আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একুশের নবীন প্রার্থনা/শরীফ হোসাইন মৌন



একুশে ফেব্রুয়ারী। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। নব্য স্বাধীন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার কুরসী কাঁপানো প্রথম আন্দোলনের নাম। স্কুলের পাঠ্য কবিতার সেই ঘামে আর রক্তে ভেঁজা চিঠি,চলচ্ছিত্রের দেখা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বজ্র শ্লোগান, বিভিন্নাকৃতির শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্যদান,ঘুম থেকে জেগে দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ,‍‍‍‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍‍‍ “ ‍‌‌সালাম সালাম হাজার সালাম”,স্কুলের খেলাধূলা,পত্রিকার পাতার বিশেষ ক্রোড়পত্র,বিটিভির জীবন থেকে নেয়া চলচ্ছিত্র আর সুবিধাভোগী বুদ্ধজীবী রাজনীতিকদের স্যুট-টাইবেশে বাংলা ভাষার প্রতি মায়াকান্নার বয়ান;এই আনন্দ উল্লাসের ক্ষুদ্র বৃত্তেই কি বন্দি আমাদের একুশের চেতনা? তবে কেন একুশ বললে আমাদের ছানি পড়া চোখের ঘোলা পর্দায় শুধু এতটুকুই ভেসে ওঠে? ভাষা কি নিছকই ভিন্নজাতিসত্ত্বা থেকে নিজের ভাষার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার কোন হাতিয়ার? নাকি স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব, স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞের নেতৃস্থানীয় প্রতীকী? লাভ কি শাসকের বুলেটের মাঝে বুক চিতিয়ে ফিনকি দিয়ে তাজা রক্ত ঝরানোয় যদি ড্রয়ংরুমের আয়েশী ঘরে হিন্দি এসে বাসা বাঁধে? তবে কি চলচ্ছিত্র,সিরিয়াল,রিয়েলিটি শোর চোখ ধাঁধানো,সুড়সুড়ি জাগানো,আবেগী প্রহেলিকার বানিজ্যিকায়নের পথে না গিয়ে জোর করে চাপানোর হুমকি “ উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” বলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভুল করেছিলেন? স্বদেশে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, স্বদেশী শিক্ষা,কৃষ্টি-কালচার,বিশ্বাস,ঐতিহ্যবোধকে বিজাতীয় আগ্রাসন থেকে পরম মমতায় আগলে রাখার জন্যই বুকের তাজা রক্তে রাজপথে লেখা হয়েছে যে রক্তাক্ত কবিতা,সেটাই আমাদের গৌরবজ্জ্বল ভাষা আন্দোলন। ভাষা রক্ষাই আমাদের পূর্বপুরুষদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলনা, ছিল উপলক্ষ্য মাত্র।

আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, বিশ্বাস,বোধ প্রভৃতির অগ্রপথিক সেনানী হয়েই ভাষার ব্যাপারটা এগিয়ে এসেছিল সামনে। আর তাইতো আমরা কেবল যদি যথার্থরুপে বাংলাকে আঁকড়ে থাকি আর ভুলে যাই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবোধ,বিশ্বাস,শিক্ষা-কৃষ্টি তবে ‘একুশ’ চেতনার নামে শুধু হাসিই উৎপাদন করে। প্রকৃতই একুশের চেতনা যদি জাগরুক থাকতো তবে বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের অনুদানে ভাষা নিয়ে এদেশে অন্তত: বইমেলা হতোনা। আমাদের স্বকীয়তা,বিশ্বাসবোধ ধ্বংসের জন্য গড়ে উঠতনা কিন্ডার গার্টেন,ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো। শহুরে বিত্তাকাংখী মানুষগুলোর গতরে উঠতনা বিদেশী ফ্যাশনের পোষাক-আশাক।

এফ এম রেডিওর নামে চলতনা ভাষার খিঁচুড়ী নিয়ে একুশের চেতনার ধ্বংসলীলা। হিন্দি-ইংলিশ চ্যানেলের জোয়ারে ভেসে যেতনা যুবক-যুবতী আর গৃহিনীরা। সুন্দরী হবার উগ্র বাসনায় কিংবা নকলবাজ গানের শিল্পী হবার মেরুদন্ডহীন আপ্রান প্রচেষ্টায় যত্রতত্র ক্লোজ-আপ পদ্ধতির আমদানি হতোনা। সালাম,রফিক,জব্বার,বরকত এবং আরো নাম না জানা অসংখ্য তেজদ্বীপ্ত তরুন ছাত্রদের মৃতদেহগুলি যেন আজ কবরে বসে কাঁদছে! সত্যের স্বপক্ষের সেই উত্তেজনা,স্বজাতির জন্য দরদ ভরা সেই শ্লোগান,সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যরক্ষার আমৃত্যু শপথ আজকের ছাত্রসমাজে ম্রিয়মান বললেও যেন কম বলা হয়। “ওমুকের ছামড়া,তুলে নেব আমরা”,”ওমুক ভাইয়ের কিছু হলে,জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”,এই সব হচ্ছে আমাদের আধুনিক(?) ছাত্রদের শ্লোগান।

দেশপ্রেমহীন রাজনীতিকদের লেজুড়বৃত্তি করতে করতে বখাটে মাস্তান ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনি এখনকার ছাত্ররা। টেন্ডারবাজি,চাদাবাজি,ধর্ষন,খুন,ভর্তিবানিজ্যে হাত পাকাতে পাকাতে এখন তারা একুশের চেতনাকে গভীর এক অন্ধকার গহ্বরে ফেলে দিয়েছে। শিক্ষক নামধারী কিছু সুবিধাভোগী বখাটে,স্বার্থাণ্বেষী রাজনীতিক আর ছাত্র নামধারী আদু ভাইয়ের খপ্পরে পড়ে বেগোরে প্রান যাচ্ছে আবু বকরদের। যাবতীয় স্বদেশিকতাকে চোখ বুঁজে বিশ্বায়নের ধোয়ায় বিসর্জন দিয়ে বছরে একবার শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্যদানের উৎসব কিছুতেই একুশের চেতনা হতে পারেনা। নতজানু বিদ্যা, হীনন্মন্যতা, টাকাওয়ালা বিশ্বের সাংস্কৃতিক উচ্ছিষ্টের মানদন্ড, পুঁজিবাদী-জড়বাদী শিক্ষাব্যবস্থার বৃত্ত থেকে মুক্তি পাক আমাদের জাতীয় চেতনা,একুশের প্রহরে এটাই হোক আমাদের নবীন প্রার্থনা।

একুশ ফিরে আসুক শুধু উপলক্ষ্য হয়ে নয়,অন্তরালের সকল লক্ষ্য নিয়ে। শরীফ হোসাইন মৌন Email: Mob: 01670495397

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।