আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চা (পর্ব-৮)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
আল-গাজালির যে সময়ে আবির্ভাব সে সময়ে মুসলিম ধর্মতত্ত্ব থেকে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা প্রায় তিরোহিত হয়েছে। এমনকি আশারি প্রবর্তিত মডারেট পূর্ব-নিয়ন্ত্রনবাদও কট্টর রক্ষনশীলতার সাথে বিলীন হয়ে গেছে। হাম্বলিবাদীরা জ্ঞান এবং আইনের ক্ষেত্রে কোরআন হাদিস ছাড়া আর সকল উৎসকে করেছে অস্বীকার। কিন্তু মুতাজিলারা না থাকলেও ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আর কোরআন হাদিস ছাড়াও যুক্তিবুদ্ধি তথা প্রজ্ঞার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের মতবাদের পতাকা তুলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মুসলিম দার্শনিক/বিজ্ঞানীরা। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ধর্মতত্ত্বে অনেকটাই তিরোহিত হলেও দর্শন এবং বিজ্ঞান চর্চার মূল শক্তি হিসাবেই টিকেছিল।

আল ফারাবি আর ইবনে সিনা প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতবাদকেই তৎকালীন অধিকাংশ দার্শনিক/বিজ্ঞানীরা নিজেদের জীবনাদর্শ আর নীতি নৈতিকতার উৎস হিসাবে গ্রহণ করতেন। রক্ষণশীল ধর্মতাত্ত্বিকরা মুসলমান দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের দেখতেন ধর্মের প্রতি হুমকি হিসাবে। মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলোতে দার্শনিকদের প্রভাব ছিল ব্যাপক, এই প্রভাবের অবসান চাইতেন রক্ষনশীলরা। তবে ফতোয়া জারি ছাড়া অথবা সুযোগ বুঝে দমন নিপীড়ন চালানো ছাড়া দার্শনিক বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি তারা। আর জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদী তৎকালিন আরব বিশ্বে শুধুমাত্র ফতোয়া দিয়ে দার্শনিকদের প্রভাব দূর করা সম্ভব ছিল না।

এমন একটা সময়েই আবির্ভাব ঘটে গাজালির। গাজালি ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তি। তার নিজের সময়ের বিদ্যানুরাগী এবং ধর্মতাত্ত্বিক সমাজে তার প্রভাব ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রক্ষণশীল সুফি ধর্মতাত্ত্বিক আবির্ভূত হন মুসলিম দার্শনিকদের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মরণঘাতি প্রতিপক্ষ হিসাবে। তবে গাজালিযে প্রথম থেকেই যুক্তিবিদ্যার প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন তা না।

তিনি তার কর্ম জীবন শুরু করেন সুলতান মালিক শাহএর প্রধান মন্ত্রী নিজামুল মুলকের নিজামিয়া একাডেমির একজন শিক্ষক হিসাবে। মূলত শাফি আইন এবং আশারিয়া ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক হলেও দর্শন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার একজন পণ্ডিত হিসাবেও এসময় তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। মালিক শাহ ছিলেন বিদ্যানুরাগী এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। মালিক শাহ নিজে সুন্নি ছিলেন এবং তার প্রজাদের একটা বড় অংশই ছিল সিয়া। রাষ্ট্রপরিচালনায় তিনি ছিলেন অনেকটাই সেকুলার ধরনের।

রক্ষনশীল ধর্মীয় গোষ্টি বিশেষ করে হাসান ইবনে সাবা এবং তার অনুসারিরা মালিক শাহ’কে একজন ভোগ বিলাসী সুলতান বলে অভিযুক্ত করে। মালিক শাহ এবং নিজামুল মুলক গাজালি, ওমর খৈয়ামের মতো বহু বিদ্যানুরাগীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ইরানি কিংবদন্তি অনুসারে নিজামুল মুলক, ওমর খৈয়াম এবং হাসান ইবনে সাবা তরুন বয়সে বন্ধু ছিলেন। ১০৯১ খ্রিষ্টাব্দে গাজালি নিশাপুরের নিজামিয়া একাডেমীর প্রধান নিযুক্ত হন। কিন্তু ১০৯২ খ্রিষ্টাব্দেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা, নিজামুল মুলক একজন হাসাসিনের হাতে নিহত হন।

হাসাসিনরা ছিল হাসান ইবনে সাবা প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত ঘাতক সংঘের সদস্য। হাসিস খেয়ে গুপ্ত হত্যায় পারদর্শী হাসাসিনরাই পরবর্তিতে ইতিহাসে assassin হিসাবে পরিচিত হয়, যার অর্থ গুপ্তঘাতক। কথিত আছে, হাসান ইবনে সাবার সরাসরি নির্দেশে নিজামুল মুলক’কে হত্যা করা হয়। নিজামুল মুলকের মৃত্যুর ঘটনা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল গাজালির চিন্তা জগতে। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিজামুল মুলকের মৃত্যুতে তিনি হতাশ হয়ে পরেন এবং ধীরে ধীরে শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

এসময় তিনি পার্থিব বিষয় আশয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং নিয়জিত হন সুফি সাধনায়। ১০৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দেন এবং সুফি সাধনার উদ্দেশ্যে ভ্রমনে বেড়িয়ে পরেন। নিজের মন মানসিকতা এই ব্যাপক পরিবর্তনের বর্ণনা গাজালি লিখে রেখে গেছেন তাঁর আল-মুনকিদহ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। নিজামুল মুলকের মৃত্যু শুধুমাত্র গাজালির জীবনেই প্রভাব ফেলেনি, প্রভাব ফেলেছে ওমর খৈয়াম এবং তৎকালিন অন্যান্য দরবারি বিদ্যানুরাগী ব্যাক্তিদের জীবনে। সুলতান মালিক শাহএর জন্যও এটা ছিল বিরাট এক আঘাত, এ ঘটনায় তিনি হারান তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং উপদেষ্টাকে।

একদিকে হাসিসিনরা আর অন্যদিকে মূর্তিমান বিপদের মতো এসে হাজির তখন ইউরোপীয় ক্রুসেডার’রা। এমন অবস্থায় মালিক শাহ ছিলেন নিজের নিরাপত্ত্বা নিয়েই ব্যস্ত। একি বছর মালিক শাহ নিজেও নিহত হন। তবে তার মৃত্যর কারন নিয়ে ইতিহাসে বিভিন্ন রকম বিবরন পাওয়া যায়। তার দরবারের পণ্ডিত ব্যাক্তিরা এসময় হয়ে পরে পৃষ্টপোষকতাহীন।

হাসান ইবনে সাবা এবং তার গুপ্ত ঘাতক গোষ্টি হাসাসিনদের নিয়ে সামান্য আলোচনা করা দরকার। আগেই বলেছি হাসান একজন বারপন্থী সিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ অরলেও মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইসমাইলি মতাদর্শে দীক্ষিত হন। ইসমাইলি মতাদর্শের তিনি ছিলেন একজন কঠোর অনুসারী। পর্বতের বৃদ্ধলোক হিসাবে পরিচিত হাসান ইবনে সাবা ইতিহাসের পাতায় নিঃসন্দেহে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। ইসমাইলিদের কাছে তিনি ছিলেন একজন মহানায়ক।

ইরানের কিংবদন্তিতে তিনি একজন খলনায়ক, যিনি তার বন্ধু নিজামুল মুলকের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং পরে দেশ থেকে বিতারিত হয়ে গুপ্ত সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজামুল মুলককে হত্যা করেন। আবার সিয়া, সুন্নি দুই সম্প্রদায়ের রক্ষনশীল মহলের অনেক পণ্ডিতই তাকে উল্লেখ করেন একজন ধর্মনিষ্ঠ অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসাবে। ক্রুসেডারদের কাছে হাসান ছিলেন একজন মুর্তিমান বিভীষিকা। ইসমাইলিয়া মতাদর্শ গ্রহণ করার পর হাসান কিছুদিন ইরানে অবস্থান করেন এবং গোপন কর্মকাণ্ড চালান। এরপর তিনি ইরানের বাইরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করেন এবং তার মতাদর্শ প্রচার করেন।

এরপর তিনি তৎকালিন ইসমাইলি খেলাফতের রাজধানী কায়রো পৌছান এবং সেখানে তিন বছর অবস্থান করেন। এসময় তিনি ইসমাইলি মতে পূর্ণাঙ্গ দীক্ষা লাভ করেন। ইরানে ফিরে এসে ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলামুত নামক পাহাড়ী দুর্গ দখল করেন। এই দুর্গ থেকেই তিনি তার মতাদর্শ প্রচার এবং রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় হত্যাকান্ডগুলো পরিচালনা করেন। তার অনুসারী হাসিসিনরা ছিল চরম মৌলবাদী ফ্যানাটিক।

হাসান ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর নিয়মনিষ্ঠা মেনে চলতেন এবং তার অনুসারিদেরও সেই শিক্ষা দিতেন। হাসাসিনরা অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অঙ্গনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মৃত্যুভয়হীন হাসাসিনরা একের পর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় গোষ্টির ভিত নাড়িয়ে দেয়। হাসাসিনদের যে পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তার বিভিন্নরকম বিবরণ পাওয়া যায়। এসব বিবরণ মতে, খুব কম বয়সেই তরুনদের হাসাসিন হিসাবে দীক্ষা দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো, তবে ঘুমন্ত বা অজ্ঞান অবস্থায়।

এদেরকে হাসিস দেয়া হতো। হাসিসের নেশা নিয়ে তরুনরা যখন জেগে উঠতো তখন তারা নিজেদের আবিষ্কার করতো অপরুপ সৌন্দর্যময় বাগানে, সেখানে তাদের জন্য থাকত সব রকম আরাম আয়েশের ব্যবস্থা, থাকতো সুন্দরী কুমারী তরুণী। তাদেরকে বলা হতো এই হচ্ছে বেহেশতের রূপ, মৃত্যুর পর এধরনের বেহেশতেই তারা ফিরে যাবে। হাসাসিনরা সচরাচর আনন্দ নিয়েই মৃত্যুর মুখোমুখি হতো, হত্যাকান্ডের পর তারা কখনো গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টা করতো না। ফিরে আসি গাজালির প্রসঙ্গে।

শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়ার পর তিনি শান্তির জন্য সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, হিজাজ প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। এর আগে তিনি যে আধ্যাত্মিক অস্থিরতা এবং সংশয়াবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার অবসান ঘটতে থকে এসময়। নিজামিয়া একাডেমিতে শিক্ষকতা করার সময়ই তিনি তৎকালিন সময়ের তাবৎ দর্শনের পাঠ সমাপ্ত করেন। গাজালির সংশয়বাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা তত্ত্বের ওপর। তার মতে, জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক উৎস ইন্দ্রিয়, কিন্তু ইন্দ্রিয় সবসময় সঠিক জ্ঞান দিতে পারেনা, যুক্তি বুদ্ধির মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা জানা যায়।

কিন্তু বুদ্ধিও কি সবসময় সঠিক জ্ঞান দিতে পারে? এমন কি হতে পারে না যে বুদ্ধির চেয়েও শ্রেষ্ঠ কোন জ্ঞানের উৎস আছে যার মাধ্যমে বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা প্রত্যক্ষ করা যাবে। স্বপ্নের মধ্যে যেমন সবকিছু বাস্তব বলে মনে হয় তেমনি মৃত্যর পরের জীবনের তুলনায় আমাদের এ জীবনও তো হতে পারে এক স্বপ্ন আর ভ্রান্তির জগত। এক পর্য্যায়ে তিনি গনিত এবং যুক্তিবিদ্যাকে জ্ঞানের অকাট্য উৎস হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। প্রজ্ঞার বদলে এসময় তিনি সুফিবাদী সজ্ঞাকেই জ্ঞানের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎস হিসাবে গ্রহণ করলেন, যে সজ্ঞা শুধুমাত্র বুদ্ধির মাধ্যমে অর্জন করা যায় না বরং অর্জন করতে হয় মরমী ভীতি এবং প্রেমের মধ্য দিয়ে। তার মতে, যে সজ্ঞার আলো তিনি লাভ করেন তা তার মধ্যে স্থাপন করেন স্বয়ং আল্লাহ।

গাজালির মধ্যে বেশকিছু আপাত স্ববিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। একদিকে তিনি সুফিবাদকে ইসলামে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেন অপরদিকে তিনি ছিলেন রক্ষনশীল ইসলামের সমর্থক, আবার একদিকে তিনি যেমন ছিলেন যুক্তিহীন বিশ্বাসের সমালোচক তেমনি কঠোর সমালোচনা করেন প্রচলিত সুফি ঐতিহ্যের। যুক্তিকে তিনি জ্ঞানের অকাট্য উৎস হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং কট্টর যুক্তিবাদী বলে দার্শনিকদের সমালোচনা করেন, আবার সেই দার্শনিকদের সমালোচনা করতেই তিনি বেছে নেন যুক্তির পথ। দার্শনিকদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আক্রমণ গড়ে তোলেন গাজালি যেই পুস্তকে সেই পুস্তকের নাম “তাহাফুতুল ফালাসিফা”। এই পুস্তকে যৌক্তিক পদ্ধতিতে দার্শনিকদের সমালোচনা করা হলেও এর প্রেরণা ছিল স্পষ্টই ধর্মীয়।

গাজালির নিজের বর্ণনা অনুসারে, “ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কতিপয় দার্শনিকের আক্রমণ এবং ধর্মীয় আচারাদিকে দার্শনিক বুদ্ধির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলে তাদের ঘোষণা-এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মূল উদ্দেশ্যেই এ গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে”। তবে ধর্মীয় প্রেরণায় লিখলেও এই পুস্তকে দার্শনিকদের বিরুদ্ধে যুক্তিকে কেন হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করলেন তার জবাব দিতে গিয়ে গাজালির বক্তব্য ছিল, তার আগে রক্ষনশীল ধর্মতাত্ত্বিকরা শুধুমাত্র শাস্ত্র আশ্রয় করে দার্শনিকদের সমালোচনা করতে গেছে যা মোটেও দার্শনিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযুক্ত না, দার্শনিকদের সমালোচনা করতে হলে তাদের মতই যুক্তিবিদ্যায় পারঙ্গম হতে হবে । তিনি প্রত্যক্ষভাবে ইবনে সিনা এবং আল ফারাবি আর পরোক্ষভাবে এরিস্টটল এবং প্লেটোকে আক্রমণ করেন এই পুস্তকে। এই পুস্তকে তিনি দার্শনিকদের সতেরটি কম ধর্মবিরোধী মত এবং তিনটি কঠোর ধর্মবিরোধী মতের কথা তুলে ধরেন এবং সমালোচনা করেন। যে তিনটি মতের তিনি কঠোর সমালোচনা করেন সেই তিনটি মত হচ্ছে জগতের অনাদিত্ব, আল্লাহর জ্ঞান এবং মৃত্যুর পর দেহের পুনরুত্থান বিষয়ে দার্শনিকদের মত।

এই তিনটি মতের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের অবস্থানের কারণে তিনি তাদের কাফির ঘোষণা করেন। জগতের অনাদিত্ব বিষয়ে দার্শনিকদের মতবাদ গাজালি খণ্ডন করেন এইভাবে যে দার্শনিকরা যে কার্যকারণ সূত্রের কারণে জগতের অনাদিত্ব দাবি করে সেই কার্যকারণ সূত্র অবশ্যম্ভাবী কিছু না। এর ব্যতিক্রম হতে পারেনা এমনটা ভাবার কোন যুক্তি নাই। তবে শাস্ত্রে যে আকস্মিক সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বলা আছে তার সপক্ষে তিনি কোন যুক্তি দাঁড় করাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের মতো সসীম মানুষের পক্ষে আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্বের অপার রহস্য অনুধাবন করা অসম্ভব”।

ইবনে সিনা প্রমুখ দার্শনিকের মতে, আল্লাহর জ্ঞান স্বার্বিকধর্মী, বিশেষধর্মী না। অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষ সম্বন্ধে সচেতন হলেও আলাদা আলাদা ভাবে ব্যক্তি মানুষ সম্বন্ধে সচেতন না। কোন কোন দার্শনিক আবার এমন মত প্রকাশ করেন যে, “সব প্রভুর প্রভু এনং সব কারণের কারণ আল্লাহ এ জগতে সংঘটিত কোনকিছুই জানেন না”। গাজালি এ মতকে চরম ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। গাজালি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান যে দেশ কাল নিরপেক্ষ সার্বিক জ্ঞান তা সত্য, তাই বলে তিনি দেশ কালের অন্তর্গত কোন বিশেষ ব্যাক্তিকে জানবেন না এটা গ্রহণযোগ্য না।

তার মতে, আল্লাহর অবস্থান অসীম এবং মানুষের অবস্থান সসীম জগতে হলেও আল্লাহ এবং মানুষের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, আল্লাহ যদি বিশেষ কোন মানুষকে নাই জানেন তাহলে ধর্মীয় প্রার্থনা আরাধনার মানে কি? তার মতে, দার্শনিকদের এধরণের তত্ত্ব ধর্মের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। একারণে তিনি দার্শনিকদের অভিহিত করেন ধর্মবিরোধী নাস্তিক বলে। মৃত্যুর পর দেহের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে দার্শনিকদের মতবাদ গাজালি খণ্ডন করেন এইভাবে যে, দেহ আর আত্মার সৃষ্টি সব রহস্যের চেয়ে বড় রহস্য, সব অলৌকিক ঘটনার বড় অলৌকিক ঘটনা। এহেন অলৌকিক ঘটনা যদি আল্লাহর পক্ষে ঘটানো সম্ভব হয় তাহলে মৃত্যুর পর দেহের পুনরুত্থান ঘটানোও আল্লাহর পক্ষে সম্ভব।

এক্ষেত্রেও তিনি দার্শনিকদের কার্যকারণ সূত্রের সমালোচনা করেন এই বলে যে, কার্যকারণ সূত্র যৌক্তিক ভাবে কোন আবশ্যিক বিষয় না। গাজালি দার্শনিক মতবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল যে আক্রমণ রচনা করেন সেই আক্রমণ ছিল কার্যকারণ সূত্রের বিরুদ্ধে। এরিস্টটল-প্লেটো হয়ে মুসলিম দার্শনিকদের হাত ঘুরে এমনকি আধুনিক ইউরোপে যে কার্যকারণ সূত্র টিকে ছিল দর্শনের অন্যতম অস্ত্র হিসাবে গাজালি সেই কার্যকারণ সূত্রের আবষ্যিকতাকেই অস্বীকার করেন। তৎকালিন সময়ে গাজালির সমকক্ষ এমন কেউ ছিলনা যিনি এক্ষেত্রে গাজালির মতের খণ্ডন করতে পারেন। আরো বহু পরে অবশ্য ইবনে রুশদ “তাহাফুতুল ফালাসিফা” গ্রন্থের সমালোচনা করেন।

রুশদ বলেছিলেন, যে কার্যকারণ সূত্রের মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়, সেই কার্যকারণ সূত্রকে অস্বীকার করে গাজালি আল্লাহর অস্তিত্বের যৌক্তিক সম্ভাবনাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। (চলবে)
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.