পাঠশালার ছাত্র এখনো
কালু...ঐ কালু....কই গেলি রে ??
ভাঙ্গা খনখনে ম্রিয়মান স্বর।
সূর্য পাটে যেতে যেতেও একটু যেন থমকে দাঁড়ায় ডাকটা শুনে। বহুব্যবহারে চকচকে হয়ে যাওয়া বাঁশের লাঠিটা ঠকঠকিয়ে বুড়ি এসে দাঁড়ায় হোগল পাতার বেড়া ঘেঁষে। আজকাল চোখে ছায়া ঘনাচ্ছে দিন-দুপুরেই, সন্ধ্যার কার্ণিশেই নামে নিকষ আঁধার। কোথায় যে গেল ? আপন মনেই বিড়বিড়িয়ে ওঠে বুড়ি।
জায়গাটা বেশ নির্জন। নির্জন গ্রামের নির্জনতার মাঝেও জায়গাটুকু একটু ঘন নির্জনই। দক্ষিণে তাকিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বুড়ি। ছেলেরা বড় ঘরে উঠেছে বছর দু'এক আগেই। বউ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অনেক জায়গা প্রয়োজন বলে বুড়ির বরাদ্দে স্বামীর ঘর শেষ অবধি লেখা হল না।
স্বামী জীবিত থাকতে অবশ্য রাণীর হালে ছিল বুড়ি। বিঘা কে বিঘা জমি..হালুটি..রাখাল...সোরগোল বাড়ি জুড়ে সারাক্ষণ। জামাল আর কামাল তো বাপের আদরের ধন। আদরে আদরে পড়াশোনাটা হল না। মদ-গাঁজা, তাস, যাত্রা আর জুয়ার নেশায় সেরা পারফরমেন্স দেখাতে শুরু করল।
এরপর বাপ চলে গেল একদিন। আর পায় কে জামাল-কামালকে...দুনিয়ায় ওলট-পালট তুলে, সারা গ্রাম সজাগ করে বাপের বিষয় সম্পত্তির হিসেব নিয়ে বসল। টানা তিনমাসের হিসাব শেষে, একদিন সন্ধ্যারাতে দুইজনে দুই বউ বগলদাবা করে বাড়ি ফিরলো সুযোগ্য সন্তানরা। অশান্তি যথারীতি।
বউ-শাশুড়ি...কুটকাচালি....নালিশ...শালিশ....
'মা, দ্যাখো..তুমি একটু তাল মিলাইয়া চলতে পারোনা তোমার পুতবউগো লগে? সারাজীবনই তুমি বড্ড তেজ দ্যাখাইলা।
এত তেজ ভাল না। ' ছোট ছেলের উদ্ধত কথায় হঠাৎ করেই জীবনের অংক আরেকবার নির্ভুল প্রমান হলো বুড়ির কাছে। নানা পথ পরিক্রম করে বুড়ির আবাসস্থল তৈরি হয় তাপ্পি-তালি মারা টাইপ টিন-কাঠ-পেরেক পিটিয়ে...বাড়ির একটু দূরে বাগানের কিনারায়। সেই ছোট্ট ঘরের সামনে হোগল পাতা দিয়ে আরেকটা ছাউনি দিল বুড়ি। তৈরি হল একমাত্র সঙ্গী ছাগল, আঁধার কালো 'কালু'।
'ম্যা...'
চমকে উঠে দেখতে পায় বুড়ি ছাগলটাকে।
'আরে বাছা, কই ছিলি তুই?'
অন্ধকার কোন থেকে টেনে কোলে জড়িয়ে নিল কালুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বিড়বিড় করে রাজ্যির যতো কথা। ফাঁকে ফাঁকে কিছু দেখা-অদেখা পাঁজরভাঙা দীর্ঘশ্বাস। হোগল বেড়ার খাঁজে পুরে রাখা কাঠাল পাতার ডালটা বের করে কালুর সামনে রেখে আবার লাঠি ঠুকঠুক করে ঘুম-ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
এই ঘরেই একদিন হুট করে অনন্ত ঘুমপুরীর রথযাত্রীরা চলে আসবে। ঘরে ঢুকে হারিকেন বাড়িয়ে দিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে আর একটা নতুন রাতের পথে হাঁটতে শুরু করলো সময়। হুঁকোর টানে গুটগুটগুট আওয়াজ তুললো বুড়ি। কাছেই প্রলম্বিত সুরে শেয়াল ডেকে উঠলো কোথাও।
নিস্তব্ধতার মাঝে গুটগুটে শব্দটা হারিকেনের লালচে আলোয় মিশে কেমন তাতানো জান্তব হয়ে উঠছে। জ্বলছে-নিভছে হুঁকোর ডগায় আগুন-ছাই। নিস্তব্ধতার একটা শব্দ আছে...আছে সঙ্গীত। যা কানে শোনা যায় না। যা শুধু মাথার মধ্যে বাজে।
'খাইয়া লন মা। ' ছোট বউর ডাকে সম্বিৎ ফেরে বুড়ির। টিনের কানাতোলা থালাটায় ভাত-তরকারি একসাথে মাখিয়ে গামছায় ঢাকা খাবারটা কেন জানি আজ খেতে ইচ্ছে করছে না বুড়ি'র।
'রাইখা যাও। পরে খামু।
'
ছোট বউ চলে যেতে উদ্যত হলেই- 'ও বউ, কুরমানী'র আর কয়দিন?'
'এই দিন পনেরো তো হইবই। '
অনেক রাতে ঘুমলো সেদিন বুড়ি। হারিকেন টিম করে রাখা।
ভোররাতে 'ম্যা' করে একবার আর্তনাদ করল কালু। ঘুমের ঘোরেই বিড়বিড় করে কালুকে থামিয়ে দিল বুড়ি।
'আমি যা চিন্তা করছি তাই হইয়া গ্যালো। আমার কালুরে চোরে লইয়া গ্যালো...আয় হায়...আয় হায়....' মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কষ্টটা নামিয়ে ফেলতে চাইছে বুড়ি। টিমটিমে বাতির মতো জ্বলতে থাকা ভাঁজ খাওয়া চোখ দু'টোয় পাতলা জলের প্রলেপ...চকচক করছে। ঠোঁট কাঁপছে রুদ্ধ আবেগে। বুকের মধ্যে ঢেকির পার।
কুঁজো হয়ে যাবার পর আগের মত গতি না থাকলেও লাঠি ঠুকে ঠুকে বড়ঘরে ঠিক পৌঁছে গেল। ছেলে-বউরা দুপুরের খাবার-দাবার সেরে পান-জর্দা নিয়ে বসেছিল, সেই সাথে হাসি-মস্করাও চলছিল। যৌবনের দারুন গন্ধে মৌ মৌ বড়ঘর। সেই বড়ঘর। যে ঘরে কেটেছে.....
ঘরের হাসি-মস্করা থেমে গেল বুড়ি ঢুকতেই।
জামাল বেজায় উৎকন্ঠা নিয়ে আকাশ থেকে পড়লো-
'মা, তুমি? এই সময়?'
কাঁপতে কাঁপতে শতরঞ্চি ফরাসে হেলে শুয়েই পড়লো বুড়ি।
'বাজান রে, আমার কালু রে চোরে লইয়া গ্যালো। আহারে....আহারে....'
লোনাপানি আর বাধ মানলো না...সরসর করে বেরোতে লাগল।
কামাল উড়িয়ে দিল-
'আরে দূর। কে চুরি করব? দ্যাখো দড়ি কাইট্টা কার বাগানে গ্যাছে।
মনে নাই ঐ যে, ঐবার.....। '
কৃত্রিম শান্তনা আর ছেলে-বউদের স্বল্প সময়ের মেকি ভালোবাসা সম্বল করেই লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ফিরতি পথ ধরে বুড়ি। চোরদের সে চিনতে পারল না। নিজের পেটের নোংড়াগুলোকে তো পরিস্কার করার আগেই স্থায়ী-কঠিন হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে বড্ড অবসন্ন-ক্লান্ত লাগছে ক্ষয় ধরা পা দু'টো।
শরীরটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শত টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পরে যেতে চাইছে।
পথটা এত লম্বা কেন? লম্বা আর একা।
কালু...কোথায় তুই কালু....??
****************************************
'বাবা, কাঁঠাল পাতা এনেছো?' কিচিরমিচির শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে আনিকা আর লাবিব। বলতে না বলতে ড্রাইভার বুট খুলে একরাশ কাঁঠাল পাতা বের করে আনলো। ঝিকমিকিয়ে উঠলো কচি মুখদু'টো।
'আব্বু তুমি সো সুইট। ' আনিকা লাফিয়ে ওঠে। লাবিব অনেকগুলো পাতা সহ কাঁঠালের একটা কচি ডাল হাতে এগিয়ে যায়। 'আব্বু, কোরবানী কবে?'
সামনে দাঁড়ানো কালু মুখ তোলে কাঁঠাল পাতার গন্ধে...
ডাক ছাড়ে অসহায় ক্ষুধার্ত স্বর- 'ম্যা.......'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।