছিল সবার থেকে আলাদা।
ছাত্রজীবন থেকে সে ছিল প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ’। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি প্রশাসন ও রাজনীতি আলাদা রাখতেন। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সময় তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারতেন। আমাদের সময়ে কোন রাজনীতিবিদ এটা করেন বলে আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি জানতেন যে কারা তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মনকে বিষিয়ে তুলছে।
লোন মওকুফের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তাজউদ্দীন খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আবু সাইদ চৌধুরীকে বলেছিলেন ‘চৌধুরী সাহেব, ওই লোকটা আসলে একটা ভাইপার, একে আপনারা কেউ বাইরে থেকে চিনবেন না, আমি দেখেছি এ সাপের চাইতেও বিষাক্ত’। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে মোশতাক এর ষড়যন্ত্রের কথাই বলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাজউদ্দীন আহমেদকে কাছ থেকে দেখেছেন ভারতের গোলক মজুমদার। তার রাজনৈতিক বিচক্ষনতার ব্যাপারে গোলক মজুমদার এর মন্তব্য ‘He was not a politician. He was a statesman’.
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমেদ এর মধ্যে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে একটা ভুল বুঝাবুঝি হলেও তাজউদ্দীন আহমেদ শেষ পর্যন্ত তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন প্রচারবিমুখ, অধিকাংশ সময় তাকে মঞ্চে দেখা যেত না।
এই একই কারনে আরও অনেক জায়গায় তার অবদান থাকলেও তার নাম উল্লেখ নেই। তাজউদ্দীন সবসময় চাইতেন বঙ্গবন্ধুকে সবখানে বড় করে দেখাতে, তার সন্মান বাড়ানোর চেষ্টা করতে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলতেন একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কারও কাছে মাথা নিচু না করতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি সবসময় বলতেন ‘আমি যে দায়িত্বে অর্পিত হয়েছি’ বা ‘আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে’ – তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে একজন নিমিত্ত হিসেবে কাজ করতে চেয়েছেন, নিজে কখনোই ক্রেডিট নিতে চাননি। আলী তারেক এর একটি কথায় দেখা যায় – ‘বঙ্গবন্ধুর যে কোন সাফল্য ও রাজনৈতিক সার্থকতার মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেবের যে পরিতৃপ্তি আমি লক্ষ্য করেছি সে কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
মনে হত বঙ্গবন্ধুর বাইরের আবরণের মানুষটি তাজউদ্দীন আহমেদ’।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন আহমেদ এর ভালবাসা ছিল অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হবার সিদ্ধান্তের পর আলি তারেক যখন তাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেন তখন তিনি উত্তর দেন ‘বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় আমার কোন আকাঙ্খা নেই, আর তার নির্দেশ আমাকে পালন করতেই হবে’। ‘আপনি কাকে বেশী ভালবাসেন, বাংলাদেশকে না বঙ্গবন্ধুকে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন ‘আলি তারেক, আমি বঙ্গবন্ধুকে বেশী ভালবাসি’। তিনি বোঝাতে চাইলেন যে বঙ্গবন্ধুকে না ভালবেসে কেউ বাংলাদেশকে ভালবাসতে পারে না, বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশকে দেখেন।
কত বড় উদার মানসিকতার অধিকারী হলেই না এভাবে চিন্তা করা সম্ভব।
তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন স্বাধীনচেতা, Straight forward কথা বলতেন, সবার সামনেই বলতেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার আগে রুস্তমজী যখন তাকে বললেন যে ‘We are looking forward for a good relationship with Bangladesh’. তখন তাজউদ্দীন উত্তর দিলেন ‘Good relationship as equal’ – কতটুকু দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় তিনি দিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকেও সামনাসামনি বলেছিলেন সরাসরি লাহোর যাবার কথা। তার যদি মনে হত যে এটা করলে ভাল হবে, তাহলে সেটা সামনাসামনি বলতেন, ভয় করতেন না।
তাজউদ্দীন আহমেদ সবকিছু যুক্তিসঙ্গত ভাবে করতেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য তিনি সবাইকে আহবান জানাতেন আর কেউ যদি তাকে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে পারত তবে তিনি তা মেনে নিতেন। একইভাবে দেখা যায় যে মুহিত সাহেব তার সাথে অনেক তর্কবিতর্ক করলেও যেহেতু তা যুক্তিগ্রাহ্য ছিল তাই তাজউদ্দীন আহমেদ তাকে উচ্চপর্যায়ে বদলি করেছিলেন। আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে সেই কর কর্মকর্তার প্রমোশনের ব্যাপারটি যে কিনা বেগম জোহরা তাজউদ্দীনকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছিল ২৫শে মার্চ ১৯৭১ এর রাতে। তাজউদ্দীন আহমেদ এর সারাজীবনের সমস্ত ঘটনার থেকে এই ঘটনাটি আমাকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দেয় এবং তাজউদ্দীন আহমেদ এবং বেগম জোহরা তাজউদ্দীন –এর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয় বারবার।
আমি আমার বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের সাথে এই ঘটনাটি Share করে জানতে চেয়েছি তাজউদ্দীন আহমেদ এর অবস্থানে পড়লে তারা কি করত। বেশীরভাগ সবাই বলেছে যে, প্রমোশন তো দূরের কথা, ঐ লোকের উচ্চতর শাস্তির বিধান করাই ছিল একমাত্র করণীয়। আমি নিজেও হয়ত তাই করতাম।
তাজউদ্দীন আহমেদ এর একনিষ্ঠতা ছিল মুক্তিযুদ্ধে ভারতের এমন উদার সাহায্যের একমাত্র কারন। অনেকটা তার ব্যাক্তিত্বের উপর ভরসা করেই ভারত রাজী হয়েছিল এতবড় ঝুঁকি নিতে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা, ছিলেন একনিষ্ঠতার মূর্ত প্রতীক। যুদ্ধের নয় মাস তিনি পারিবারিক জীবন পরিহার করেছিলেন। একমাত্র শিশুপুত্রের অসুস্থতার কথা শুনেও তিনি তাকে দেখতে যেতে চাননি। পরে সকলের অনুরোধে সেখানে গেলেও পাঁচ মিনিট নীরব প্রার্থনার পর ফিরে আসেন।
যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনে তাজউদ্দীন আহমেদ এর আলাদা পরিকল্পনা ছিল।
তিনি চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করে দেশ পুনর্গঠন করতে যেটা পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি। যুদ্ধের পর বিভিন্ন অপরাধে অপরাধী যারা বিদেশে ছিল তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তাজউদ্দীন আহমেদ এটার ব্যাপারে বলেন যে কারও অধিকার নেই যে বাংলাদেশে জন্মেছে তাকে নাগরিকত্ব থেকে বহিষ্কার করার। কেউ যদি অপরাধ করেই থাকে তবে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে যুদ্ধ-অপরাধের অভিযোগে বিচার করতে হবে। দেশের মানুষ জানবে তার অপরাধ, ঘৃণা করবে অপরাধীকে।
এরা বিদেশে থেকে গেলে তাদের শাস্তি তো হল না। তিনি সব সময় বিশ্লেষণধর্মী সমাধান দিতেন।
তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বের একজন মানুষ। ঘনিষ্ঠ কেউ তার কাছে কোন অন্যায় সুপারিশ নিয়ে যেতে ভয় পেত, আর ঘনিষ্ঠ না হয়েও কেউ কোন যুক্তিযুক্ত সুপারিশ করলে তিনি নিজ চেষ্টায় কাজটা করে দিতেন।
যুদ্ধপরবর্তী বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমেদ এর সম্পর্কের অবনতির ব্যাপারে আমার ছোট্ট একটা বিশ্লেষণ আছে।
আমার মনে হয় খন্দকার মোশতাক এর পাশাপাশি শেখ মণি’র একটা বড় ভূমিকা ছিল এতে। কারন মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘মুজিব বাহিনী’ এবং যুদ্ধপরবর্তী ‘লাল বাহিনী’ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমেদ এর যে ভূমিকা তাতে শেখ মণি তার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। আর যেহেতু তিনি বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয় ছিলেন তাই তার পক্ষে কিছুটা হলেও সহজ ছিল বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যদি এই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি না হত তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত, আমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ পেতাম, যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তাজউদ্দীন আহমেদ অনেক গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন।
বিখ্যাত কিউবান বিপ্লবী চে গুয়েভারা’কে হত্যা করার আগে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি নিজে বেঁচে থাকার কথা ভাবছেন কিনা। চে উত্তর দিয়েছিলেন ‘No, I am thinking about the immortality of the revolution’. ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর হত্যা করার আগে তাজউদ্দীন আহমেদকে যদি এই একই প্রশ্ন করা হত তাহলে তিনি কি বলতেন? আমি যদি ভুল না করি তাহলে তিনি অবশ্যই বাংলাদেশের অমরত্বের কথা বলতেন। ...এবং আমার বিশ্বাস আমি ভুল করিনি।
অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস
তাজউদ্দীন আহমেদ পাঠচক্র
৯ই এপ্রিল, ২০১০, ঢাকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।