আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চা (পর্ব-৬)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
ইবনে সিনা পরিচয় ও কর্মযজ্ঞঃ মুসলিম দার্শনিক/বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সুপরিচিত যিনি তিনি হলেন ইবনে সিনা। এ খ্যাতি তার প্রাপ্য খ্যাতি। বিরল প্রতিভার অধিকারি এই মহামতির পুরো নাম আবু আল হুসাইন ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭), ইউরোপে তিনি পরিচিত ছিলেন আভিসিনা নামে। তাকে গণ্য করা হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একজন হিসাবে। তার লিখিত ১৪ খন্ডের পুস্তক আল কানুন ফি আল তিব্ব (The Canon of Medicine) চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক হিসেবে গণ্য হয়েছে ১৮ শতক পর্যন্ত।

আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার বহু তত্ত্ব এবং প্রয়োগের আদি পিতা মানা হয় তাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়াও তিনি বিখ্যাত ছিলেন দার্শনিক হিসাবে। মূলতঃ আল-ফারাবির ভাবশিষ্য হিসাবে দর্শন চর্চা শুরু করলেও আল-ফারাবিকে তিনি ছাড়িয়ে যান কর্ম এবং খ্যাতি দুই দিক থেকেই। আল-ফারাবির দুর্বোধ্য বক্তব্য সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেন ইবনে সিনা, এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম দর্শনের সবচেয়ে শক্তিশালী ধারা যেই ধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন আরবের আল-শাহরাস্তানি, আল-রাজি(দ্বিতীয়), আল-তুসি প্রমুখ এবং ইউরোপের থমাস একুইনাস, দান্তে ছাড়াও ফ্রান্সের প্রাক আধুনিক দার্শনিক চিন্তাজগতের বেশ কয়েকজন গুরু। বহু বিষয়ে পন্ডিত ইবনে সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং দর্শন ছাড়াও যুক্তিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং ভূতত্ত্বে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ন অবদান।

অনেকেই তাকে অভিহিত করেন ভূতত্ত্বের জনক বলে। তিনি ৪৫০টির মতো পুস্তক রচনা করেন যার মধ্যে ২৪০টি এখনো টিকে আছে। টিকে থাকা পুস্তকগুলির মধ্যে ১৫০টি দর্শনের এবং ৪০টি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর রচিত। দর্শন বিষয়ক তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকের নাম কিতাব আল-সিফা। কিতাব আল সিফাকে গণ্য করা হয় এগারো শতকের মুসলিম-গ্রীক বিদ্যার বিশ্বকোষ স্বরূপ, যুক্তিবিদ্যা থেকে শুরু অরে গনিত পর্যন্ত বহু বিষয় স্থান পেয়েছিল এই পুস্তকে।

আকার এবং তথ্যের দিক থেকে অনেক বিশাল আর গভীরতা সম্পন্ন হওয়ায় পাঠকদের সুবিদার্থে তিনি পরে এই গ্রন্থের একটি সংক্ষেপিত রূপ তৈরি করেন যা কিতাব আল নাজাত নামে পরিচিত। মূল পুস্তকের চেয়ে দ্বিতীয় পুস্তকটিই অপেক্ষাকৃত বেশি জনপ্রিয় হয়ে আছে। দর্শন সম্পর্কে তার অপর গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকের নাম আল ইশারাত ওয়াল তানাবিহাত। মরমিতত্ত্বের ওপর তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাম হাই ইবনে ইয়াকজান, পাখি এবং প্রেম প্রসঙ্গে। এছড়াও ভাষা এবং জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে তিনি কিছু পুস্তক রচনা করেন।

স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা, অপছন্দের চাকরি এবং ইসমাইলি মতের সমর্থক হওয়ায় রাজরোষ এবং শত্রু পক্ষকে এড়াতে তিনি এক যায়গায় বেশিদিন অবস্থান করা নিরাপদ মনে করতেন না। বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন রজদরবারে চিকিৎসক অথবা পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন। নানারকম অনিয়মের কারণে অপেক্ষাকৃত কম বয়সেই তিনি অসুস্থ্য হয়ে পরেন। ১০৩৭ খ্রীস্টাব্দে ৫৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান ঘটে। ধর্ম ও দর্শনঃ ইবনে সিনা একজন ধার্মিক মুসলমান ছিলেন।

কথিত আছে, তার জীবনের শেষ তিন দিন তিনি চরম অসুস্থ্য অবস্থায় কোরআন পাঠ করে গেছেন মৃত্যুর পূর্বক্ষন পর্যন্ত। তবে ধার্মিক মুসলমান বলতে এখন আমরা যা বুঝি ইবনে সিনা তেমন ছিলেন না মোটেও। ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক অবস্থানের দিক থেকে অনেক দিক দিয়েই তার মত ছিল মৌল এবং সুন্নি ইসলামের পরিপন্থী। ধর্মমতের দিক থেকে তিনি শিয়া ইসমাইলি মতের সমর্থক ছিলেন। শিয়া ইসমাইলি মাজহাব মূলত সাতপন্থী শিয়া মাজহাব নামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র ইসমাইলিদের সৃষ্টিতত্ত্বের সাথেই দার্শনিকদের বিকিরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিল পাওয়া যায়। দর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বে আল-ফারাবি পরম সত্তা থেকে বিকির্ণ আদি বুদ্ধি এবং আদি বুদ্ধি থেকে দ্বিতীয় বুদ্ধি, দ্বিতীয় বুদ্ধি থেকে তৃতীয় বুদ্ধি এইরকম ক্রমানুসারে জগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন, ইসমাইলিরা তার কাছাকাছি মতই প্রকাশ করেন ধর্মতত্ত্বে। ইসমাইলিরা ধর্মের জাহেরি (প্রকাশ্য) তত্ত্বের চেয়ে বাতেনি (গূঢ়) তত্ত্বের প্রতিই গুরুত্ব দিত বেশি। ইবনে সিনা অধিবিদ্যা বিষয়ক আলোচনায় আল-ফারাবির মতোই জগৎকে অনন্তকাল ধরে বিরাজমান বলে দাবি করেন। আল্লাহ এ বিশ্বকে কোন এক বিশেষ সময়ে সৃষ্টি করেছেন এ মতের বিরোধী ছিলেন ইবনে সিনা।

তিনি দাবি করেন এ বিশ্ব পরম স্রষ্টা থেকে আদি বুদ্ধি এবং অন্যান্য বুদ্ধির মধ্য দিয়ে বিকির্ণ হয়ে অনন্তকাল ধরে বিরাজমান রয়েছে। ইবনে সিনা যে আল্লাহর কথা বলেন সে আল্লাহ এক পরম, বিশুদ্ধ একক স্রষ্টা, আমাদের পার্থিক জগতের তুলনায় সেই স্রষ্টা বিকারহীন এক সত্তা। সমগ্র বিশ্ব সেই স্রষ্টার জ্ঞান প্রক্রিয়ার ফলাফল। তবে স্রষ্টার এই জ্ঞান বিশেষ জ্ঞান নয় বরং সার্বিক জ্ঞান। যেহেতু স্রষ্টার জ্ঞান প্রক্রিয়ার ফলাফল এই বিশ্ব, সুতরাং সার্বিক বস্তু যেমন গ্রহ, সূর্য, তারা, গাছ, মাছ, মানুষ এইরকম সার্বিক বস্তু সম্পর্কে স্রষ্টা সচেতন, এই সার্বিক তার জ্ঞানের অংশ।

কিন্তু স্রষ্টা সার্বিক ‘মানুষ’ সম্বন্ধে জ্ঞান রাখলেও তিনি বিশেষ কোন মানুষ যেমন ‘ইবনে সিনা’, ‘শেখ হাসিনা’, ‘তসলিমা নাসরিন’, ‘তায়েফ আহমেদ’, ‘পারভেজ আলম’ এদের সম্বন্ধে কোন জ্ঞান রাখেন না। ‘মানুষ’ তার জ্ঞান চিন্তার ফসল, এই কারণে মানুষ কি তা তিনি জানেন কিন্তু পারভেজ আলমকে তিনি চেনেন না। সার্বিক এবং বিশেষ বস্তুর পার্থক্য এবং সার্বিকের স্বর্গীয় রূপের ধারণা ইবনে সিনা লাভ করেছিলেন প্লেটোবাদী এবং এরিস্টটলিয় দর্শন থেকে। ইবনে সিনা আল্লাহর বিশুদ্ধ একক সত্তায় বিশ্বাস করতেন। এই কারণে মুতাজিলাদের মতোই তিনি আল্লাহর সত্তায় তাঁর আলাদা আলাদা গুনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন।

এছাড়াও মৃত্যুর পর মানুষের দৈহিক পুনরুত্থানের বিরোধিতা করেন তিনি। তিনি আত্মার একত্বে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, মৃত্যুর পরে পুণ্যাত্মা ফিরে যাবে বুদ্ধির জগতে, এ পর্য্যায়ে আত্মা আপন বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব হারিয়ে শাসত বুদ্ধিজগতের সাথে একাত্মতা লাভ করবে। পরম পূর্ণতায় উপনীত হওয়ার পর আত্মা পরিণত হবে বোধগম্য জগতের এক অনুলিপিতে। অন্যদিকে পাপাত্মা এই পূর্ণতা পাবেনা, বরং দেহ হারানোর বেদনায় এক ধরণের আত্মিক অসুস্থ্যতাই হবে পাপাত্মার ভাগ্য।

‘পাখি’ এবং ‘আত্মার গীতি’ নামক মরমী পুস্তকে খাচার পাখির মুক্ত হওয়র রূপক কাহিনী বর্ণনা করে তিনি দেহের খাচা থেকে আত্মার মুক্তির কাহিনী বর্ণনা করেন। পক্ষ বিপক্ষঃ আগেই বর্ণনা করেছি, ইবনে সিনা ছিলেন একজন খ্যাতিমান এবং জনপ্রিয় ব্যাক্তি। জীবিত অবস্থায়ই তিনি অনেক শিষ্য এবং অনুসারি লাভ করেন। মৃত্যুর পরও দীর্ঘদিন তিনি আরব বিশ্বে এবং ইউরোপে অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক/বিজ্ঞানী হিসাবে টিকে ছিলেন। তবে দার্শনিক এবং ধর্মতাত্মিক মতাদর্শের কারনে তাঁর শত্রু দের সংখ্যাও কম ছিলনা।

এছাড়াও ইবনে সিনা রাজনীতিমুক্ত ব্যাক্তি ছিলেন না। ইসমাইলী ধর্মতাত্মিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করা এবং প্রচার করায় তিনি বারবার বিপদাপন্ন হন, পাড়ি জমান এক দেশ থেকে আরেক দেশে। রক্ষনশীল মুসলমানরা বরাবরই ছিলো ইবনে সিনার কঠোর সমালোচক। হাম্বলি এবং নব্য আশারি পন্থিরা ইবনে সিনার ঘোর বিরোধীতা করেন। তবে ইবনে সিনা সবচেয়ে বড় বিরোধীতার মুখে পরেন তার মৃত্যুর পর।

আল ফারাবি আর ইবনে সিনার বিরুদ্ধে আল-গাজালি যে শক্তিশালী আক্রমন গড়ে তোলেন তার ফলাফল ছিল সূদুরপ্রসারী। গাজালি ইবনে সিনা’কে কাফির এবং ধর্মবিরোধী আখ্যা দেন। গাজালির আগে অনেকেই ইবনে সিনাকে কাফির আখ্যা দিলেও তা খুব প্রভাবশালী ফলাফল তৈরি করতে সক্ষম হয় নাই। কিন্তু গাজালির মতো একজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি যখন দার্শনিকদের বিরোধীতায় নামেন এবং তাদেরকে কাফির আখ্যা দেন তখন তার ফলাফল ছিলো ভয়ঙ্কর। গাজালি নিজে অনেক ক্ষেত্রেই একজন যুক্তিবাদী ব্যাক্তি হলেও তার সমালোচনার ওপর ভর করে গাজালি পরবর্তি যুগে যুক্তিহীন ধর্ম ব্যাবসায়িরা দার্শনিকদের সম্পূর্ণ অস্বিকার করার প্রয়াস পায়।

পরবর্তি পর্বে আমরা ইমাম আল গাজালির দর্শন বিরোধী অবস্থান এবং সমালোচনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং আরব ভূখন্ডে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় পতনের আরো কিছু কারন তুলে ধরবো। গাজালি পরবর্তি সময়ে বেশকিছু রাজনৈতিক ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়েও বিশদ আলোচনা করা হবে। তার পরবর্তি পর্বগুলোতে আমাদের আলোচ্য বিষয় হবে মুসলিম পাশ্চাত্য, যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা অব্যাহত ছিল আরব ভূখন্ডে জ্ঞান চর্চায় পতনের শুরু হওয়ার পরও আরো কয়েক শতাব্দি ব্যাপি।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.