টানা আটদিন বঙ্গোপসাগর আর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম পাকি বন্দর করাচী । পথে বেশ ভালই কেটেছে । সাগর ছিল শান্ত, একেবারে ডাইনিং টেবিলে সাজানো একগ্লাস ঠান্ডা পানির মতই। নভেম্বর - ডিসেম্বর মাসে আবহওয়া এমনই থাকে। ভারত আর শ্রীলংকার পাশ দিয়ে আসার সময় টিভিতে মেলা অনুস্ঠান দেখতে দেখতে এসেছি।
অনেকদিন সাগরে থাকার পর মাটিতে পা রাখার রোমাঞ্চ আর মজাটাই আলাদা, যা লিখে প্রকাশ করা যাবেনা - শুধু হৃদয় দিয়েই তা অনুভব করা যেতে পারে।
তবে এই করাচীতে নামাটা আমার কাছে সম্পুর্ণ অন্য ধরনের মনে হয়। এখানে এলেই মনে হয় এদেশের মানুষেরা কত নিস্ঠুর অমানুষিক ভাবে আমাদের দেশে হত্যা, লুন্ঠন আর ধর্ষণ করেছিল। একধরনের ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠে।
তবে পাকিদের দিক থেকে লক্ষ্য করেছি, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর পাকিস্তান থেকে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোর ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াবিহীন।
তাদের সামনে পড়লেই তারা লম্বা একটা সালাম ঠুকবে আর হাতদুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, " খোশ আমদেদ, আইয়ে আইয়ে বৈঠিয়ে, ক্যায়সা হালচাল হ্যায়?"
তারেক রোডে যাবো শপিং করতে, তো পথ চিনিনা, এক পাকিকে জিজ্ঞাসা করলাম পথের ঠিকানা, বললাম, " আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, এদেশে নতুন, তারেক রোডটা কোন দিকে বলতে পারো?"
সে পাকি তো মহানন্দে বললো, " আরে, তুমি আমার দেশের মেহ্মান, এসো এসো, তোমাকে বাসে করে তারেক রোডে পৌঁছে দিই। " সে আমাকে বাসে তুললো, পকেট থেকে ভাড়াটাও দিলো তারপর তারেক রোডে পৌঁছে দিয়ে বললো,"এই তোমার তারেক রোড, এবার তুমি অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি। "
ভাবলাম ব্যাটা আমার জন্য এত খাটলো, ওকে একগ্লাস বেদানার সরবৎ খাওয়াই।
সরবৎ খাওয়ার কথা শোনা মাত্র সে বললো, "তুমি আমার দেশের মেহ্মান, আমারই উচিৎ তোমাকে সরবৎ খাওয়ানো। "
এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল, যাহোক, অনেক কষ্টে তাকে সরবৎ খাইয়ে বিদায় দিয়েছিলাম।
তারপর বাজার সওদা করতে শুরু করলাম। যেখানেই যাই ব্যাটারা কিভাবে যেন বুঝে যায় আমি বাংলাদেশী, আর ওমনি শুরু করে স্পেশাল খাতির। একবারো প্রকাশ করে না যে তারা একাত্তরে কি অত্যাচারটা করেছিল আমাদের উপর।
বাজার সওদা শেষ করে খাওয়াটাও সেরে নিলাম। তারপর একটা হলুদ ক্যাবে উঠলাম।
মাঝবয়সী ড্রাইভারকে জাহাজের ঠিকানা দিয়ে বললাম সেখানে নিয়ে যেতে। চলতে চলতে তার প্রশ্ন আমি বাঙ্গাল মুলুক থেকে এসেছি কি না।
আমার হ্যাঁ সূচক জবাব শুনে সে খুশীতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো," ম্যায় ভি উধার থা। "
"কখন তুমি বাংলাদেশে ছিলে"?
"কেন, ঐ যে তোমাদের যুদ্ধের সময়। "
"কি করতে বাংলাদেশে?"
"কেন, যুদ্ধ করতাম।
"
ভাবলাম সে বোধহয় পাকি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল।
ততক্ষণে সে সগর্বে বলেই যাচ্ছে, "আমি পূর্বপাকিস্তানে রাজাকার ছিলাম। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব আর অখন্ডতা বজায় রাখতে গিয়ে কি লড়াইটাই না লড়েছিলাম তখন। এই শালার ইন্ডিয়ার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটাকে সঁপে দিয়েছিলাম শহীদের দরজায়। দেশ বাঁচাতে পারিনি শুধু ঐ নিমখারাম মাদার- - বেঈমান মুক্তিবাহিনীর জন্য।
এই মুক্তিবাহিনীর জন্যই ইন্ডিয়া যুদ্ধে জিতে যায়, আমরা হারাই পূর্বপাকিস্তান আর তোমরা বাঙ্গালীরা হয়ে যাও ইন্ডিয়ার গোলাম। "
এবার সামান্য একটু বুঝতে পারলাম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানীদের ধারনাটা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।