আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবীন্দ্র রসবোধ (১)

. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেড়াতে গেছেন বরানগর। আতিথ্য নিয়েছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশদের। এখানে এসেও রক্ষা নেই। একটি বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যাবহারের অনুমতি নিতে হাজির হলেন সংগীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল। সাথে শিল্পীও।

উদ্দেশ্য, কবিকে গানটি শুনিয়ে তবেই অনুমতি নেবেন। নির্দিষ্ট দিন-ক্ষনে বেশ আয়োজন করেই কবিকে গান শোনানো হচ্ছে। শিল্পী চলচ্চিত্রের জন্য নির্বাচিত গান,’কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি” গাইছেন, ভালই গাইলেন। কিন্তু গানের একটি জায়গায় এসে ‘ভালোবেসেছিনু’ শব্দটিতে দীর্ঘ টান দিলেন। সুরের এই পরিবর্তনে হতচকিত রবীন্দ্রনাথ।

জানতে চাইলেন, ‘এ রকম সুরই যে আমি করেছি, তা তো মনে পড়ছেনা। এটা কোথায় পেলে বলতো? শিল্পী করজোড়ে জানালেন, ছবির একটি দৃশ্য আছে, সেখানে স্বামী তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর সমাধির পাশে বসে গানটি গাইবেন। স্বামীর দুঃখভাব ভালোকরে প্রকাশ করার জন্য এই অতিরিক্ত টান। ঐ দৃশ্যের জন্য সেটা দরকার ছিল! শিল্পীর যুক্তিতে কবি বাক্যহারা। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুমতি মিলল।

সবাই বিদায় নেবার পর কবির স্বগতোক্তি ‘কী জানি বাপু, কার কবে স্ত্রী মারা যাবে আর তার সমাধিতে বসে কে গান গাইবে- এই ভেবে তো আর গানটি লিখিনি। কী যে সব ব্যাখ্যা হয়’। _________________________________________________ কবিতা ও প্রেসক্রিপশন ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেছেন দার্জিলিং এ। দেশবাসী শোকে পাথর। সেদিন সকালেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে হাজির প্রখ্যাত চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়।

সদলবলে। তিনি কবির কাছে সবিনয়ে প্রস্তাব করলেন দেশবন্ধুর মৃত্যু উপলক্ষে একটি পদ্য রচনা করে দিতে। প্রস্তাব শুনেই কবি কিছুটা ক্ষুদ্ধ হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃত্যুশোকের সঙ্গে কবিতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে’? উত্তরে বিধানচন্দ্র বিনীত ভাবে বললেন, ‘আজ্ঞে,আপনার জন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়’। কবি উত্তর দিলেন ‘তুমি কি ভাবো যে তোমাদের ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়ার মত করে কবিতা লেখা যায়? আমার তো বাপু সে রকম কোনো ফর্মুলা জানা নেই’।

উপস্তিত সবাই চুপচাপ। কবি কিছুটা নরম হলেন। বললেন ‘ দাঁড়াও দেখি কী করা যায়’। বলেই চলে গেলেন পাশের ঘরে। মিনিট পনেরো পর ফিরে এলেন।

হাতে দুই লাইনের একটি পদ্য। “এতেই যদি হয় যদি তা হোক”। __________________________________________________ একটু আর্লি হয়ে গেল না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম বিশ্বাষভাজন বুলা মহলানবিশ স্বপরিবারে হাজির শান্তিনিকেতনে। দম্পতিটির সাথে খানিক আলাপের পর কবি তাঁদের চার বছরের কন্যাটির সাথে আলাপে সচেষ্ট হলেন। নানা প্রশ্ন তার উদ্দেশ্যে, কী করো তুমি সারা-দিন? কী পড়ছো? এর মাঝে প্রশ্ন করলেন, ‘গান করতে পারো তুমি? কন্যার পিতা-মাতা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘পারে বৈকি, আপনার গানই তো শোনে সারাক্ষন।

তাঁদের কথা শুনে উ|সাহী কবি সে সময়ে রেকর্ডে বহুল প্রচলিত “প্রলয় নাচন নাচলে যখন” গানটি খুকুকে গাইতে বললেন। ছোট মনে কী ছিল কে জানে? খুকুর উত্তর ছিল “নাহ্! ওটা গাই না”। ও গানটা পঁচে গেছে”। কন্যার এ উক্তিতে পিতা-মাতা স্তম্ভিত, লজ্জিত। কবি নিজেও অবাক।

তাঁর একটাই প্রশ্ন “এ আবার কী কথা গো, পঁচে গেছে”? “গান আবার পঁচে যায় নাকি? জানিনে বাপু, গান যে কী ভাবে পঁচে যায়”? পিতা-মাতা কে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে কবি বললেন, “বেশ তো তোমার যা ভালো লাগে, সে গানই শুনাও”। তখন খুকু নৃত্যনাট্য “চিত্রাঙ্গদা” থেকে “কেটেছে একেলা বিরহের বেলা” গানটি গেয়ে শুনালো। গান শুনে কবি আনন্দিত কবি বললেন, “খুবই ভালো হয়েছে, খুব ভালো গেয়েছে। কিন্তু একটু আর্লি হয়ে গেলো না”? ........................................................................ কবি তখন মংপু তে মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্যে। একদিন ডাকে এক বোতল মধু এল।

শিশিটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কবি মৈত্রেয়ী দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন, “ওগো মাংপেবী তোমায় মধুর কবিতা লিখে দিলুম, তুমি দিলে প্রবাসীতে ছাপিয়ে, সবাই ভাবলে, এই হচ্ছে কবিতা লিখাবার সহজ উপায়,- পাঠাও একে মধু। তাই শুধু মধুই আসছে। কেবল মধু যে কবিতার ইন্সপিরেশন যোগায় না, তা তো অ-কবিদের জানা নেই। রথীন্দ্রনাথ বললেন, তার চাইতে আপনি যদি চাল ডাল নিয়ে কবিতা লিখতেন সে আরো ভালো হতো, সংসারের খরচ অনেকটা বাঁচত।

মুখচোরা মনমোহন বাবু(মৈত্রেয়ীর স্বামী) দরজার আড়াল থেকে বললেন, বধু নিয়ে কবিতা লিখলে তো মুশকিল হয়ে যেত। তখন শুধু বধু আসত”। ........................................................................ মৈত্রেয়ী দেবী একদিন কবিকে বললেন, “আপনার একটা কলম কিন্তু আমায় দিতে হবে”। কবিগুরু গম্ভির ভাবে পিছনে ফিরে বনমালীর দিকে ফিরে বললেন, “ওরে, এ কথায় এলুম? আর নয়, এবার বাক্স-টাক্স বেঁধে ফেল্। নৈলে আর সঙ্গে কিছু নিয়ে ফিরতে হবে না’।

কবিগুরু মৈত্রেয়ী দেবী কে একটা পেলিকেন কলম দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে এক টুকরো কাগজে লিখা দলিলপত্র—তাতে লেখা ছিলো----- সুরেল, দার্জিলিং আমি বিখ্যাত ঠাকুরবংশোদ্ভব কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতি মৈত্রেয়ী দেবীকে অদ্য পুন্য জৈষ্ঠমাসের “কৃষ্ণা দশমী তিথিতে” দিনমানে পূর্বাহ্নে ইংরেজি নয় ঘটিকায় পেলিকান রচিত একটি উৎস লেখনী স্বচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে দান করিলাম। তিনি ইহা পুত্র-প্রপৌ্ত্রদিক্রমে ভোগ করিবার অধিকারিনী হইলেন। তিনি যদি ইহার পরিবর্তে তাঁহার কোনো একটি অক্ষুন্ন লেখনী আমাকে দান করেন, আমি অসংকচে তৎখনাৎ তাহা গ্রহন করিতে পারি ইহা সর্বসমক্ষে স্বীকার করিলাম। কদাচ অন্যথা হইবেনা।

চন্দ্র সূর্য সাক্ষী। ৯ই জৈষ্ঠ ১৩৪৫


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।