রঙ লাগানো সে বারান্দাটি ছিল উজ্জ্বল। আমি হাঁটছিলাম। এক জোড়া তরুণীর প্রতি আমার চোখ আটকে যায়। তারা আমার দিকে তাকায়। মিটিমিটি হাসে।
যেমনটা হাসে আমার নিজের মেয়ে। তারা আমার মেয়ের বয়সী। যথাক্রমে ১৭ ও ১৫। আমার মেয়েরা মেকআপ ও পোশাক পরতে লম্বা সময় নেয়। বোঝাই যায়, মেকআপ করতে তারাও বেশ সময় দিয়েছে।
তাদের দেখতে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমি তাদের মুখের দিকে তাকাই। দেখি সেই প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা, যা আমরা নিজের গৃহকোণে দেখি।
কিন্তু এই তুলনাটা আর এগিয়ে নেয়া যাবে না। আমাকে থামতে হবে।
কারণ, আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি ফরিদপুরে। পদ্মা নদীর তীরে। বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে। আর ওই তরুণীরা সবাই যৌনকর্মী।
প্রতি দিন তারা চার বা পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে শয্যায় যায় প্রতিবার এক শ’ টাকা বা একটি পাউন্ডের বিনিময়ে।
তবে কথা হলো এখানে কিন্তু ওদের জীবনে টাকাকড়ি নিজের মতো করে খরচের সুযোগ নেই। কারণ, ওদের বেশির ভাগই ‘ছুকরি’। এর মানে হলো এই বন্দিনীদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয়েছে। তাদের বিক্রি করা হয়েছে মাসীদের কাছে। পতিতালয়ের মালিকরাই সব উপার্জন হাতিয়ে নেয়।
ফরিদুপরের এই পতিতালয় ভয়ঙ্কর, নোংরা ও জরাজীর্ণ। আপনি এখানে পৌঁছাতে চাইলে আপনাকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরম্নতে হবে। পথ বন্ধুর। এঁকেবেঁকে গেছে মেঠোপথ। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা কিছু।
কেউ বিক্রি করছে ধূলিময় কোমল পানীয়র বোতল। আপনি যখন পথ চলবেন, তখন আপনাকে বিস্মিত চোখ তাড়া করবে। কারণ, এই ফরিদপুরে পাশ্চত্যের মানুষেরা মস্ত আগন্তুক বটে।
পতিতালয়টি অনেক বড়সড়ো। দুর্গতুল্য ইমারতে ৮০০ বালিকার নিবাস।
ছোট ছোট খুপরির মতো কক্ষ। প্রতিটিতে জানালা আছে। কিন্তু তা খেলা নয়। বন্ধ। এসব কক্ষে বিছানা পাতা।
দু’জনা শুতে পারে। এখানেই বালিকারা তাদের খদ্দের আনে। রাতে প্রতি কক্ষে দু’জন ঘুমায়। যখন একজন তার খদ্দের নিয়ে হাজির হয়, তখন অন্যজনের স্থান সঙ্কুলান হয় না। খদ্দেরদের বড় অংশ অন্য এলাকার লোক।
তারা ইটভাটায় কাজ করে। আমার কাছে একটা বিস্ময় বড় খটকা লাগলো। এই মুসলিম দেশটিতে পতিতালয় চলছে। আমি আমার দোভাষীর কাছে জানতে চাই। তিনি বলেন, অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে ব্রিটিশ আইনে এসব পতিতালয় সৃষ্টি হয়েছিল।
এখানে ঢুকতেই শব্দ, ধ্বনি, গন্ধ শুঁকে টের পাবেন আপনি কোথায় এসেছেন। এক জোড়া কপোত-কপোতী মিলিত হয়েছিল। তাদের দরজার খিল বন্ধ। অন্য দরজা দিয়ে উদিত হলেন এক বৃদ্ধ। তার মুখে মিষ্টি লেগে আছে।
এক কোণে দেখলাম রাশি রাশি কনডম।
এই পতিতালয়ের এক বারান্দায় আমি হাঁটতে হাঁটতে ওই দুই বালিকার দেখা পাই। যাদের দেখে আমি আমার মেয়েদের কথা ভাবছিলাম। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। কিন্তু তারা তো তাল মেলাতে পারছিল না।
এরপর অকস্মাৎ সেখানে হাজির হয় আর এক কিশোরী। তার বয়স আমার ছোট মেয়েটা, যারা বয়স ১২ হয়নি, তার চেয়ে একটুও বড় হবে না। সঙ্গী আলোকচিত্রী এলেন। আমি বললাম, জিজ্ঞাসা করুন তার বয়স কত? আলোকচিত্রী বাংলায় কথা বললেন। মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
তার বয়স ২২। আমরা সবাই হাসলাম। অনুমান ভুল। অথচ মেয়েটির উঠতি স্তনযুগল ও সলাজ হাসি নিশ্চিত করছিল তার বয়স আমার ছোট মেয়েরই সমান।
এই ২০১০ সালের কোন এক অভিশপ্ত সময়ে এই নিষিদ্ধ পুরীতে তার প্রবেশ।
হয়তো সারা জীবনের জন্য। সে শুরু করেছে এক যৌনদাসীর জীবন। তবে এখানে তার জীবন শুরু হলো এমন এক প্রেক্ষাপটে যে নতুন বিভীষিকা তার অজানা।
এটা এক নতুন আতঙ্ক। পতিতালয়ের বাসিন্দাদের জীবনে এই বিভীষিকা ছোবল হেনেছে।
ওষুধটির নাম ওরাডেক্সন। এটি এমন এক ওষুধ যেটি গরু মোটা তাজাকরণে ব্যবহার করা হয়। অথচ এই ওষুধটি এখন বাংলাদেশের প্রতিটি পতিতালয়ে নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাসীরা কিশোরীদের এটা সেবন করায়। এর ফলে তাদের দেখতে পরিপক্ব ও স্বাস্থ্যবতী দেখায়।
এটা আরও কাজ দেয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়ার কাজেও লাগে। কারণ, বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে যৌনকর্মী হওয়া চলে না। কিন্তু এখানে আমি অনেককে দেখলাম, যাদের বয়স আঠারোর নিচে।
কেউ বলতে পারেনি এখানে কবে থেকে সর্দারনীরা ‘ওরাডেক্সন’ সেবন বাধ্যতামূলক করেছে।
তবে এটা তারা যথেচ্ছ সেবন করাচ্ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কথা, এই ওষুধের যে দীর্ষমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে সে বিষয়ে সর্দারনীরা মেয়েদের অন্ধকারে রাখছে।
অ্যাকশন এইড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে সবেমাত্র একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে তারা বলেছে, ১৫ থেকে ৩৫ বছরের বয়সীদের মধ্যে ওরাডেক্সন খাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অ্যাকশন এইডের ঢাকা অফিসে কর্মরত লুৎফুন নাহার জানালেন, ‘এই ওষুধ সস্তা ও সহজলভ্য।
’ নাহার তাদেরই একজন, যারা সর্বপ্রথম চিন্তাভাবনা শুরু করেন যে, পতিতালয়ের মেয়েরা এত মোটা তাজা হচ্ছে কি খেয়ে। তিনি পতিতালয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জানতে পারেন মেয়েরা ওরাডেক্সন খাচ্ছে।
নাহার বলেন, ‘পতিতালয়ের মালিকরা ওরাডেক্সনকে আকাশের চাঁদ হিসেবে দেখছে।
’ ১২ ও ১৩ বছরের মেয়েদের তারা ‘বড়’ করে তুলতে পারছে। কমবয়সী মেয়ে তারা কম টাকায় পায়। আর তাদের বাড়ন্ত করে বেশি টাকা কামায়। নাহারের কথায়, ‘ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, প্রচণ্ড মাথাধরা, পাকস্থলির যন্ত্রণা, ক্ষুধামন্দা, চামড়ায় ফোসকা পড়া। ’
অ্যাকশন এইড এখন এই ওষুধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে।
কারণ, এই ওষুধ যারা সরবরাহ করছে, সেই সাপ্লাই চেইন বন্ধ করা বেশ দুরূহ। মেয়েদের একই সঙ্গে বোঝানো হচ্ছে তারা যেন এইচআইভি রোধে কনডম ব্যবহার করে। অ্যাকশন এইডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফরিদপুরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রধান ডা. বশিরুল ইসলাম বললেন, ‘ওরাডেক্সন ভয়ানক বিপজ্জনক বলে গণ্য হতে পারে। এটা আসলে অত্যন্ত কঠিন সমস্যার জন্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। এটা এক ধরনের স্টেরয়েড হরমন, যা ‘ইনফ্লেমেটরি ডিজঅর্ডার’ সারাতে ব্যবহার করা হয়।
’ তিনি বলেন, ‘এটা ব্যবহারের ফলে ফরিদপুরের এই পতিালয়েরর মেয়েদের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। তাদের দেহে স্বাভাবিক হরমন উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ’
১৯ বছরের আশার সঙ্গে কথা হলো। সে তাদের একজন, যারা ওরাডেক্সন সেবন করে আসছে।
দু’বছর ধরে সে পতিতালয়ে আছে। তার সঙ্গে কথা বলার শুরম্নতেই আশা আমাকে বোঝাতে চাইলো সে এখানে স্বেচ্ছায় এসেছে। কেউ তাকে জোর করেনি। আমি বুঝলাম। কারণ, আমাকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, তারা সবাই একই গল্প বলবে।
তাদের মাসীরা তাদের বলে দিয়েছে, তারা যেন তাদের কিংবা তাদের পরিবারের কারও বিরুদ্ধে নালিশ না করে।
‘আমি এক বছর আগে গরুর ওষুধ সেবন শুরু করি। আমি প্রতিদিন দু’টি ট্যাবলেট নেই। ’ আশা আমাকে একথা জানায়। অন্য মেয়েরা বলেছে, তারা এই ওষুধ সেবনে না করেছিল।
কিন্তু মাসীরা তাদের বলেছে এই ট্যাবলেট সেবন করতেই হবে। এটা হলো সুন্দরী হওয়ার বটিকা। আশা বলেন, ‘খদ্দেররা আমাদের পুষ্ট দেখতে চায়। আমি যখন এই ওষুধ নিতে শুরু করি, তখন একটু ঢলঢল ভাব এলো। ’ তার কণ্ঠে হতাশা- আমার সংসার হবে না।
কেউ আমাকে বিয়ে করবে না।
জুয়াইনা বেগমের (৩০) গল্প ভিন্নরকম। তিনি ওরাডেক্সন সেবন করছেন পাঁচ বছর হলো। আগে ছিলেন হালকা পাতলা। এখন মোটাসোটা।
তিনি বলেন, আমি দিনে দুই বা তিনজন খদ্দের পাই। কিন্তু এটা নির্ভর করে খদ্দেরদের চোখে আমাকে কতটা ভাল দেখায় তার ওপর। তার ধারণা, ‘ওরাডেক্সন খাওয়ার ফলেই তাকে সুন্দর লাগে। ’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কেন এটা নিতে শুরু করলেন? তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘এখানে থাকতে হলে অবশ্যই এ ওষুধ খেতে হবে। তাছাড়া আমার শরীর এখন এই ওষুধ খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এটা এক নেশা। না খেলে শরীর কাজ করে না। তাই আমি এটা এখন ছাড়ার কথা ভাবতেও পারি না। ’
ফরিদপুরে আমি যে পতিতালয়ে গিয়েছিলাম সেটি ছোটখাটো। এখানে প্রায় ১৭৫ নারীর বাস।
আমি বাংলাদেশে শেষ সন্ধ্যার বেশির ভাগ সময় কাটাই পায়েলের সঙ্গে। তার বয়স ১৫।
পায়েল আমাকে বলেছে সে কখনও স্কুলে যায়নি। সে দ্বিতীয় প্রজন্মের যৌনকর্মী। এক পতিতার মেয়ে।
বারো বছর বয়স হতেই তাকে ‘কাজে’ নামতে হয়েছে। অন্য একটি পতিতালয় থেকে গতকালই সে এখানে এসেছে। ‘গতকাল ছিল হাটবার। তার দশজন খদ্দের জুটেছিল। পায়েল বারবার জানতে চায় আমার মেয়েদের জীবনগাথা।
লন্ডনে তারা কিভাবে বড় হচ্ছে। তার চোখেমুখে অবাক কৌতূহল ঝরে।
যখন যাওয়ার সময় হলো পায়েল আমার হাতে হাত রাখে। হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত আসে। আমি কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হই।
হঠাৎ বাস্তবে ফিরি। পায়েলের দিকে তাকাই। দোভাষী বুঝতে পারেন। জানতে চান, আপনি কি পায়েলকে খুঁজছেন? সে এই তো চলে গেল। তাকেই অবশ্যই যেতে হবে।
আমি পেছনের দিকে তাকাই। বুঝতে পারি মেয়েটি পায়েল। ফিরে যাচ্ছে। তার পাশে হাঁটছে একজন ট্রাকচালক ধরনের লোক। হঠাৎ আমি চমকাই।
পায়েল ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হাত নাড়ে সে। তার মুখে হাসি অম্লান। কাঁধ ঝাঁকায়। আমাকে তার বিদায় অভিবাদন।
পায়েল হয়তো আমাকে বলেছে, ‘এই তো আমার জীবন। ’ পায়েল এরপর তার খদ্দেরের দিকে তাকায়। ফিরে চলে একত্রে।
মূল সূত্র : THE GURDIAN
অনুবাদঃ মানবজমিন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।