মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান স্বার্থের ওপর আল-কায়েদা আঘাত হানতে পারে—ওবামা প্রশাসনের এ রকম এক সতর্কবার্তা প্রচারের পর আমেরিকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। যাঁরা মনে করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিছুটা নমনীয়, এই সতর্কবার্তাকে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে একটা বড় প্রমাণ হিসেবে। উইকলি স্ট্যান্ডার্ড, ফক্স নিউজ ও ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ওবামা দাবি করেছিলেন, আল-কায়েদাকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাসবাদী যুদ্ধের স্রোতে ভাটার টান লেগেছে। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার এই সতর্কবার্তার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, ওবামা ঠিক বলেননি।
কিছু বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের শুধু নিজেকেই দায়ী করার আছে।
পররাষ্ট্র দপ্তর পুরো আগস্ট মাসের জন্য এক বৈশ্বিক ভ্রমণ-সতর্কতা জারি করেছে। কারণ হিসেবে বলেছে, যেকোনো স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। যেসব কংগ্রেসম্যান প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দ্বারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন, তাঁরা বলেছেন, আল-কায়েদার লক্ষ্য যদিও আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার শহরগুলো, তবু ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায়ও হামলা হতে পারে। তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ পুরো আগস্ট মাসটি কী করে কাটাবে বলে মনে করা হয়েছিল?
ওবামা প্রশাসন অন্যান্য দেশের সরকারগুলোকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য জানিয়েছে, সারা পৃথিবীতে মার্কিন দূতাবাস ও কনসুলেটগুলোকে সতর্ক করেছে এবং সম্ভাব্য সব হামলার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ করেছে। এই কাজগুলো করা অবশ্যই ঠিক হয়েছে।
কিন্তু এই গণবিজ্ঞপ্তি জারির মধ্যে সেই বুশ যুগের সব আলামতই ছিল: সতর্কবার্তাটি ছিল এমনই ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো যে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। কিন্তু আবার তা এতই অস্পষ্ট ও ভাসা ভাসা যে, মানুষ কী করবে, তা-ও ভেবে পাওয়া যায় না।
আল-কায়েদার বর্তমান অবস্থা কী—এই বৃহত্তর প্রশ্নে তর্কের জায়গা আছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মূল সংগঠন আল-কায়েদা সেন্ট্রাল এখন ছিন্নভিন্ন। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষত যেসব অঞ্চলে সরকার অত্যন্ত দুর্বল, নিজস্ব ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, সেখানে আল-কায়েদার চেতনা সজীব রয়ে গেছে।
ইয়েমেন, মালি ও নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তাদের অবস্থা রমরমা হচ্ছে। আল-কায়েদার সঙ্গে এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কোনো কোনোটির সম্পর্ক আছে। আল-কায়েদার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তাদেরও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। অন্য গোষ্ঠীগুলো, বিশেষত আফ্রিকার জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো স্থানীয়ভাবে বেড়ে ওঠা যুদ্ধবাজদের মতো, যারা আল-কায়েদার নাম ব্যবহার করে নিজেদের ব্র্যান্ডের চাকচিক্য বাড়াতে চায়।
দুর্বল কয়েকটি রাষ্ট্রে তৎপর এসব ছোট ছোট জঙ্গি গোষ্ঠীর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কী নীতি-কৌশল নেওয়া উচিত? সম্ভাব্য তিনটা পথ আছে।
এক. সন্ত্রাসবাদবিরোধী সর্বাত্মক দমনকৌশল, জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস যে কৌশল বাস্তবায়ন করেছেন ইরাকে ও আফগানিস্তানে (কিছুটা কম মাত্রায়)। কিন্তু কারও কি মনে হয় যে ওই দেশগুলোতে হাজার হাজার মার্কিন সেনা পাঠানোর চিন্তা একটা কাজের চিন্তা? কারও কি মনে হয় যে আফগানিস্তানে আরও ব্যাপকসংখ্যক সেনা রেখে দিলে মালির জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ভয়ে থর থর করে কাঁপবে? জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলের সিআইএ পরিচালক মাইকেল হেইডেন যেমনটি বলেছেন, এসব দেশে কিছু করতে গেলে খুব কম করা এবং বাড়াবাড়ি করে ফেলার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে। বাড়াবাড়ি করা হলে স্থানীয় জঙ্গিদের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে, অসন্তোষের স্থানীয় কারণগুলো আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে এবং এমন এক ধরনের বৈশ্বিক হুমকি সৃষ্টি হতে পারে, বাস্তবে যার অস্তিত্ব আগে ছিল না।
দ্বিতীয় কৌশলটি হতে পারে ড্রোন, মিসাইল, বিশেষ বাহিনী ইত্যাদি দিয়ে আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা। যেকোনো বিচারেই ওবামা প্রশাসন এই ক্ষেত্রে বেশ তৎপরতা দেখিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বুশ তাঁর পুরো শাসনামলে যত ড্রোন ব্যবহার করেছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রতিবছর তার চেয়ে বেশি ড্রোন ব্যবহার করে চলেছেন। বস্তুত অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ওবামার সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশল বড্ড বেশি আগ্রাসী। ইয়েমেনে আমেরিকার যুদ্ধের বিশদ বিবরণ রচনাকারী লেখক গ্রেগরি জনসেন বলেন, ইয়েমেনে মাত্রাতিরিক্ত ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে, যার পাল্টা পরিণতিও কম বিবেচ্য নয়। তিনি বলেন, ড্রোন ব্যবহার করে বরং বেশি কাজ হয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। কারণ, ওই দুটি দেশে ড্রোন হামলায় যেসব লোক মারা গেছে, তাদের মধ্যে বিদেশির সংখ্যাই বেশি, তারা মূলত আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জঙ্গি।
স্থানীয় লোকজন বেশি মারা গেলে ফলটা আরও নেতিবাচক হতো, কারণ স্থানীয়দের আত্মীয়স্বজন আছে বিপুলসংখ্যক।
তৃতীয় সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে, যেসব দেশে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো তৎপর রয়েছে, সেই দেশগুলোর সরকারকে দিয়ে তাদের দমন করার প্রয়াস চালানো। কিন্তু সোমালিয়া বা ইয়েমেনের মতো যেসব দেশে আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো গজিয়ে উঠেছে, সেই দেশগুলোর অবস্থা প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন, সরকারগুলো দেশ শাসন করতে পারছে না।
এসব দেশে যে সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রগুলো ঘনিয়ে উঠছে, সেগুলো নস্যাৎ করে দেওয়ার উপযোগী প্রযুক্তি, মিসাইল ও সেনাবাহিনী এ মুহূর্তে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই আছে। কিন্তু আমেরিকার নিজের এগুলো ব্যবহার করার থেকে চূড়ান্ত বিচারে ভালো হবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ওই সব দেশের সরকারসহ সন্ত্রাসবিরোধী শক্তিগুলোর কাছে হস্তান্তর করা।
কারণ, যেকোনো বহিরাগতের চেয়ে ওই অঞ্চলগুলো তাদেরই ভালো জানা আছে, ওই দেশগুলোতে ইসলামি জঙ্গিবাদ দমনের সংগ্রামের দায়িত্ব স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিলে স্থানীয় সাধারণ মুসলমানদের ওপরও তা বর্তাবে এবং তারা আদর্শিকভাবে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়তে পারবে সবচেয়ে কার্যকরভাবে। আল-কায়েদার পথ যে প্রকৃত ইসলামের পথ নয়—এটা তুলে ধরার কাজ তারাই সবচেয়ে ভালো পারবে। যুক্তরাষ্ট্র ওই সব দেশের সরকারগুলোর গ্রহণযোগ্যতা ও সামর্থ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে নানা পন্থায়। তারা শাসনব্যবস্থার সংস্কার সাধনে সহযোগিতা করতে পারে, আর্থিক সাহায্য দিতে পারে, প্রযুক্তিগত ও কারিগরি ক্ষেত্রেও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার সম্ভাব্য তিনটি কৌশলের মধ্যে এটিই সবচেয়ে নমনীয়।
ওবামা এই কৌশল সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করতে গেলে সবচেয়ে বেশি আপত্তি উঠবে তাঁর সমালোচকদের তরফ থেকে।
টাইম সাময়িকী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফরিদ জাকারিয়া: আমেরিকান সাংবাদিক। টাইম সাময়িকীর এডিটর-অ্যাট-লার্জ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।