আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানের দর্শন ও বিজ্ঞান তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চা (পর্ব-১)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র

ভূমিকাঃ গোটা ইউরোপ যখন ডুবে ছিলো অন্ধকার আর অজ্ঞানতায় তখন গ্রিক-রোমানদের যোগ্য উত্তরসুরী হিসাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার জগতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে গেছে আরবের মুসলিম সভ্যতা। মোটামুটি ৭০০খ্রিঃ থেকে ১৪০০ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালটায় বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং সংগঠন এই জ্ঞান চর্চায় নেতৃত্ব দেন। মুক্তচিন্তা আর যুক্তিবাদই ছিলো আরব বিশ্বের এইসব মহান চিন্তাবীদের জ্ঞান চর্চার মূল খুঁটি। মৌলবাদ আর রক্ষনশীলতার সাথে বরাবরই ছিলো তাদের বিরোধ। অথচ আজকের দিনে বহু মৌলবাদী আর রক্ষনশীল গোষ্টি এইসব মহান চিন্তাবীদের নাম ভাঙিয়ে তাদের নিজস্ব মতবাদ প্রচার করতে চায়।

মুক্তমনা আর যুক্তিবাদী এমন বহু চিন্তাবীদকে আজকের অনেক প্রাচীনপন্থি আর মৌলবাদী ব্যাক্তি আর সংগঠন দাবি করে নিজেদের সমগোত্রীয় মানুষ হিসাবে, যা রিতিমত অবমাননাকর। এই ধরণের দাবির জবাব দিতে গিয়েই একবার একটা তালিকা করতে বসেছিলাম। লাঞ্চিত, অত্যাচারিত এবং কাফির, মুরতাদ এহেন নানা অভিধায় ভূষিত মুসলিম চিন্তাবীদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানিদের তালিকা। তালিকা করতে গিয়ে একটা ঝামেলা বেধে গেলো। নামকরা যত মুসলিম বিজ্ঞানী আর দার্শনিক রয়েছেন তাদের মধ্যে কাকে কাকে তালিকার বাইরে রাখা যায় তা নিয়েই বিপদে পরতে হলো।

অবস্থা এমন যে অন্তত কাফির, মুরতাদ ঘোষিত হয়েছেন এমন তালিকা তৈরি করার বদলে কে কে ঘোষিত হন নাই তার তলিকা করার প্রয়োজন দেখা দিলো। ইসলামের ইতিহাসে মুক্তচিন্তার সাথে রক্ষনশীলতার এই সংঘর্ষ সেই ইসলামের একেবারে প্রারম্ভিক যুগ থেকে। এখানে আমি মোটামুটি একটা ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা করতে চাচ্ছি, কাদরিয়া আন্দোলন থেকে শুরু করে ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগের সর্বশেষ মহান চিন্তাবীদ ইবনে খালদুন পর্যন্ত। পটভূমিঃ মোহাম্মদ পরবর্তি ইসলাম ইসলামি সভ্যতায় মুক্তবুদ্ধি চর্চার যে ইতিহাস তার প্রাথমিক বিকাশ মোহাম্মদ পরবর্তি বহুধাবিভক্ত এবং অস্থির একটা সময়ে, একেবারে ইসলামি আন্দোলনের ভেতর থেকেই। আর পরবর্তি পর্যায়ে গ্রিক, রোমান আর ভারতিয় জ্ঞান বিজ্ঞানের সংস্পর্শে তা আরো বেগবান হয়ে ওঠে।

ইসলামের নবি হজরত মোহাম্মদ (স) এর মৃত্যু ঘটে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। তার মৃত্যুর পর থেকেই খলিফা নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে বিভেদ দেখা দেয়। সেই সাথে আইন, শরিয়ত ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে নানা বিরোধীতার সূত্রপাত হয়। সুন্নি মুসলমানরা এখন যেমন কোরআনএর পরই হাদিসকে জ্ঞান আর আইনের মূল উৎস হিসবে গ্রহণ করে তখনো সেই চর্চা শুরু হয় নাই। হাদিসগ্রন্থগুলো লিখিত হয় মোহাম্মদের মৃত্যুর ১৫০/২০০ বছর পর।

ছহিহ সিত্তা স্বিকৃত ৬ টি হাদিসের পুস্তককে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে প্রচার শুরু হয় মোহাম্মদের মৃত্যুর ২৩০ বছর পর, প্রতিষ্ঠা পেতে সময় নেয় আরো বহু বছর। এ সময়ের মধ্যে ইসলামি জগতে জন্ম নেয় বহু মতাদর্শ, জন্ম নেয় বহু মাজহাব আর ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্টি। ইসলাম বলতে এখন আমরা যা বুঝি তার তখনো সৃষ্টিই হয় নাই। সুন্নি মাজহাবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোন মাজহাব হানাফি মাজহাব। এই মাজহাব মূলত ব্যক্তিগত বিচার বুদ্ধি, যুক্তি-তর্ক, ঐক্যমত তথা ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে আইন প্রয়োগ এবং ধর্মিয় সমাধানের পক্ষে ছিলো, ছহিহ সিত্তা নামক আইনখন্ড তখনো প্রতিষ্ঠা পায় নাই, কঠোর হাদিসপন্থি হাম্বলি মাজহাবের আগমন তখনো হয় নাই।

আলী আর মুয়াবিয়ার বিরোধের সময় খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবির্ভাব ঘটে খারিজি সম্প্রদায়ের। খারিজিরা মনে করতো আল্লাহর স্বিদ্ধান্ত সমাজের সকলের উপস্থিতিতে স্বাধীন গণতন্ত্রের মাধ্যমে জানা যায়। খলিফা নির্বাচনে খারিজিরা তাই গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলো, তারা মনে করতো যোগ্যতা থাকলে একজন গোলামও খলিফা হতে পারে। মূলত কঠোর ধর্মনিষ্টার অনুসারী খারিজিদেরকে প্রথম থেকেই সুন্নি আর সিয়ারা ধর্মত্যাগী হিসাবে আখ্যায়িত করে আসছে। খারিজি শব্দটাকে এখন নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়।

আজারিদাহ নামক সম্প্রদায়ের মুসলমানরা মনে করতো কোন শিশুকে ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত করা উচিত না, সাবালক হলেই শুধুমাত্র তাকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া উচিত। মুসলমানদের একটা বড় অংশই ছিলো অক্ষরবাদী, অর্থাৎ কোরআনকে শাব্দিক অর্থ গ্রহণে পক্ষপাতি ছিলো, এদের অনেকেই আল্লাহর শরীর, হাত, পা, মুখ ইত্যাদি আছে বলে বিশ্বাস করতো, এদের মধ্যে হিশাম বিন আল-হাকাম এবং আবদুল্লাহ বিন কাররাম এবং তাদের অনুসারিরা উল্লেখযোগ্য। সালাফি এবং ওয়াহাবিরা পরবর্তিতে এই বিশ্বাস ধরে রাখে। কিছু গোষ্টি আবার কোরআনের আয়াতের রুপক অর্থে গ্রহনের পক্ষপাতি ছিলো। আমি যে সময় থেকে আলোচনা শুরু করবো সেই সময়টা ছিলো উমায়ইয়া খলিফাদের শাসনামলের শুরুর সময়।

রাজনৈতিক ভাবেও সময়টা ছিলো উত্যপ্ত। কাদরিয়া সম্প্রদায়ঃ ইসলামে চিন্তাজগতে মুক্তচিন্তার পক্ষের আন্দোলনের ইতিহাস শুরু করতে চাই কাদরিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের সময় থেকে। সময়টা ছিলো উমাইয়া শাসনামলের প্রারম্ভিক সময়। কাদরিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে উমাইয়া সম্প্রদায়ের সপক্ষের ধর্মতাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবি শ্রেনী জাবরিয়া সম্প্রদায়ের বিরোধীতার মাধ্যমে। উমাইয়া খলিফারা তাদের শাসনের শুরুর দিকে চরম স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসনের রাজত্ব কায়েম করে।

রাষ্ট্রিয় অত্যাচার আর সন্ত্রাস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে এসময়। চলে একের পর রাজনৈতিক হত্যাকান্ড, হত্যাযজ্ঞ। নিজেদের অন্যায় অত্যাচারকে বৈধ করার প্রয়াস পায় উমাইয়ারা জাবরিয়া মতাদর্শের মধ্যে। তৎকালিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায় জাবরিয়ারা অলঙ্ঘনিয় ভাগ্য (তকদির)এ বিশ্বাস করতো। তারা বিশ্বাস করতো যা কিছু ঘটে সবই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়।

এমনকি যেকোন অন্যায় অত্যাচার যুদ্ধ বিগ্রহ এসবও ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। মানুষের কোন স্বাধীনইচ্ছা নেই, থাকতে পারে না। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া এ জগতে কিছুই ঘটেনা। এর পক্ষে তারা কোরআনের বিভিন্ন আয়াত প্রমান হিসাবে হাজির করে। জাবরিয়াদের এই মতেরই প্রতিদ্ধনী হিসাবে উমাইয়ারা দাবি করতো তারা কোন অন্যায় করে না, কেননা তারা যা করে সব আল্লাহর ইচ্ছায়ই করে, আল্লাহ না চাইলে তারা কোন হত্যাকান্ড ঘটাতে পারতোনা।

জাবরিয়ারাও এই মতের সমর্থন করতো। জাবরিয়া সম্প্রদায় আর উমাইয়াদের এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষনা করে আবির্ভাব ঘটে কাদরিয়া সম্প্রদায়ের। কাদরিয়ারা মনে করতো, মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী এবং ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক নির্ধারণের ক্ষমতা রাখে। তাই নিজের অন্যায়ের দায় কেউ আল্লাহর ইচ্ছার ওপর চাপাতে পারেনা। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের উল্লেখ করে তারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার পক্ষে প্রমান হাজির করে।

এ মতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাবাদ আল জুহানি (মৃঃ ৬৯৯)। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন গাইলান আল দিমেস্কি (মৃঃ ৭৪৩), ওয়াসিল বিন আতা (মৃঃ ৭৪৮, ইউসুফ আল আসয়ারি, আমর বিন ওবাইদ (ম্রিঃ ৭৬২) এবং বিখ্যাত দরবেশ হাসান আল-বসরি (মৃঃ ৭২৮)। স্বাধীঞ্চেতা ও মুক্তবিদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসাবে কাদরিয়ারা উমাইয়া খলিফাদের কাছে তাদের অন্যায় ও নির্যাতনের জবাবদিহিতা চায়। কাদরিয়াদের মতবাদ উমাইয়া খলিফাদের সরাসরি বিপক্ষে যাওয়ায় উমাইয়া শাসকরা কাদরিয়াদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। প্রকাশ্যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মতবাদ প্রচার করার জন্য মাবদ আল জুহানিকে হত্যা করা হয়।

তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং খলিফা ইবনে আবদুল মালেক (৬৮৫-৭০৫)। মূল নেতার মৃত্যুর পরও এই আন্দোলন থেমে যায় নি। গাইলান আল দিমেস্কি এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরবর্তিতে খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালেকের নির্দেশে (৭২৪-৭৪৩) তাকেও হত্যা করা হয়। বহু অন্যায় অত্যাচারের ফলে একসময় কাদরিয়া আন্দোলন স্থিমিত হয়।

তবে কাদরিয়া আন্দোলনের ছাই থেকেই জন্ম নেয় আরো শক্তিশালী বুদ্ধিবাদী আন্দোলন মুতাযিলা আন্দোলন। মুতাযিলাদের সময়ই ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগের সুচনা হয়। পরবর্তি পর্বে মুতাযিলা পন্থিদের উত্থান এবং আশারিয়া পন্থিদের হাতে এই মুতাযিলা পন্থিদের পরাজয় নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখি। (চলবে) দ্বিতীয় পর্ব

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.