রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী ঈমানকে পূর্ণাঙ্গ করতে হলে প্রতিটি মুসলমানকেই স্বীয় নিজের জীবন, মাতা-পিতা ও সন্তান-সন্তুতি, পরিবার, সম্পদসহ সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে তাঁকে। যার হৃদয়ে প্রিয়তম রাসূল সা.-এর ভালোবাসা নেই, তার হৃদয় অন্ধ, আলোহীন। সে হৃদয় জাহান্নামের উপযুক্ত।
এ কথা তিনি নিজেই ইরশাদ করেছেন বিভিন্ন হাদীস শরীফে।
ইমাম বুখারী রহ. বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গেই ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সা. হযরত ওমরের হাত ধরে আছেন। ওমর রা. আরয করলেনÑ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার কাছে শুধু আমার ‘জীবন’ ব্যতিত আর সকল কিছুর চাইতে অধিক প্রিয়। ’
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করলেনÑ ‘না! সেই সত্তার কসম, যাঁর কুদরতী হাতে আমার প্রাণ! যতণ পর্যন্ত আমি তোমার কাছে তোমার নিজের চেয়েও অধিক প্রিয় না হব...। ’ ওমর রা. বললেন, ‘আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয়।
’
ওমর! এখন হয়েছে। বললেন, নবীজী সা.। (বুখারী ১১ : ৫২৩)
জগদ্বিখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাণীর ব্যাখ্যায় লিখেন, ‘আমি যতণ পর্যন্ত তোমার কাছে তোমার স্বীয় প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় বলে বিবেচিত না হবো, ততণ পর্যন্ত তোমার ঈমান পূর্ণাঙ্গ হবে না। ’ (উমদাতুল কারী, ২৩ : ১৬৯)
‘এখন হয়েছে ওমর!’ এ কথার ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী রহ. লিখেছেন, ‘ওমর! এতণে তোমার ঈমান পূর্ণ হলো!’ (প্রাগুপ্ত)
এই হাদীসে সবিশেষ লণীয় বিষয় হলো, হযরত রাসূলুল্লাহ সা. আল্লাহর কসম করে বলেছেন, পর্ণাঙ্গ মুমিন হতে হলে অবশ্যই তাঁকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসতে হবে। অথচ তাঁর সত্তা তো এমনিতেই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
তাঁর কথাতো এমনিতেই সকল সংশয় ও দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। তারপরও কসম করে বলেছেন, যাতে কারো মনে কোনরূপ দুর্বলতা ও অস্পষ্টতা না থাকে। ’ (উমদাতুল কারী, ১ : ১৪৩)
অন্য হাদীসে তিনি ইরশাদ করেছেনÑ ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের মধ্যে কেউই মুমিন হতে পারবে না, যতণ পর্যন্ত আমি তার কাছে মা-বাবা ও সন্তানের চেয়েও অধিক প্রিয় বলে বিবেচিত না হই। ’ হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী। (বুখারী ১ : ৫৮)
এ মর্মে আরেকটি হাদীসের ভাষ্য এরকমÑ ইমাম মুসলিম রহ. হযরত আনাসের রা. সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেনÑ ‘কোন বান্দা ততণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, যতণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পরিবার, সম্পদ ও অন্য সকলের চেয়েও অধিক প্রিয় না হবো।
(মুসলিম শরীফ ১ : ৬৭)
একথা বলার অপো রাখে না, প্রিয়তম নবী সা. আমাদের ভালোবাসার প্রতি ঠেকা নন। আমরা অধমরা তাঁকে ভালোবাসি আর নাই বাসি এতে তার গগণস্পর্শী মর্যাদা, অপার সম্মান ও ভাষাতীত ব্যক্তিত্বের কিছু যায় আসে না। যিনি মহান সৃষ্টিকর্তা, মহান প্রভুর ভালোবাসা লাভে ধন্য ও গৌরবান্বিত, তাঁর আবার কার ভালোবাসা চাই? এখানেই কি শেষ? মহান প্রভুর দরবারে তাঁর মর্যাদা এত উচ্চতর যে, যদি কেউ তাঁকে অনুসরণ করে, তাঁর পথ অনুসরণ করে যদি কেউ, তাহলে সেও পরিগণিত হয় মহান প্রভুর প্রিয়পাত্রে। তাকেও ভালোবাসেন আল্লাহ। মা করে দেন তার পাপ তাপ।
এ মর্মে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন : ‘বলুন! তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার আনুগত্য কর! (যদি কর) তাহলে তিনিও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন, তোমাদের অন্যায় অপরাধ মা করে দিবেন আর আল্লাহ তো পরম মাশীল, দয়ালু। ’ (সূরা আলে-ইমরান : ৩১)
ঈমানই মুমিনের প্রধান গুণ। এক অমূল্য সম্পদ ঈমান। ঈমানের স্বাদ পেতে হলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়। তবেই ঈমানের স্বাদ অনুভব করা যায়।
সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো, রাসূলুল্লাহ্ সা. কে জগতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে হবে। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. সাহাবী হযরত আনাস রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল তার কাছে জগতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হবে, কাউকে ভালোবাসলে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ভালোবাসবে আর আগুনে নিপ্তি হওয়াকে যেমন ঘৃণা করে তেমনি ঘৃণা করবে কুফুরি জীবনে ফিরে যাওয়াকে। ’ (বুখারী -১ : ৬০ মুসলিম-১ : ৬৬)
উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ঈমানের স্বাদ অর্থ আল্লাহর আনুগত্য ইবাদত-বন্দেগীতে বিশেষ স্বাদ ও অনুরাগ অনুভূত হয়। তখন সহজেই দীনের জন্য যেকোন কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া সম্ভব হয়।
সম্ভব হয় পরকালের আহবান রায় পার্থিব জীবন ও সম্পদের যেকোন বিসর্জন দেওয়া। একজন মুমিনের জন্য এটা এক অসাধারণ উপহার।
ণিকের এই ভালোবাসার আরেক বিস্ময়কর পুরস্কার হলÑ যে ব্যক্তি হযরত রাসূলুল্লাহ সা. কে ভালোবেসেছে, সে পরকালে তাঁর আলোকিত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে। একথাই ফুটে উঠেছে একটি হাদীসে এভাবেÑ হযরত ইমাম মুসলিম রহ. বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেনÑ তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর দরবারে এসে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! কেয়ামত কবে হবে?
কেয়ামতের জন্যে কী প্রস্তুতি নিয়েছ? নবীজীর প্রশ্ন।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি! সাহাবীর সহজ উত্তর।
তুমি যাকে ভালোবাস, তার সাথেই থাকবে!
হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর কথায় আমরা এতটা আনন্দিত হয়েছি, ইসলাম গ্রহণের পর অন্যকোন কারণে আর এতটা আনন্দিত হইনি।
হযরত আনাস রা. বলেন, আমি আল্লাহকে ভালোবাসি, ভালোবাসি রাসূলুল্লাহ সা. ও হযরত আবু বকর এবং হযরত ওমর রা. কেও। আমার আমল যদিও তাঁদের সমতূল্য নয় তবুও আমি আশাবাদী, আমি পরকালে তাঁদের সঙ্গেই থাকবো!
এ সম্পর্কে বর্ণিত আরেকটি হাদীসের ভাষ্যÑ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর খেদমতে এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কী বলেন, যে একটি গোষ্ঠীকে ভালোবাসে অথচ তাদের সমান নেক আমল করতে পারেনি! ইরশাদ করলেন, আল মারউ মা’আমান আহাব্বা। যে যাকে ভালোবাসে তার হাশর হবে তারই সাথে। ’ (বুখারী ১:৫৫৭ : মুসলিম ৪ : ২০৩৪)
এর মর্ম হলো, যাকে সে ভালোবাসে সে তার সাথেই জান্নাতবাসী হবে।
(উমদাতুল কারী ২২ : ১৯৭)
একজন সত্যিকার মুমিনের জীবনে এরচে’ বড় প্রার্থনা আর কী হতে পারে? এরচে’ বড় প্রাপ্তি ও পুরস্কারই বা আর কী হতে পারে?
সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবীকে ভালবাসতেন। অপার্থিব সে ভালোবাসা। পৃথিবীর ইতিহাসে যার নজীর মেলা ভার। রাসূলের প্রতি তাঁদের ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের অসংখ্য ঘটনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সীরাতের কিতাবগুলোতে। কেন তারা তাঁকে এভাবে ভালোবাসবেন না? ভালোবাসার কোন্ উপাদানটি নেই তাঁর মধ্যে? সৌন্দর্য? তিনিতো সকল সৌন্দর্য্যরে আধার! চাঁদও যাঁর সৌন্দর্য্যরে সামনে লজ্জায় মুখ লুকায়! ব্যক্তিত্ব? গুণাবলী? তাঁর পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, অনুপম ও গুণাবলীর স্বীকৃতি তো তাঁর শত্র“রাও দিয়েছে অবলীলায়! অবদান? বিশ্বমানবতার জন্য কী অবদান নেই তাঁর? পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর সবই তো তাঁর অবদান! আর নৈকট্য? হ্যাঁ, তিনিই তো আমাদের সবচেয়ে আপনজন।
কাছের মানুষ।
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে যেসব কারণে ভালোবাসতে পারে, সেসব কারণই তাঁর একার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। এজন্য তাঁকে ভালোবাসতে হবে। মুমিন হতে হলে তাঁকে ভালোবাসতেই হবে। নবীর প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা ঈমানের পূর্বশর্ত।
কারো মধ্যে এর সামান্য ঘাটতি থাকলে তাকে পূর্ণ ঈমানদার বলা যাবে না। এজন্যই যুগে যুগে কত সাধক কত আলি-আউলিয়া তাঁকে ভালোবেসেছেন, ভালোবাসছেন, ভালোবাসবেন। আমরাও তাঁকে ভালোবাসি। অন্তত ভালোবাসি বলে দাবি করি।
এখন চলছে মাহে রবিউল আউয়াল।
প্রিয়নবীর স্মৃতিবিজড়িত মাস। এ মাসে আমরা তাঁর প্রতি ভালোবাসার মহড়া দেখাব। আনুষ্ঠানিকতা পালন করব। জশনে জুলুস মিছিল বের হবে। আলোচনা সভা হবে।
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হবে। আমাদের নেতানেত্রীরা সেখানে বক্তব্য রাখবেন। নবীর প্রতি ভালোবাসার উচ্ছ্বাস দেখাবেন। আবেগপ্লুত হয়ে পড়বেন। তাঁর উত্তম আদর্শের কথা বলবেন।
তাঁর আদর্শ ছাড়া সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে নাÑ এমন কথাও বলতে দ্বিধা করবেন না । আমরাও তাদেরকে নবীপ্রেমিক, আশেকে রাসূলের সার্টিফিকেট দিয়ে দেব।
কিন্তু আসুন না, একটু বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, আমরা কি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসি? বছরে একবার জশনে জুলুস, আলোচনা সভা আর সেমিনারের গালভরা বুলিই কি তাঁর প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ?
একজন প্রকৃত প্রেমিক তো তার প্রেমাষ্পদকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। প্রতিটি েেত্র তাকে অনুসরণ করে। তার ব্যথায় ব্যথিত হয়।
প্রেমাষ্পদের একটু সন্তুষ্টির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তিনি যা অপছন্দ করেন শত কষ্ট হলেও তার ধারে কাছেও যায় না। আমাদের ভালোবাসাটা কি সে পর্যায়ের? রাসূল যা করতে বলেছেন, আমরা কি তা করি? রাসূল যা করতে নিষেধ করেছেন, আমরা কি তা থেকে বিরত থাকি? জীবন ও জগতকে নিয়ে তিনি যেভাবে ভেবেছেন, আমরা কি সেভাবে ভাবি? আমাদের রাজনৈতিক দর্শন-কর্মসূচি, আমাদের চিন্তা-চেতনা কি তাঁর দর্শন-কর্মসূচি ও চিন্তা চেতনার অনুগামী? তিনি রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির যে ফর্মূলা বাতলিয়েছেন, আমরা কি তা অনুসরণ করি? না তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি? দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তাঁর যে কর্মসূচিÑ তাবলীগ, তা‘লীম, তাযকিয়া, জিহাদ, আমরা তা পুরোপুরি না আংশিক পালন করি? তাঁর আনীত দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের ধারণা কি পূর্ণাঙ্গ না খণ্ডিত? আমাদের চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ কি তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণের মত? আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ কি তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদের মত? তাঁকে কেউ কষ্ট দিলে, তাঁর শানে কেউ বেয়াদবী করলে, তাঁর ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করলে আমরা কি কষ্ট অনুভব করি? ঐসব বেয়াদবের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে, তাঁর ইজ্জত রার্থে আমাদের অন্তরে কি কোন দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ বাচক হয়, তাহলে তো আমরা সফলকাম। আমরা প্রকৃত অর্থেই আশেকে রাসূল, নবীপ্রেমিক। আর যদি ‘না’ বাচক হয়, তাহলে আমরা কেমন আশেকে রাসূল? কেমন নবীপ্রেমিক? এটা কি ভালোবাসা? না ভালোবাসার অভিনয়? ভালোবাসার নামে প্রতারণা? আত্মপ্রবঞ্চনা? শুধু কথায় নয়, আমরা কি কাজেও তাঁর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারি না? প্রকৃত অর্থেই আশেকে রাসূল-নবীপ্রেমিক হতে পারি না?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।