দেশকে ভালবাসা
রিমান্ডে হুজি নেতা মোস্তফা
ডিজিএফআইয়ের দুই কর্মকর্তা জঙ্গি নেতাদের কাছে নিয়ে যান
নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) যুক্তরাজ্য শাখার নেতা গোলাম মোস্তফার সঙ্গে বাংলাদেশের হুজির নেতাদের বৈঠক করিয়ে দেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) দুই কর্মকর্তা। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক গোলাম মোস্তফা এ তথ্য দিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।
জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা বলেন, ২০০৭ সালের মাঝামাঝি ডিজিএফআইয়ের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজান তাঁকে কচুক্ষেত বাজারের পূর্ব পাশের একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখানে ডিজিএফআইয়ের আরেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফ (সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার), হুজির সাবেক আমির মাওলানা আবদুস সালাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শেখ ফরিদ আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন। কর্নেল সাইফ বলেন, মাওলানা সালাম ও শেখ ফরিদেরা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে নতুন সংগঠন করেছেন।
সংগঠনটির সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি গোলাম মোস্তফাকে প্রস্তাব দেন।
জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র জানায়, গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের জুন-জুলাই মাসে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গোয়াহরি গ্রামে তাঁর বাড়িতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি যান। তিনি একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যোগাযোগ করার জন্য বলে আসেন। পরে তিনি ঢাকায় এসে ভিজিটিং কার্ডের নম্বরে ফোন করলে অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে ডিজিএফআইয়ের মেজর মিজান পরিচয় দেন। এর দুই সপ্তাহ পর ওই মেজর (লেফটেন্যান্ট কমান্ডার) মিজান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মোস্তফার বাসায় যান।
পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার পর একদিন মিজান তাঁর গাড়িতে করে গোলাম মোস্তফাকে গুলশানের একটি বাড়িতে নিয়ে যান এবং সেখানে তাঁরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফের সঙ্গে বৈঠক করেন।
গোলাম মোস্তফা গোয়েন্দা পুলিশকে জানান, প্রথম বৈঠকে লে. কর্নেল সাইফ কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের (ফাইন্যান্সিং টেররিজম) অভিযোগ এনেছে। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে মানি লন্ডারিং মামলাও হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী সূত্রগুলো জানায়, মেজর পরিচয়দানকারী মিজান প্রকৃতপক্ষে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। তিনি ও লে. কর্নেল সাইফ ওই সময় ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোয় কর্মরত ছিলেন।
এঁদের মধ্যে লে. কর্নেল সাইফকে গত বছরের ৫ নভেম্বর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এর পর থেকে তিনি পলাতক আছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জড়িত জঙ্গিদের নানাভাবে সহায়তার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে সিআইডি খুঁজছে। আর লে. কমান্ডার মিজান এখন নৌবাহিনীতে কর্মরত।
তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ঘটনায় গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনকে দেশত্যাগে সহায়তার বিষয়ে গত বছর ঢাকার মহানগর হাকিমের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যে তালিকাভুক্ত জঙ্গি: গোলাম মোস্তফাকে গত বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের বিশ্বনাথ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরদিন তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে সংবাদকর্মীদের সামনে হাজির করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক বলেন, গোলাম মোস্তফা হুজির যুক্তরাজ্য শাখার আমির। ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁকে র্যাব অস্ত্রসহ ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।
ওই ঘটনায় বাড্ডা থানায় হওয়া অস্ত্র মামলায় তাঁর ১৭ বছর সাজা হয়। গত বছর জানুয়ারিতে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিনে বেরিয়ে নতুন করে বাংলাদেশে হুজিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন।
গোলাম মোস্তফা জানান, তাঁর বাবা সাজেদুর রহমান ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯৬২ সালে সিলেটে তাঁর জন্ম।
১৯৭৫ সালে লন্ডনে যান। ১৯৮৪ সালে প্রথম বিয়ে করেন। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের ৬০ উইলটন রোডে তাঁর নিজস্ব বাড়ি। সেখানে তাঁর রেস্তোরাঁ ব্যবসা আছে। বর্তমানে সেটি তাঁর প্রথম স্ত্রী রেহানা বেগম দেখাশোনা করে।
প্রথম স্ত্রীর ঘরে ছয় সন্তান, তারা যুক্তরাজ্যে থাকে।
রিমান্ডে মোস্তফার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে পালিয়ে এ দেশে আসার আগে ১৯৮৬-৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশে এসে ১৩ মাস থেকে যান। ২০০৪ সালে এ দেশে এসে কিছুদিন ছিলেন। তখন তিনি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী ঢাকার হাজারীবাগে থাকেন।
তবে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলেননি।
গোয়েন্দা সূত্রগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে, মোস্তফা ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে আফগানিস্তানে যান। ওই যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে অন্য বাংলাদেশি মুজাহিদের পরিচয় হয়, যা আফগান যুদ্ধফেরত হুজির সাবেক আমির আবদুস সালামসহ একাধিক মুজাহিদ বিভিন্ন সময়ে এ প্রতিবেদককে বলেছেন।
জামিনের জন্য মওদুদকে পাঁচ লাখ, হুজি নেতাকে চার লাখ টাকা দেন: গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোলাম মোস্তফা তাঁর জামিনের জন্য প্রথম দায়িত্ব দেন হুজির সাবেক আমির (আইডিপির আহ্বায়ক) আবদুস সালাম ও একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক সাংবাদিককে। তাঁরা জেলগেটে গিয়ে গোলাম মোস্তফার সঙ্গে দেখা করেন।
তখন তাঁরা আইডিপির সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করেন বলে মোস্তফা জানান। জামিনের ব্যবস্থা করতে ওই দুজনকে চার লাখ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা জামিন করাতে পারেননি। এর মধ্যে তাঁর সাজা হয়ে যায়। পরে হাইকোর্টে আপিল ও জামিন করানোর জন্য তাঁর ছোট ভাই ও ভায়রার মাধ্যমে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদকে আইনজীবী নিয়োগ করেন।
এবার জামিন পান মোস্তফা। এ বাবদ মওদুদকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয় বলে মোস্তফা জানান।
জানতে চাইলে মওদুদ আহমদ মামলা পরিচালনার জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গোলাম মোস্তফাকে কখনো চোখে দেখিনি। মামলার ব্যাপারে তাঁর যেসব আত্মীয় আমার কাছে এসেছিলেন, তাঁরা ভালো অবস্থানে আছেন। তাঁর এক ভাই লন্ডনে ব্যারিস্টারি করেন।
মোস্তফা হুজির সদস্য জানলে আমি কখনো এ মামলা নিতাম না। ’
বসনিয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহ: সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা গৃহযুদ্ধের সময় সেখানকার মুসলমান মুজাহিদদের জন্য যুক্তরাজ্যে তহবিল সংগ্রহে নামেন গোলাম মোস্তফা। এ কাজে তাঁকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক ব্রিটিশ নাগরিক ফয়সাল মোস্তফা (ভোলার) সহায়তা করেন। ফয়সাল মোস্তফাকে জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য গত বছর ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার আগে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ফয়সাল মোস্তফার প্রতিষ্ঠিত গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদ্রাসা থেকে র্যাব অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু অস্ত্র, গুলি, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে।
এরপর বিদেশে পালানোর সময় ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে ফয়সাল মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভোলার আদালতে ফয়সাল মোস্তফার দেওয়া জবানবন্দিতে এই গোলাম মোস্তফার কথাও উল্লেখ আছে। তাতে তিনি বলেন, গোলাম মোস্তফা বসনিয়া যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহকালে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা বলেছেন, লন্ডনে অবস্থানকালে ১৯৯৯ সালে ভোলার মোস্তফা ফয়সালের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়। ফয়সাল লন্ডনে গ্রিন ক্রিসেন্ট নামে একটি এনজিও চালাতেন এবং এতিমদের সাহায্যের জন্য বাঙালিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন।
তিনি আরও বলেন, আনুমানিক ২০০০-০১ সালে ফয়সাল অস্ত্রশস্ত্রসহ ব্রিটিশ পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। তাঁর সঙ্গে তখন জয়নাল আবেদিন নামের সুনামগঞ্জের একজনও ধরা পড়েন। জয়নালের ১৫ বছর সাজা হলেও ফয়সাল খালাস পান। ফয়সাল ম্যানচেস্টার শহর থাকতেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।