রবিঠাকুরের কবিতায় আমিত্ব
[অল্প পানির মাছ নাকি বেশি লাফায়| খাঁচায় বন্দী পাখির শুনেছি আকাশ সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান| বিজ্ঞজনেরা হয়ত এই লেখার সমালোচনা করারও প্রয়োজন বোধ করবেন না| একুরিয়ামের মাছেরো তো সমুদ্র অবগাহনের সাধ হয়, খাঁচায় বন্দী পাখিরও তো মেঘের সাধে মিতালীর সখ হয়| বোধ করি আমারও রবিঠাকুরের কবিতা নিয়ে লেখার সাধ ও সখ উভয়ই হয়|]
বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোমান্টিক কবি | আঠারো শতকের শেষের দিক থেকে যখন প্রচন্ড শিল্পবোধ মানুষকে তাড়িত করা শুরু করে তারই স্ফুলিঙ্গ দেখা যায় তার লেখনীতে | 'আমার আমি' বা 'me on mine' রবিঠাকুরের চেতনার মধ্যে ছিল | আমার আমি বোধের একটি নিদর্শন --
"আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুন্নি উঠল রাঙ্গা হয়ে
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠল আলো পুব পশ্চিমে
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর'
সুন্দর হল সে | "
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এই কবিতাংশ সম্পর্কে এভাবেই ব্যক্ত করেন--
"কথাগুলো সুন্দর, কিন্তু এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে রোমান্টিকের ভয়ংকর আমিময়তা বা অহমিকা | তিনি কোন কিছুকেই বস্তুগতভাবে মেনে নিচ্ছেন না, স্বীকার করছেন না কারো নিজস্ব বৈশিষ্টকেই; সব কিছুতে তিনি সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন নিজেকে | পান্না চুনির নিজস্ব রং যেমন স্বীকার করছেন না, তেমনি স্বীকার করছেন না সূর্যকে ও গোলাপের সৌন্দর্যকে; তাঁর কাছে এসবই তার নিজের সত্তার সম্প্রসারণ |"
কর্তৃবাচ্যের এই প্রাধান্য কবির লেখনীতে বারবার চোখে পড়ে | 'দুই বিঘা জমি' তে কবি যখন নিজেই উপেন হন, তার মাঝে যে দারিদ্র্য-দীনতা-অসহায় ফুটে উঠে তার প্রভাবেই তিনি কেঁদে উঠেন --
"কহিলাম আমি, তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই
চেয়ে দেখো মোর আছে বড় জোর মরিবার মত ঠাঁই |"
আবার যখন স্ফুলিঙ্গে গেঁয়ে উঠেন--
"আমি ছিলাম যে বনে সেথায়
গোলাপ উঠিল ফুটে
'ভুলে না আমায়' বলিতে বলিতে
কখন পড়িল লুটে | "
এখানে ফোঁটা গোলাপের সৌন্দর্য মুখ্য নাকি 'গোলাপকে কবির মনে রাখাটাই' প্রধান সেটা আমীমাংসিত প্রশ্ন | কিন্তু ভুলো না আমায় যে একেবারে ফুটন্ত গোলাপের কাছে নগণ্য নয় তা খোলা চোখেই বোঝা যায় | তাই কবি প্রকৃতি পূজারী হয়েও দেবতা, তাপসী হয়েও ভোগবাদী |
কবি কখনো দ্রোহী | কখনো মনে মনে তিনি শিকল ভাঙতে চান | নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে তিনি ব্যাকুল | বিস্ময়ে-বিদ্রোহে-যন্ত্রনায় কবি নিজেকে করেন প্রকাশিত |
"আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগত প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা |"
আধুনিক চেতনার একটি বড় দিক হচ্ছে এই আমিত্ববোধ | মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগকে যেসব বৈশিষ্ট দিয়ে পৃথক করা হয় তার মধ্যে এই আমিত্ব বা আরো বিশাল অর্থে ব্যক্তি স্বাধীনতা কে উল্লেখ করা হয় | আমার মাঝে আমি ই সেরা | এই বোধ বোধ-করি প্রত্যেক মানুষের মাঝেই বিরাজ করে | কিন্তু এর প্রকাশ দুঃস্বাধ্য | রবি ঠাকুর যা করে গেছেন অনায়াসে |
কবির 'আমিত্ব' সবসময় যে প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী হবে তা কিন্তু নয় | কবি কখনো ভুগেছেন প্রচন্ড একাকীত্বে | কখনো বা কবি হয়েছেন স্বপ্নচারী | পরিচয়হীনতা প্রায়ই তাকে গ্রাস করেছে | নিমেষে তিনি বলে উঠেছেন --
"আমি এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষে বই,
আমি আমারে চিনি নে, তোমারে জানি নে,
আমার আলয় কই |"
আমার আমি কে চেনার সেই সুপ্রাচীন দুঃস্বাধ্য অভিপ্রায় কবির মাঝে লুক্কায়িত ছিল | তাই আপন আলয় নিয়ে তিনি সন্দিহান | কবির এই একাকীত্বের পিছনে আছে তার স্বপ্নিল নিস্বঃঙ্গ জগত , যেখানে একই মঞ্চে মঞ্চায়িত হচ্ছে চেনা নাটক অচেনা কুশীলবে | আর সেই কুশীলব সবই কবি নিজে | তাই নিজেকে তিনি প্রকাশিত হতে দেখেন হরেক রূপে, হরেক ভাবে, হরেক স্বভাবে | আবারো অবাক ভাবে দেখি কবিকে নিজের পরিচয় স্বন্ধানে ব্যস্ত –
“সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া |
দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া |”
কবির এই স্বপ্নিল জগতে কখনো ঝড় উঠে | কবি নিজেকে আবিষ্কার করেন অবহেলিত ,প্রচন্ড অসহায়তায় ভুগেন তিনি |অন্তর্নিহিত সম্পদ কে লুন্ঠিত হতে দিতে চান না | আকুতি ফুঁটে উঠে –
“একখানি ছোট খেত আমি একেলা”
অথবা,
“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়াছে ভরি|”
কবি অবগাহিত আমিত্ববোধের বিশাল আবেগে| যেখানে এক রাজ্য, এক পৃথিবী| যেখানে এক রাজা এক কবি, যেখানে দ্রোহে কবি, প্রেমে কবি, জন্মে কবি, মৃত্যুতে কবি, চেতনায়-সঙ্গীতে-মননে কবি নিজেকেই খুঁজে পান| যেখানে কবি স্ববিরোধী| কবি আহবান জানান, কখনো অবজ্ঞা করেন আবার কখনো অনুরোধে সিক্ত হন| বলে উঠেন—
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে”
অথবা,
“মরণরে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ”
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।