আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন প্রমিথিউস অথবা পুরাণের পাখির গল্প

মৃত্যু বলে কিছু নেই..তুমি যাকে মরণ বল..সে শুধু মারবে তোমাকেই..

‌''জন্মিলে মরিতে হবে/ জানে তো সবাই/ তবু মরণে মরণে অনেক/ ফারাক আছে ভাই/ সব মরণ নয় সমান..' প্রতুল ঠিকই বলেছিলেন। সব মৃত্যু সমান নয়। মৃত্যু আমাদের হতচকিত করে দেয় ; থামিয়ে দেয় সম্ভাবনার নানা বিন্যাস সমাবেশকে। কিন্তু কখনো কখনো মৃত্যু জাগিয়ে তোলে সহস্র মৃতকে। স্পার্টাকাস, চে অথবা আমাদের তাজুলের পথ ধরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন একালের প্রমিথিউস রাজু।

স্লোগানরত রাজুর মুষ্টিবদ্ধ হাত মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই যেন কালঘুম ভেঙ্গে উত্তোলিত হয় সহস্র হাত। সে হাত আকাশ ছুঁয়ে বজ্র-বিদ্যুৎ নামিয়ে আনতে চায়; বিদ্যুচ্চমকে আলোকিত করতে চায় তিমির রাত্রি- পুড়িয়ে দিতে চায় সকল সামাজিক বর্জ্যকে। কে রাজু? কেন তাকে প্রাণ দিতে হল? শামসুর রাহমান রাজুকে পুরাণের পাখি বলেছেন। তাঁরপুরাণের পাখি কবিতায় আমরা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই: ‌‌‌'দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুন করেছে তোমাকে। টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া তোমার রক্তের কন্ঠস্বরে ছিল পৈশাচিকতা হরণকারী গান।

ঘাতক নিয়ন্ত্রিত দেশে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি, মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কন্ঠে তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা ..' রাজুর হাতে ছিল প্রগতির পতাকা। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, রাজু ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি- এই চার তারকার নীল নিশান কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। রাজু ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য এবং ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যান সম্পাদক, ছিলেন মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক কৃতি ছাত্র। রাজু সংসদের সভাপতি, রাজুর বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল হক এখনো স্মরণ করেন রাজুর মেধার কথা, রাজনীতি ও পড়াশোনা কে সুন্দর করে সমন্বয় করার কথা। রাজু যেখানে থাকতেন; শহীদুল্লাহ হলের সেই ১২২ নং কক্ষতে আমরা যখনই যাই; এক ধরনের শিহরণ কাজ করে।

আমরা, রাজুর উত্তরসূরিরা যেন অনুভব করি- এই সেই কক্ষ, যেখানে ঘুমাতে যেতেন শহীদ রাজু; কখনো রাত জেগে পড়াশোনা করতেন কিংবা বন্ধুদের সাথে তর্কে মেতে উঠতেন দেশ-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন নিয়ে। হয়তো কখনো আবৃত্তি করতেন প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কোন পংক্তি, আবার কখনো এই কক্ষ থেকেই রাতদুপুরে রং-তুলি হাতে বের হয়ে যেতেন দেয়াললিখন করতে। সেই রং-তুলি অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা; মৃত্যুও আগ মুহূর্তেও রাজু কাছ ছাড়া করেন নি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় স্লোগানরত রাজুর কাঁধে যে ব্যাগ ছিল, সেই ব্যাগে ছিল নোটখাতায় নিজ হাতে টুকে রাখা জীবনানন্দের কবিতা এবং রং করার ব্রাশ ও হকিয়ার। শহীদ রাজুর রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ এখনো সংরক্ষিত আছে ডাকসুর সংগ্রহশালায়।

রাজু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমিথিউস। ছাত্র আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী রাজু ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নিরলস শ্রমে গড়ে তুলেছিলেন প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টার; কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়- বরং যারা সামর্থ্যের অভাবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে পারে না, তাদের শিক্ষাসহায়তা দেবার তাগিদ থেকে। মৃত্যু কমাস আগেও শীতার্ত বঞ্চিত শিশুদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে বিতরণ করেছিলেন রাজু। এখানেই থামার কথা ছিল না রাজুর। মাকে বলতেন,দেখো, একদিন আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিত হবে।

’ রাজুর চোখে জোনাক পোকার মত জ্বলজ্বল করত স্বপ্ন। যে স্বপ্নের সলতে রাজু জ্বালিয়েছেন, তা আজো জ্বলছে আমাদের চেতনায়। দেড়যুগ আগে; পুরাণের পাখি রাজু,প্রমিথিউস রাজু রাজপথে রক্ত দিয়েছেন। সেই রক্তে শপথ নিয়ে আসরা পদতলে পিষ্ট করতে চাই সন্ত্রাসের চারণভূমি, যেমনটি চেয়েছিলেন রাজু। সেদিন ছিল ১৩ মার্চ, শুক্রবার।

মা রাজুকে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে যান। দুপুরে বাসায় গিয়ে খাওয়ার কথা রাজু, খেতে যেতে পারেন নি। সেদিন একজন শিবির কর্মীর প্রহৃত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের সাথে বচসা হয় সাধারণ ছাত্রদের। ঐ সময়ে রাজুর কনুইতে আঘাত লাগে; তাই বাসায় না গিয়ে রাজু বিশ্রাম নিতে চলে যান তার হলে। অথচ বিকেল হতে না হতেই ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে শুরু হয় গোলাগুলি, ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বেও রাজত্ব কায়েম করার অশুভ লক্ষ্যে।

সেই সময়, আমাদের রাজু প্রতিবাদ জানাতে উন্মুখ হয়ে ওঠে- গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে সংগঠিত করে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল, গুলির মুখে দাঁড়িয়েও সন্ত্রাসের ভিত্তিমূলকে উপরে ফেলার প্রতিজ্ঞায় শক্ত হয়ে ওঠে রাজুর চোয়াল। সেই মিছিলে রাজুকে লক্ষ্য করে অকস্মাৎ ছুটে আসে ঘাতক বুলেট- বুলেটবিদ্ধ রাজুর রক্তে রঞ্জিত হয় টিএসসির সামনের রাজপথ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়ে রাজু হয়ে ওঠেন আমাদের জন্য প্রেরণার অফুরন্ত উৎসধারা। রাজু পথ দেখিয়েছেন। করেছেন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ।

দৃষ্টান্ত হয়েছেন, দিয়েছেন সাহসের যোগান। তবু আমরা, তার উত্তরসূরিরা এখনো অর্জন করতে পারিনি চূড়ান্ত বিজয়। পারিনি রাজুর হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলাতে। রাজু হত্যা মামলার এক নম্বর আসামী গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই ক্যাম্পাস এলাকায় বিএনপি জামাত জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিল। ক্যাম্পাসে আজো সদর্পে চলে অস্ত্রের মহড়া, হলগুলোতে দখলদারিত্বের রাজনীতির শিকার হয় আবু বকরেরা।

আধিপত্য ও দখলদারিত্বের রাজনীতির কারণে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝুলছে তালা। শিক্ষাবাণিজ্যের শিকার হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিকূল সময়ে তাই শুধু শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলেই রাজুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা দেখানো হবে না- বরং রাজুকে সম্মান ও প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন তখনই হবে যখন সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সন্ত্রাসের ভিত্তিমূলকে উপড়ে ফেলা যাবে। ১৩ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাস বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু রাজু তো শুধু একজন শহীদ নন, বরং রাজু সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চেতনার উৎসধারা।

তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী মিলে এই দিবস পালন করা উচিত এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা উচিত। অন্যথায় আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস পরিণত হবে সন্ত্রাসী ও দখলদারদের অভয়ারণ্যে- আবু বকর,সানি,ফারুক,মহিউদ্দিনদের মত প্রাণ হারাতে হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের। সময় এখনই, ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করবার। এক রাজুর রক্ত থেকে তৈরী হোক আরো অনেক রাজু; যাদের পদাঘাতে পিষ্ট হবে সন্ত্রাসের চারণভূমি, নিশ্চিত হবে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। ‌যে তোমাকে কবরে নামিয়েছি বিষন্নতায়, সে নও তুমি।

প্রকৃত তুমি ঐ মাথা উঁচু করে আজও নতুন সভ্যতার আকর্ষণে হেঁটে যাচ্ছ পুঁতিগন্ধময় গুহা-কাঁপানো মিছিলে, তোমার অঙ্গীকার-খচিত হাত নীলিমাকে স্পর্শ করে নিঃশঙ্ক মুদ্রায়, ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে, তুমি বারবার আগুন থেকে বেড়িয়ে আসবে পুরাণের পাখি। '

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.