মমতা আর সুমন, দুজনেই ভারতীয়, দুজনেই বাঙালি, দুজনেই তৃণমূল কংগ্রেসের। কবীর সুমন শিল্পী, তিনি মানবতাবাদী, তিনি চান সাঁওতাল তার ভাষায় রাষ্ট্রপুঞ্জে কথা কয়ে উঠুক, তিনি চান ‘ধর্ম বলতে মানুষ বুঝুক মানুষ শুধু’। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী— তাঁর ভাবমূর্তি হলো বিরোধিতার, প্রধানত সিপিএম-বিরোধিতা করেই যিনি তৃণমূল কংগ্রেসকে জনপ্রিয় করে লাল দুর্গে ধস নামিয়ে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছেন। ক্ষমতায় এসেও তাঁর বিরোধিতার ব্রত থেকে তিনি চ্যুত হননি। অনলাইনে তাঁর সামান্য সমালোচনা করে কার্টুন প্রকাশ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন; টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত টক শোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থিনীর মুখে অপ্রিয় প্রশ্ন শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘সিন ক্রিয়েট’ করেছেন।
খবরের কাগজ থেকে জানা যাচ্ছে, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খামখেয়ালিপনা ও অসহিষ্ণু আচরণের সমালোচনা করে ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজু সরাসরি চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে মমতা তাঁর আচরণের পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। এর আগে অবশ্য কাটজু মমতার কাজের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ফেসবুকে কার্টুন-কাণ্ডে গ্রেপ্তার, পার্ক স্ট্রিটে মহিলাকে ধর্ষণের কথা অস্বীকার এবং টিভিতে মমতার নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় হেনস্তার মতো ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাবেক এই বিচারপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি পাঠিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তাঁর আচরণ সংশোধনের জন্য। কাটজু লিখেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যতবার পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, ততবার দেখেছেন মন্ত্রী-আমলারাও তাঁর সামনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালি আচরণের ভয়ে তাঁরা সব সময় তটস্থ।
মন্ত্রী, আমলারা ভিন্নমত পোষণ করলেও তাঁদের কথা বলার অধিকার থাকা উচিত বলে মনে করেন কাটজু। ’ (মানবজমিন, ৩ নভেম্বর ২০১২)
এসব ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এসব নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু মমতা যখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি কিংবা স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান, তখন সেটা আর ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না।
গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার খবর, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে ভূমি দেওয়ার যে প্রস্তাব করেছে, তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এ চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ পাবে মাত্র সাত হাজার একর ভূমি।
বিনিময়ে বাংলাদেশকে দিতে হবে ১৭ হাজার একর ভূমি। ’
অথচ ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির খসড়ায় সম্মতি দিয়েছিল। লিখিত সেই সম্মতিপত্র সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়লে মমতার রাগ আরও গেছে বেড়ে।
শিল্পী কবীর সুমন তাই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত। তিনি বলেছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরদৃষ্টি আদৌ যে নেই, তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন রুখে দিয়ে আরও একবার প্রমাণ রাখলেন।
...তিস্তার জল দেব না বলে মমতা গোঁ ধরলেন, সীমান্ত চুক্তিতে বাগড়া দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় না গিয়ে নিজের দেশের নেতাকেই অপমান করলেন! অথচ তিনি মা-মাটি-মানুষের কথা বলেন। দু-তিন শ একর জমির জন্য হাজার হাজার মানুষের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করছেন। ছিটমহলের মায়েদের দুঃখ দূর করতে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। ’ (প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট ২০১৩)
এটাই বোধ হয় একজন শিল্পীর সঙ্গে একজন ক্ষমতাপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতার দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য।
‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট’, আমাদের কবি শহীদ কাদরী লিখেছিলেন। রাষ্ট্র বেশির ভাগ সময় ভুলে যায়, সবার ওপরে মানুষ সত্য। ভুলে যায় যে একজন মানুষকেও দুঃখ দিয়ে, অপমান করে তার কিছু করা উচিত নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় সংখ্যা। এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও রাজনীতিকের কাছে মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় ভোটার।
মমতা হয়তো ভোটের হিসাব কষছেন।
কিন্তু সব সময় কি শুধু ভোটের হিসাব, শুধু একরের হিসাবটাই বড়? মানুষের জীবন, মানুষের সুখ-দুঃখ কোনো ব্যাপার নয়? ১৯৪৭ সালে রেডক্লিফ কমিশন মানচিত্রে দাগ টেনে ভারত ভাগ করে। কোচবিহারের রাজার কোনো কোনো গ্রাম বা এলাকা পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে। এগুলো ভারতের ছিটমহল, রয়ে গেছে বাংলাদেশের মধ্যে। এমনিভাবে স্থানীয় জমিদার, রাজা, রাজনীতিবিদদের খামখেয়ালির কারণে তৈরি হয় ১৬২টি ছিটমহল, বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে ভারতের মধ্যে, ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশের মধ্যে।
প্রায় ৫১ হাজার মানুষ এই ছিটমহলগুলোয় দুর্বিষহ জীবন যাপন করে। অসুখে-বিসুখে তারা যেতে পারে না তাদের দেশের মূল খণ্ডে। এমনও আছে, ছিটের মধ্যে ছিট। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ।
১৯৪৭ থেকে ২০১৩, ৬৬ বছর।
এই ৬৬ বছরে এই সমস্যার সমাধান হলো না, এটা যে কী লজ্জার। আমরা একুশ শতকের পৃথিবীতে বসবাস করছি, যখন ইউরোপ এক হয়ে গেছে। যখন সারা পৃথিবীতে চলাচল অবাধ করার স্বপ্ন দেখা যাচ্ছে। বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ কবে স্বপ্ন দেখেছেন:
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি...
আর সেখানে দুটো দেশের কয়েকজন রাজনীতিবিদ কয়েক হাজার একর জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে, এই গ্রাম্য দুশ্চিন্তা থেকে মানুষের দুঃখকষ্টকে বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মৌসুমটায় উভয় দেশের ছিটমহলের মানুষ তাই আন্দোলন করেছে, গণ-অনশন করেছে।
১৯৫৮ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে নেহরু-নুন সীমান্ত চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতেই ছিটমহলগুলো বিনিময়ের কথা ছিল। ১৯৭৪ সালে হয় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ী ছিটমহল অর্পণ করে ভারতকে, ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার জন্য দেবে তিনবিঘা করিডর, এই করিডর পাওয়া যায় ২৭ বছর পরে, তবুও দিনে শুধু ১২ ঘণ্টার জন্য।
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত চুক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিতে হবে।
মমতার তৃণমূল কংগ্রেস এই বিল উত্থাপনে বাধা দিচ্ছে। বাধা দিচ্ছে অসম গণপরিষদ। বাধা দিচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। তৃণমূল নেতা ডেরেক ওব্রায়ান, যাঁকে মমতা ভার দিয়েছেন এই ব্যাপারটা দেখার জন্য, বলেছেন, ‘এটা তো ভ্যানিলা আইসক্রিম নয়, এটা হলো দেশের মূল্যবান ভূমি, যা আজ সংকটাপন্ন। ’
কিন্তু তিনি যদি বুঝতেন, দেশের জমি যেমন ভ্যানিলা আইসক্রিম নয়, তেমনি মানুষের জীবনও ছেলের হাতের মোয়া নয়।
৬৬ বছর ধরে একদল মানুষ, কাগজে-কলমে যারা ভারতের নাগরিক, তারা ঘেরাও হয়ে আছে বাংলাদেশের ভূমি দ্বারা, তারা না পারছে আটকে পড়া ছিট থেকে বেরোতে, না পাচ্ছে কোনো দেশের নাগরিকের প্রাপ্য ন্যূনতম অধিকারগুলো, তাদের জীবনের দাম কি জমির দামের চেয়েও কম? একই অবস্থা ভারতের ভেতরে আটকে পড়া বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর অধিবাসীদেরও। ধরা যাক, ১৯৪৭ সালের আগে অখণ্ড ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক ছিল একজন শিশু, ধরা যাক তার নাম বাদল খান কিংবা ঘোষ, ১৯৪৭ সালে তার বয়স ছিল ১০ বছর, সেই বালক জানতও না স্বাধীনতা মানে কী, কিংবা অভিধান দেখে সে জানল, স্বাধীনতা মানে কারও অধীনে না থাকা, সেই স্বাধীনতা কেড়ে নিল তার স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার, সে প্রতিদিন অপেক্ষা করে রাষ্ট্র ও রাজনীতি তার হাতেপায়ে যে শিকলটা বেঁধেছে, তা খুলে নেওয়া হবে, নেহরু-নুন চুক্তির কথা সে যখন শুনল তখন সে ২১ বছরের যুবক, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির কথা যখন সে শুনল, তখন তার ৩৭, তার ছেলেমেয়েদের সে বলল, এবার আমরা হয়তো এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাব, তারপর যখন মনমোহন সিং বাংলাদেশে এলেন, সেও যোগ দিল অনশন ধর্মঘটে, তার বয়স ৭৪, সে তার নাতি-নাতনিদের বলছে, মুক্তি আসন্ন। কবে সে মুক্তি পাবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কবে ভারত তার পার্লামেন্টে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেবে?
ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামের একটা সংগঠন করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ কলকাতায় এর আহ্বায়ক। তাঁরা কলকাতা আর ঢাকায় উভয় দেশের সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সভা-সেমিনার করেছেন।
বিষয়: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা। গৌতম ঘোষ একটা ছবি বানিয়েছেন সম্প্রতি, নাম শূন্য অংক, ভারতের মাওবাদী বিদ্রোহ ও আদিবাসী সংগ্রাম দমনে রাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি, কাশ্মীরে দমন-নিপীড়ন—এমন স্পর্শকাতর বিষয়কে গৌতম ঘোষ ছবির উপজীব্য করে তুলেছেন। ওই ছবি দেখলেও মনে হবে, রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট। কিন্তু রাষ্ট্র তো মানুষই চালায়। সেই মানুষগুলো কবে হয়ে উঠবে মানবিক?
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের অমানবিকতা নিয়ে অনেক করুণ মানবিক গল্প আছে।
সাদত হাসান মান্টোর গল্প আছে, যেখানে একটা পাগলাগারদের পাগলদের বেছে নিতে বলা হয়, তারা ভারতে যাবে নাকি পাকিস্তানে, একজন দুই দেশের মধ্যবর্তী কাঁটাতারের বেড়া-ঘেরা অঞ্চলে গিয়ে পড়ে থাকে। সেখান থেকে শুরু করে আমাদের সেলিনা হোসেনের উপন্যাস, ছিটমহলের মানুষদের করুণ জীবনালেখ্য—ভূমি ও কুসুম। কাঁটাতারের বেড়া ও অমানবিক পুশইন-পুশব্যাক নিয়ে আমিও চেষ্টা করেছি একটা উপন্যাসিকা লেখার—না-মানুষি জমিন। কবীর সুমন একটার পর একটা গান লিখেই চলেছেন।
কিন্তু রাজনীতির মানুষেরা, কূটনীতির মানুষেরা মানবিক হয়ে উঠছেন কই? রাষ্ট্রগুলোও এখনো রয়ে যাচ্ছে দমন-নিপীড়নের যন্ত্রমাত্র।
পূর্ব থেকে পশ্চিম কোথাও তো তার ব্যতিক্রম দেখি না। কবে মানুষেরা মানুষ হয়ে উঠবে, মানুষ এই পরিচয়টার যোগ্য হয়ে উঠবে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।