হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
মুতাযিলাদের আবির্ভাবঃ
৬৯৯ খ্রিঃ খলিফা ইবনে আবদুল মালেকের নির্দেশে হত্যা করা হয় কাদরিয়া আন্দোলনের প্রথম নেতা মাবাদ আল জুহানিকে। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মতবাদ প্রচার করার কারণেই তাকে হত্যা করা হয় । তবে একই বছর কাদরিয়া মতে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার আবির্ভাব হয়। এই দুইজন হচ্ছেন ওয়াসিল বিন আতা ও আমর বিন ওবায়েদ। কাদরিয়াদের অপর গুরুত্বপূর্ণ নেতা গাইলান আল দিমেস্কিকেও ৭৪৩ সালে হত্যা করা হলে কাদরিয়া আন্দোলন অনেকটাই স্থিমিত হয়ে যায়।
তবে অপর কাদরিয়া নেতা হাসান আল বসরির দুই শিষ্য ওয়াসিল বিন আতা এবং আমর বিন ওবায়েদ নিজেদের গুরুর প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে আরো বেশি বুদ্ধিবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। এ দুজনের হাত ধরেই জন্ম নেয় মুতাযিলা আন্দোলন। তরুন কাদরিয়াদের একটা বড় অংশই মুতাযিলা সম্প্রদায়ের সাথে নিজেদের বিলিন করে ফেলে।
আব্বাসিয় খেলাফত ও মুতাযিলাদের উত্থানঃ
রাজনৈতিক বিরোধীতার কারণেই টিকে থাকতে পারেনি কাদরিয়রা। অন্যদিকে মুতাযিলারা লাভ করে রাজনৈতিক সমর্থন।
শেষ দিকের উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ইবনে ওয়ালিদ মুতাযিলাদের মতের প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। ৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে উমায়িয়া খেলাফতের পতন ঘটে এবং আব্বাসিয় খেলাফতের শাসনামল শুরু হয়। আব্বাসিয়রা প্রথম থেকেই ছিলো মুতাযিলাদের পৃষ্ঠপোশক। দ্বিতীয় আব্বাসিয় খলিফ আল-মনসুর ছিলেন আমর বিন ওবায়েদের বন্ধু। আমরের মৃত্যুতে খলিফা নিজে শকগাথা রচনা করেন।
আল-মনসুরের আমলেই মুতাযিলারা খলিফার দরবারে স্থান করে নেয়। খলিফা মনসুর শিল্পকলা আর বিজ্ঞানচর্চার প্রিষ্ঠপোশক ছিলেন। তিনি সংস্কৃত, ফারসি, গ্রীক ভাষার বই পুস্তক আরবীতে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলিম যুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের গবেষনার ক্ষেত্রে যাবতিয় সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেন। আব্বাসিয় খলিফাদের সময় খলিফার দরবার বিভিন্ন ধর্ম ও দেশের পন্ডিত ব্যক্তিদের জন্য খুলে দেয়া হয় এবং মুক্ত বিতর্ক উৎসাহি করা হয়। প্রথম দিকে মুসলমান ধর্মতাত্ত্বিকরা শুধুমাত্র বিশ্বাসকে পুঁজি করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বি পন্ডিতদের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতির্ণ হলেও সুবিধা করতে পারে নাই।
কিন্তু যুক্তিবাদী মুতাযিলারা এক্ষেত্রে ব্যপক সাফল্য অর্জন করে। ফলে সমসাময়িক ধর্মতাত্ত্বিক সংগঠনগুলোর মধ্যে মুতাযিলারা সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনে পরিণত হয়। আব্বাসিয় খলিফাদের আমলে রক্ষনশীল সম্প্রদায়গুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ব্যার্থ হয়। আব্বাসিয় খলিফাদের উদারনীতি এবং মুতাযিলাদের বুদ্ধিবাদী ধর্মতাত্ত্বিক পরিবেশেই জন্ম নেয় এমন একটা সময় যে সময়টাকে বলা হয় মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ। মুতাজিলাদের বন্ধু বলে পরিইত খলিফা আল-মামুন, আল-মুতাসিন ও আল ওয়াতিকের সময় জ্ঞন বিজ্ঞানের চর্চায় মুসলমান বিজ্ঞানীর বিশেষ উৎকর্ষ সাধন করে।
খলিফা মামুনের সময়কালেই তার দরবারের জ্যোতির্বিদরা পৃথিবীর পরিধী পরিমাপ করে। খলিফা মামুনের নিজ তত্ত্বাবধানে মুসলমান বিজ্ঞানীদের তৈরি করা যন্ত্র এস্ট্রোল্যাবের সাহায্যে পৃথিবীর পরিধীর যে পরিমাপ নির্ণয় করা হয়েছিলো তার সাথে আধুনিক পরিমাপের পার্থক্য খুব সামান্যই। তবে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ঐ সময়ের রক্ষনশীল ও মৌলবাদী মুসলমানদের কাছে সমাদৃত হয় নাই। তৎকালিন প্রভাবশালী রক্ষনশীল আলেম তাকিউদ্দিন খলিফা মামুনকে নাস্তিক ঘোষনা করেন। তাকিউদ্দিনের বক্তব্য ছিলো যে পৃথিবী গোলাকার এই ধারণা কোরআন এবং হাদিস বিরোধী।
তিনি খলিফা মামুনের ওপর আল্লাহর গজব কামনা করেন।
মুতাযিলা মতবাদঃ
মুতাযিলারা মূলত স্বাধীন চিন্তাবীদ হওয়ায় তাদের নিজেদের চিন্তা ভাবনায়ও অনেক পার্থক্য ছিলো। তারপরও অধিকাংশ মুতাযিলা পন্ডিত মোটামুটিভাবে কিছু বিষয়ে একমত পোষন করতেন। এখানে এইসব মতের সারমর্ম আলোচনা করা হলো।
আল্লাহর একত্ব;
মুতাযিলারা আল্লাহর পরম একত্বে বিশ্বাস করতো।
আল্লাহর ওপর কোন রকম নরত্ব ও বহুত্ব আরোপের বিরোধীতা করতো মুতাযিলারা। এমনকি আল্লাহর যেসব গুনের কথা কোরআন হাদিসে বলা হয়েছে সেইসব গুনের আলাদা অস্তিত্বের ধারণাও আল্লাহর অস্তিত্বে বহুত্ব আরোপ করে বলে মনে করতো তারা। মুতাযিলা মত অনুযায়ী আল্লাহর গুন আল্লাহর অস্তিত্ব থেকে পৃথক কিছু না। অর্থাৎ “আল্লাহ জ্ঞানবান” এই কথার অর্থ এই নয় যে আল্লহর জ্ঞান নামক গুন আছে, বরং আল্লাহর এই জ্ঞান এবং আল্লাহ একই।
আল্লাহর ন্যায়পরতা এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিঃ
কাদরিয়াদের মতো মুতাযিলারাও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার পক্ষে সমর্থন করতো।
তাদের মতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে এবং মানুষের কর্মের স্রষ্টাও মানুষই, আল্লাহ নয়। মানুষের পাপ পূন্যের জন্যও মানুষই দায়ী, আল্লাহ নয়। মুতাযিলারা একই সাথে আল্লাহর চরম ন্যায়পরতায় বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো আল্লাহর পক্ষে কোন অন্যায় সমর্থন করা বা অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ যদি ন্যায়বান না হন তাহলে পরকালের ন্যায়বিচার প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনা।
আল্লাহ কখনোই তার বান্দাদের সাথে অন্যায় করেনা, করতে পারেন না। মুতাযিলারা মানুষের স্বাধীনতার জোর সমর্থক ছিলেন। তাদের মতে মানুষের স্বাধীনতা এবং আল্লাহর ন্যায়পরতা পাশাপাশি বিদ্যমান। এছাড়াও কোন নবী বা পিরের সুপারিশে আল্লাহ তার বিচার পরিবর্তন করবেন এ ধারণার বিরোধীতা করতো মুতাযিলারা।
বিচারবুদ্ধি ও অহির তুলনাঃ
মুতাযিলারা মানুষের বিচারবুদ্ধি এবং অহী কে সম মর্যাদা দিতো।
তারা মনে করতো অহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে যেমন স্রষ্টা সম্বন্ধে জানা সম্ভব তেমন বিচারবুদ্ধি এবং যুক্তি প্রমানের মাধ্যমেও জানা সম্ভব। তারা মনে করতো, বিচার বুদ্ধির মাধ্যমেই আল্লহর স্বরুপ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। শেষদিকের কাদরিয়া এবং মুতাযিলা মতে আস্থাশীল ধর্মতাত্ত্বিক আল-নুমাইরির মতে, নবিদের মধ্যস্ততা ছাড়াও বিচার বিশ্লেষনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক রহস্য উদঘটন সম্ভব।
কোরআনের সৃষ্টতাঃ
রক্ষনশীল ধর্মতত্ত্বে কোরআনকে অসৃষ্ট বলে মনে করা হয়। কোরআন আল্লাহর বাণী, তবে এই বাণী কোন বিশেষ সময়ে সৃষ্ট না।
আল্লাহর মতো তার বাণীও অসৃষ্ট এবং অনন্তকাল ধরে আল্লাহর সাথেই বিরাজমান। মুতাযিলারা এই মতের বিরোধীতা করেন। তাদের মতে কোরআন যদিও আল্লাহর বাণি তবে তা একটি বিশেষ সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।
দিব্যদর্শনঃ
আল্লাহকে চোখে দেখা যায় বা কেউ দেখেছে বা দেখতে পাএ এধরণের ধারণার বিরোধীতা করতো মুতাযিলারা। তাদের মতে কোরআনে আল্লাহকে দেখার যে কথা বলা হয়েছে তা আসলে চামড়ার চোখে দেখার কথা না বরং অন্তরের চোখে দেখার কথা।
আল্লাহর কোন শরীর আছে এই ধারণার বিরোধীতা করতো মুতাযিলারা। মোহাম্মদ কখনো আল্লাহকে চাক্ষুষভাবে দেখেছেন এ ধারনার বিরোদ্ধে ছিলো তাদের অবস্থান।
মুতাযিলাদের বিরোধীতা ও পতনঃ
মুতাযিলাদের পতনের সাথে দুইজন ব্যক্তির নাম জড়িয়ে আছে। একজন হচ্ছেন খলিফা মুতাওয়াক্কিল এবং অপর জন হচ্ছেন বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক আল আশারি। রক্ষনশীল মুসলমানরা প্রথম থেকেই মুতাযিলাদের ধর্ম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে।
তবে আব্বাসিয় খলিফাদের কারণে মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় নাই। তবে খলিফা মামুনের শাসনের শেষ দিকে তার প্রতিষ্ঠিত ‘মিনা’ ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে পরে। খলিফা মামুন মূলত খলিফা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন। কিন্ত তার শাসনের শেষ ভাগেই ‘ওলামা’ সম্প্রদায় অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভুত হয়। রক্ষনশীল এবং মৌলবাদিরা পুরো আব্বাসিয় খলিফাদের সময়টাকেই অধার্মিক সময় হিসাবে চিহ্নিত করে।
কট্রর হাদিস পন্থি সুন্নি মাজহাব ‘হাম্বলি’ মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হাম্বলি সবসময়ই আব্বাসিয় খলিফাদের খলিফা কেন্দ্রিক শাসনের বিরোধীতা করেন। খলিফা মামুনকে নাস্তিক ঘোষনা করার কথা আগেই বলেছি। তবে মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল লড়াইয়ে নামেন আশারিয়া পন্থার প্রতিষ্ঠাতা আল আশারি (৮৭৪-৯৩৬)। আল আশারি মানুষের স্বাধীন চিন্তার প্রবল বিরোধীতা করেন, কেননা তার মতে মানুষের যদি স্বাধীন ভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকে তাহলে আল্লাহ স্বর্বশক্তিমান হতে পারেন না। আল্লাহ কোন নীতি নৈতিকতার অধিন না, এমনি বক্তব্য ছিলো আল আশারির।
তার মতে, আল্লাহ যাকে খুসি বেহেশত দান করবেন আর যাকে খুশি দোযখ। আল্লাহর আদেশ মানাই হচ্ছে নৈতিকতা এবং পূন্য আর না মানাই হচ্ছে পাপ এবং অনৈতিকতা। আল্লাহ নিজে কোন নৈতিকতা মানতে বাধ্য নন। তিনি ইসলামে যুক্তি তর্কের অধিক ব্যবহারেরও বিরোধীতা করেন। কথিত আছে তিনি একবার খলিফার দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের গায়ের জামা টুকরা টুকরা করে ছিড়ে ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন, যুক্তি তর্ককে আমি এইভাবে টুকরা টুকরা করে ছিড়ে ফেললাম, ইসলামে যুক্তি তর্কের কোন স্থান নাই।
বিনা প্রশ্নে আত্মসমর্পণ আর বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলাম। আল আশারি দাবী করেন তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে মহানবী তাকে মুসলমানদের দায়িত্ব নিতে বলছেন। এরপরই তিনি মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। আল আশারির হাতেই মৃত্যু হয় যুক্তিবাদী ইসলামি ধর্মতত্ত্বের। তার প্রায় কয়েক শতাব্দি পর তারই এক ভক্ত ইমাম গাজালির হাতে মৃত্যু ঘটে ইসলামী দর্শন চর্চার।
মুতাযিলাদের আসল দুর্দশা শুরু হয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল ক্ষমতায় আরোহন করার পর। মুতাওয়াক্কিল ছিলেন দশম আব্বাসিয় খলিফা। তিনি মুতাযিলাদের ওপর থেকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোশকতা তুলে নেন। সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় মুতাযিলা নিধন। অল্পকিছু দিনের মধ্যে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মুতাযিলারা, কোন মতে টিকে থাকে দশম শতাব্দি পর্যন্ত।
তাদের সব বই পুস্তক গবেষনা পত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। মুতাযিলাদের কোন বই পুস্তকএখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তা জানা যায় তাদের বিরোধীদের বই পুস্তক থেকে। একই ঘটনা ঘটেছিলো আমাদের এখানকার চার্বাকদের ক্ষেত্রেও।
প্রথম পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।