আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবির সি্নগ্ধ আলো পথ দেখাবে



রবির সি্নগ্ধ আলো পথ দেখাবে মনজুরুল আহসান খান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা তখন চলছে। এ সময়েই খবর এলো তিনি দুপুর পৌনে ১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ক্লিনিকে পরম শান্তিতে! সভায় ছোট্ট একটা ঘোষণা। বক্তৃতা বন্ধ। খবরটি পেয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সবাই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়েছেন।

কয়েক মিনিট কেটে গেছে। তারপর সভা মুলতবি। আমাকে যেতে হবে শেরপুর। তখনই যাত্রা। কমরেড রবি নিয়োগী।

পিতা রমেশ চন্দ্র নিয়োগী। মাতা সুরবালা নিয়োগী। স্ত্রী কমরেড জ্যোৎস্না নিয়োগী। সবাই প্রয়াত। জন্ম ১৬ বৈশাখ, ১৩১৬ সন বাংলা (পুরনো ক্যালেন্ডার), মৃত্যু ২৭ বৈশাখ, ১৪০৯ বাংলা (নতুন ক্যালেন্ডার) ১০ মে শুক্রবার দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট।

বড় ছেলে রণজিৎ নিয়োগী বললেন, পারিবারিকভাবে ক'দিন আগে শেষ জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। রবিদা বলেছিলেন, ৯৪ বছর পূর্ণ হলো। অগি্নযুগের বিপ্লবী। অস্ত্র হাতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যেসব তরুণ তাজা প্রাণ দিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন, অসম্ভবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তাদের একজন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা।

আন্দামান দ্বীপের বন্দিশালায় কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের বন্ধু। টঙ্ক, তেভাগা, কৃষক আন্দোলন ও বিদ্রোহের নেতা। কমরেড মণি সিংহের সহযোদ্ধা।

পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতা, সামরিক একনায়কত্ব, স্বৈরশাসন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র, স্বাধিকার ও সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই গড়ে তুলেছেন, জেলে গেছেন, আত্মগোপনে থেকে সংগ্রাম চালিয়েছেন। কোনো দমন-পীড়ন তাকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক দার্শনিক ভিত, তার চিন্তার দিকনির্দেশনা, তার স্বপ্ন রচনায় যেসব অকুতোভয় সৈনিক-স্থপতি নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে গেছেন; বিপ্লবী রবি নিয়োগী ছিলেন তাদের পুরোভাগে। যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনি ছিলেন নেতা, সংগঠক_ সেই স্বাধীন দেশেও তাকে বন্দি থাকতে হয়েছে। আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল কারও পরামর্শে, কোনো মহামানব দেখে বা রাশিয়ার মডেল দেখে নয়। সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতন রুখতে গিয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাকে শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারিতে নিয়ে এসেছিল। অগি্নযুগের এই বিপ্লবীর তরুণ বয়সের কাহিনী শুনেছি। ব্রিটিশ সরকারের দুর্ধর্ষ গুর্খা রেজিমেন্টের সৈনিকরা তাকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। দুই শক্তিধর সৈনিক তাকে জাপ্টে ধরেছিল।

অস্ত্রধারী সেনাদের জুজুৎসু প্যাঁচে কুপোকাৎ করে ক্রসফায়ারের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন তরুণ বিপ্লবী। তারপর চলল ব্রিটিশ 'সভ্যতার' তাণ্ডব। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হলো। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়লেন রবিদা। অফিসার ও সৈনিকরা এগিয়ে এলেন এই অসম সাহসী বলিষ্ঠ বিপ্লবীকে দেখতে।

ইংরেজ অফিসার পিঠ চাপড়ে বললেন, ইৎধাব ুড়ঁহম সধহ! 'সাহসী যুবক' তারপর ক্যাম্পে নিয়ে চলল নিষ্ঠুর নির্যাতন। ক্ষত-বিক্ষত মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে কোথাও শুইয়ে রাখার উপায় ছিল না। চামড়া-মাংস উঠে যাচ্ছে। কচুপাতার ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছিল। সেই সাহসী যুবকের কাছে মৃত্যু আবারও পরাজয় মানল।

আবারও হাসিমুখে শুরু করলেন কাজ। সম্প্রতি রোগশয্যায় থেকেও শেরপুর নতুন করে পার্টি দাঁড় করাতে শুরু করেছিলেন, একতা বিক্রি করতেন নিজে। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছেন, একতা নিয়মিত আসা চাই। ১০ মে সন্ধ্যায় রবিদার বাসায় পেঁৗছলাম। কিছুক্ষণ পর বড় ছেলে রণজিৎ নিয়োগী একতার চাঁদার টাকা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

আমি বললাম, পরে হবে। তিনি বললেন, বাবার মরদেহ বাসা থেকে বের হওয়ার আগে এই টাকা আমাকে দিতেই হবে। বার্ধক্য তাকে জীবন থেকে কোনোদিন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। দলমত-নির্বিশেষে সবার রবি কাকা, কাকাবাবুর কাছে লোকজন আসতেন, সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। তার সঙ্গে শেষ জীবনে ছায়ার মতো লেগে থাকত তার নাতনি কলেজছাত্রী পাতা।

গুরু-শিষ্য নয়, যেন বন্ধুর সম্পর্ক। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে, জীবনের গতির সঙ্গে একটা সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি আমি। মনে পড়ে, বেশ আগে রবিদা আমাকে 'হানিফ সংকেতের' ক্যাসেট 'বাজার গরম' কিনতে বলেন। হানিফ তার কৌতুক রস দিয়ে আমাদের সমাজের অন্যায়-অবিচারের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। আমি ভেবে অবাক হই, তখনকার ৯২ বছরের সাহসী যুবক আমার চেয়ে বেশি খবর রাখেন! পার্টির পতাকা ও ফুলে ফুলে শোভিত এই মহান বিপ্লবীর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, কমরেড বলে ডাক দিলে রবিদা নড়ে উঠবেন।

না থাক! অনেক পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি_ এবার একটু শান্তিতে ঘুমাক। মনে হয় আমরাও একটু জিরিয়ে নিই। এই পরশ পাথরের পাশে বসে একটু শুদ্ধ হই, একান্তে অনুভব করি রবির সি্নগ্ধ আলো, তার সৌন্দর্য, তার মহিমা। কিন্তু কই সময়! 'ঞযব ড়িড়ফং ধৎব ষড়াবষু, ফধৎশ ধহফ ফববঢ়/ইঁঃ ও যধাব ঢ়ৎড়সরংব ঃড় শববঢ়/অহফ সরষবং ঃড় মড় নবভড়ৎব ও ংষববঢ়.' কাজল গভীর এ বন মধুর লাগে/কিন্তু আমার যে প্রতিজ্ঞা অনেক/যেতে হবে বহুদূর ঘুমোবার আগে। রবিদার স্বপ্নকে সার্থক করতে হলে তার সাথীদের বহুদূর যেতে হবে।

অনেক চড়াই-উৎরাই অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। (রবার্ট ফ্রস্ট, শামসুর রাহমানের অনুবাদের অনুকরণে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।