‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’ কথাটি চালু হয়ে গেলেও আইনবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আসলে যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সঠিক, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভুল।
গতকাল বিএনপির সংবাদ সম্মেলনেও এ প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক—বিএনপি সেটা চায়। কিন্তু সরকার এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কথা বলছে।
বিএনপির বক্তব্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন নেই। প্রচলিত আইনে এর বিচার সম্ভব।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূল যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী হিসেবে যেসব সন্দেহভাজনের নাম জানা যাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে মূলত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হতে পারে। তবে অনেকে একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে পৃথকভাবে অভিযুক্ত হতে পারেন। জার্মানির ন্যুরেমবার্গ আদালতে যাঁরা দণ্ডিত হন, তাঁদের অনেকে এই চারটি অভিযোগে আলাদাভাবে অভিযুুক্ত হয়েছেন।
সে অনুযায়ী তাঁদের সাজার মাত্রা ঠিক হয়েছে। বাংলাদেশের আইনে কোন কোন অপরাধের জন্য কী সাজা, তা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। বলা আছে, সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। অন্যান্য ক্ষেত্রে অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী যেকোনো মেয়াদে দণ্ড, এমনকি আর্থিক জরিমানা ঠিক করবেন ট্রাইব্যুনাল।
‘আমরা ১৯৭৩ সালের আইন প্রণয়নে ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে গঠিত ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের নীতিকেই গ্রহণ করেছিলাম।
’ এ কথা বলেন ওই আইন প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও তত্কালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিদ্যমান আইনে যেসব বাক্য রয়েছে, তা হুবহু জেনেভা কনভেনশন থেকে নেওয়া। ১৯৪৫ সালে জেনেভা কনভেনশন হিসেবে চারটি পৃথক আইন তৈরি হয়েছিল। এই চারটি কনভেনশনের ব্যাখ্যার আলোকে ঠিক হবে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ কী। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা তাঁদের গবেষণায় বিশেষভাবে দেখান যে, চারটি কনভেনশনে ৪১৭টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
আর এতে যুদ্ধাপরাধ কথাটি উল্লেখ আছে মাত্র একবার।
১৯৭৩ সালেই বাংলাদেশের আইনে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা পৃথক করা হয়েছিল এবং এই আইন প্রধানত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। সে কারণে যুদ্ধাপরাধ সুনির্দিষ্টভাবে সামরিক ব্যক্তির জন্য অধিকতর প্রযোজ্য। ’৭৩ সালের আইনে আট ধরনের অপরাধ সম্পর্কে বলা আছে। এগুলো হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনে বর্ণিত মানবিক বিধিসমূহের লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধ, ওই ধরনের অপরাধ সংঘটনে চক্রান্ত এবং তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়া।
তবে ব্যাপক ও ব্যবহারিক অর্থে এসব অপরাধই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। তবে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ কী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ কী, তার মধ্যে তফাত সৃষ্টি করা হয়েছে। কানাডা সরকারের গঠিত একটি কমিশন ১৯৮৫ সালে এক প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধকালীন কোলাবরেটরের (সহযোগী) মধ্যে তফাত দেখিয়েছিল। তার মানে দাঁড়ায়, সব যুদ্ধাপরাধীই রাজাকার। কিন্তু সব রাজাকারকে যুদ্ধাপরাধী বলা যায় না।
যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে ’৭৩ সালের আইনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যুদ্ধের আইন কিংবা প্রথা (কাস্টম অব ল) ভঙ্গ করে যেসব অপরাধ করা হয়েছে, তাই যুদ্ধাপরাধ। ’ তবে যুদ্ধের আইন কিংবা যুদ্ধের প্রথা কী, তার নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আইনে নেই। তবে অপরাধের ধরন সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, অপরাধগুলো প্রধানত সেনাদের দ্বারা সংঘটিত। এতে বলা হয়েছে, বেসামরিক জনসমষ্টির বিরুদ্ধে নরহত্যা, নির্যাতন, জবরদস্তি-শ্রমে বাধ্য করা, যুদ্ধবন্দীদের কিংবা সাগরে অবস্থানরত ব্যক্তিদের হত্যা করা, সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তি লুটতরাজ করা, সামরিক প্রয়োজন ছাড়াই নির্বিচারে নগর, শহর কিংবা গ্রাম ধ্বংস বা বিধ্বস্ত করা।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধ যে শুধু এসব অপরাধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তাও পরিষ্কার করে বলা আছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা যথেষ্ট ব্যাপক। এতে নির্দিষ্টভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, উচ্ছেদ, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দোহাই দিয়ে নির্যাতন ও ক্রীতদাস বানানো প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের চেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ধারণা সাম্প্রতিক। বিশ শতকের গোড়ায় এই ধারণার বিস্তার ঘটে।
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সনদেই প্রথম যুদ্ধাপরাধ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধকে আলাদা করা হয়।
’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়নসংক্রান্ত খসড়া কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কথাটি ব্যবহার করা যথাযথ নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ কী, তা ’৭৩-এর আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বলাই সংগত।
’
নবগঠিত ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য জিয়াদ আল মালুম বলেন, আইন অনুযায়ী নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে না। সে কারণে পত্রপত্রিকায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলার কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে ওই আইনটিকে বিশেষভাবে রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। এই আইনটিকে সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা দিতে বাংলাদেশ সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছিল। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে ’৭৩ সালের আইন প্রসঙ্গে অপরাধের বিবরণ দিতে গিয়ে ‘গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধ’ উল্লেখ করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের আইন অব্যাহতভাবে বিকাশমান। ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রায় দিয়েছেন, যুদ্ধের কৌশল হিসেবে পরিকল্পিত গণধর্ষণ মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু সামরিক উদ্দেশ্যে রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, কলকারখানা ধ্বংস করা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য হবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।