দুপুর একটায় ধু ধু রোদ্দুর, এর মধ্যে সাম্পানের ছায়ায় লাঞ্চ সারলাম। আসার সময় সবাইকে শুকনো বিস্কুট, চাটনি, পানীয়, নিউট্রিভিট সি ইত্যাদির একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছিল। দ্রুত লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। অগ্রবর্তী দলটিকে ধরে ফেলতে বেশি সময় লাগল না।
শুক্রবারের চারুকলার সান্ধ্য আড্ডায় ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’র সভাপতি আরশাদ হোসেন যখন তট রেখা ছুঁয়ে বালুকাবেলা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনালেন তখনই এককথায় রাজি।
টেকনাফ থেকে কক্সবাজার জিপিএসের হিসাবে ৮৬ কিলোমিটার। হাঁটা শেষ করে বুঝেছি একশ কিলোমিটারের কম হবে না। উপকূলের রাস্তাটি সোজা নয়। ঠিক হয়েছিল ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি_এই তিন দিনে হাঁটব, তাই ১৮ তারিখ রাতে যাত্রা করলাম। আয়োজক ভ্রমণ বাংলাদেশ, সহযোগিতায় মাউন্টেন ট্রেকার্স ক্লাব (এমটিসি) ও বাপা।
শেষ বিকেলে এমটিসির বেনু ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাউস ঘুড়ি, ফানুস উড়ানো ও সমুদ্রজলে জরবিং করার পরিকল্পনা হলো। জরবিং হচ্ছে জলে গোলাকার চাকার ভেতর মানুষের পদচারণ। বলটি ঘুরে ঘুরে সামনে এগোতে থাকে।
কিন্তু বাসে চড়ার আগে বেনু ভাই ফোনে কেমন যেন সান্ধ্য ভাষায় কথা বলা শুরু করলেন। ফোনালাপে বোঝা গেল না বেনু ভাই যাচ্ছেন কি না।
৯টায় বাস ছাড়ল এবং তিনি অনুপস্থিত। অবশ্য পরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে ভ্রমন বাংলাদেশ দল
টেকনাফ থেকে শিলখালী
যে রেস্টুরেন্টের সামনে বাস থামল, সেটি নামহীন। ঝলমলে রোদের সকালেও তার ভেতরে আঁধার। নাশতা খেয়ে ছোট একটি পিঠ-ব্যাগ নিয়ে ৯টা ২০ মিনিটে যাত্রা শুরু করি।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পরিবেশবিষয়ক হ্যান্ডবিল বিতরণ করতে থাকি। বিডিআরের একটি ক্যাম্প পড়ল। তারা এগিয়ে এলে একটা হ্যান্ডবিল ধরিয়ে দিলাম। টেকনাফ সমুদ্রসৈকত থেকে ইনানী পর্যন্ত জেলে ব্যতীত কোনো পর্যটকের দেখা পাইনি। ঝাউবনে গ্রুপ ফটো তোলার শেষে সমুদ্রের গা ছুঁয়ে হাঁটা দিই।
প্রথম দলে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স হাসান, কোরেশী ও চট্টগ্রামের ফয়সাল। দলটি ক্রমেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। ছয়-সাতজনের একটি দল আগেই মালপত্র, খাবার-দাবার, তাঁবু ও ম্যাট জিপে বোঝাই করে প্রথম রাতের আস্তানা বাহারছড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের উদ্দেশে চলে গেছে নাশতা শেষে।
সৈকত ধরে হাটা (ছবি : চন্দন)
আমাদের সঙ্গে হাঁটছেন এমটিসির সভাপতি খান ভাই, যাঁর ষাট পূর্ণ হতে তিন মাস বাকি। আরো আছেন ফরিদ ও হাবিব।
কিছুটা পেছনে মেয়েদের দলে আছেন রুমী, রুমা, আফরীন, শম্পা ও সীমু। তাঁদের সঙ্গী শ্মশ্রুধারী আবু বকর, শরীফ ও জাফর, যিনি মীরজাফর নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। এক সমীক্ষায় নাকি পাওয়া গেছে, যারা বেশি কথা বলে তারা কম কথা বলা লোকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সুখী। জাফর একটু কথাশিল্পী গোছের। আশিক এসেছেন ভিডিওর লটবহর নিয়ে, পুরো পদযাত্রা নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাবেন।
তাঁকে সাহায্য করছেন শামছুল আলম বাবু ও রবিউল হাসান মনা। তাঁরা একটি ত্রিভুজ বানিয়ে নিয়ে চলছে। চট্টগ্রাম থেকে আরো যোগ দিয়েছেন ব্লগার চন্দন , জাহাঙ্গীর ও জাফর। কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন বোন হাসনা এবং তদীয় ভ্রাতা আনোয়ার বাবু। তাঁরা বেশ ভালোই হাঁটে।
লাভলী ও তাঁর বর বাবু ক্রমেই পেছনে পড়ছেন।
মাঝেমধ্যেই খাড়ি পড়ছে। খাড়ি হচ্ছে ছোট ছোট খাল, যেগুলো জোয়ারে থাকে পূর্ণ, ভাটায় হয় শূন্য। এগুলো পার হতে গিয়ে বেশ কিছুটা ঘুরপথে যেতে হচ্ছে। যদিও সৈকতজুড়ে প্রবল হাওয়া, কিন্তু গনগনে রোদ, রাতে ঘুম না হওয়া মানুষগুলোকে ক্রমেই নিস্তেজ করে দিচ্ছে।
উপকূলের কাছেই পাহাড়সারি। মাঝেমধ্যে ঝাউবন। যেতে যেতে মরা ডলফিন, মা কচ্ছপ, লাল কাঁকড়া, ঝিনুক দেখলাম। এগুলো জেলেদের জালে ওঠে এসেছিল।
সৈকতের কিনারা ধরে হেটে চলছেন অভিযাত্রীরা
আমাদের উজ্জীবিত করতে ১২টা নাগাদ খান ভাই হাবিবকে ভালোবাসার রাসায়নিক বিশ্লেষণ বোঝাতে শুরু করলেন; ক্রোমোসোম, ডিএনএ, পিইএ, অ্যাস্ট্রোজেন ইত্যাদি।
জীববিজ্ঞানের এসব বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে হাবিব কিছুটা অবাক। কারণ এগুলো তিনি পেশাদারী জীবনে ব্যবহার করেন। তিনি একটি ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ড্রাগ ডিসকভারি কেমিস্ট।
নৌকার ছায়ার বসে শুকনো খাবার দিয়ে লাঞ্চ
দুপুর একটায় ধু ধু রোদ্দুর, এর মধ্যে সাম্পানের ছায়ায় লাঞ্চ সারলাম। আসার সময় সবাইকে শুকনো বিস্কুট, চাটনি, পানীয়, নিউট্রিভিট সি ইত্যাদির একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছিল।
দ্রুত লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। অগ্রবর্তী দলটিকে ধরে ফেলতে বেশি সময় লাগল না।
৫টা ১০ মিনিটে বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণের ক্যাম্পে একে একে খান ভাই, ফরিদ কোরেশী, হাসানসহ অন্যরা চলে এলেন। তবে কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে মাছ পারাপারের জিপের সাহায্য নিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে বাক্যবাণ ছোড়া হলো। রাতে পোলাও-মাংসের ভূরিভোজ সেরে তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম।
ইউনিয়ন পরিষদ রুমগুলোয়ও জায়গা নিল অনেকে। ব্যথায় শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না, পায়ের অবস্থা কহতব্য নয়। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার হেঁটেছি আজ।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সিঁড়িতে ভ্রমন বাংলাদেশ দল
শিলখালী থেকে ইনানী
হালকা হিমেল হাওয়ায় এক ঘুমে রাত কাবার। ৫টায় ঘুম ভাঙার পর পরই সদ্যবিবাহিত রিমনের বেড টি পরিবেশনে সবাই আপ্লুত।
গরুর গোশতের খিচুড়ির ভরপেট নাশতা সেরে সৈকত পৌঁছতে ৮টা। হাঁটা শুরু। রাতে যে জাল সমুদ্রে ফেলেছিল, এখন টেনে পারের কাছে নিয়ে আসছে জেলেরা; পরিবারের বাচ্চা মেয়েরা তাদের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিছু দূর পরপরই টাটকা মাছ বালুতে বিছানোর কাজে ব্যস্ত জেলেরা। কারবারি মাছ দরদাম করে জিপে করে নিয়ে যাচ্ছেন কক্সবাজারে।
প্রতিবারই খাবার অযোগ্য কিছু মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী জালে আটকে মারা পড়ে। সেগুলো কুকুর ও কাকের খাদ্য হয়। বালিয়াড়ির ধারে ঝুপড়িতে বাসা বেঁধেছে অনেক পরিবার।
দল বেঁধে জাল টানছেন জেলেরা
খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে জেলে শিশুরা
এখানকার জেলেদের মধ্যে বাল্যবিবাহ থাকলেও ভোলা ও মনপুরা এলাকা থেকে কম। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যে সুবিধা করতে পারছে না, তা বাচ্চাকাচ্চার বহর দেখলে বোঝা যায়।
আজ লাঞ্চ সারলাম ঝাউবনে। খান ভাই, ফরিদ, হাসান, কোরেশী ও মাহাবুব প্রথম দলে। খেলোয়াড় তুহিন ও তাঁর ফটোগ্রাফার বন্ধু পিছিয়ে পড়েছেন।
ক্রমেই দৃশ্যমান হলো ইতস্তত বাড়িঘর, পাকা দালান। শেষ অংশে আর পা চলে না।
সাহিত্যনির্ভর কিঞ্চিৎ রসাত্দক গল্পে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা চালালেন খান ভাই। অবশেষে খাড়ির ওপর সেতু পার হয়ে নারিকেল বাগানের ইনানী রেস্ট হাউসে পৌঁছলাম। খোকন সবাইকে রিসিভ করলেন। আজ পুরো টিমেরই তাঁবুশয্যা। প্রায় ৭৫ কিলোমিটার শেষ।
ইনানী থেকে কক্সবাজার
সকালে রওনা হতে দেরি হলো। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব। খানিকটা হাঁটার পর শুরু হলো কাদার রাজ্য। কাদা ও খাড়ি পার হতে গিয়ে সাগর কিনারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন সচিবের বাংলোর বাইরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। আর বাকি ১৬ কিলোমিটার! সবাই এসে জড়ো হলো।
কিলোপাঁচেক হাঁটার পর পাকা রাস্তায় উঠে এলাম। সৈকত দিয়ে হাঁটার পথ নেই। কিছু দূর হাঁটার পর বেনু ভাইকে দেখলাম বাদাম চিবাচ্ছেন। খান ভাই, ফরিদ, হাসান এবং কুষ্টিয়ার বাবু অগ্রবর্তী দলে। আজ বাতাস নেই, পথটুকু শেষ করতে কষ্ট হলো খুব।
দুপুর ২টা ১০ মিনিটে নির্ধারিত হোটেলে প্রথম দল গিয়ে পৌঁছল। খান ভাই, ফরিদ ও হাসান প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়। নাকে-মুখে চারটা খেয়ে ঘুড়ি উড়াতে লাবণী পয়েন্টে উপস্থিত হলাম। সবাই একে একে উপস্থিত। জরবিং করা গেল না বৈদ্যুতিক সংযোগের অভাবে।
রুমী ও হাসানের প্রথম জরবিং মহিলা ও পুরুষ হওয়ার আশা পূরণ হলো না। পদযাত্রা সমাপ্তি টানা হলো ফানুস উড়িয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।