কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় জলে সিক্ত,
কত প্রদীপ শিখা জ্বালালেই জীবন আলোয় উদ্দীপ্ত।
কত ব্যথা বুকে চাপালেই তাকে বলি আমি ধৈর্য,
নির্মমতা কতদূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। কেবল হত্যাই নয়, অনেকের লাশ ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল। গণকবর, লাশ ম্যানহোল ও নর্দমায়ও ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
ঠিক এক বছর আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। একাত্তরের পর দেশের ইতিহাসে এরচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর কখনো ঘটেনি। ঐদিন সকালে বিডিআরের বাত্সরিক দরবার শুরুর কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হয় বিদ্রোহী জওয়ানদের তাণ্ডব। আর সেই তান্ডব পরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়।
কিভাবে শুরু হয়েছিল সেই ঘটনা? এর বর্ণনা উঠে এসেছে সেনা তদন্ত আদালতের (কোর্ট অব ইনকোয়ারি) প্রতিবেদনে।
গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর তত্কালীন কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই তদন্ত আদালত গত বছর ১১ মে প্রতিবেদন জমা দেন সেনাপ্রধানের কাছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত সেদিনের দরবার হলের ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি; দরবার শুরুর নির্ধারিত সময় সকাল নয়টা। এর আগেই সবাই এসে পৌঁছায়। মঞ্চের পশ্চিমে হাবিলদার ও নিম্ন পদবির সব বিডিআর সদস্যরা মেঝেতে ম্যাটের ওপরে বসে। তাদের উত্তর পাশে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে দুই সারিতে চেয়ারে বসে কর্মকর্তারা (সেনা ও বিভাগীয় এবং বিডিআর হাসপাতালের বেসামরিক ডাক্তার), তাদের পেছনে তৃতীয় সারিতে বিভিন্ন ইউনিট থেকে পুরস্কার গ্রহণের জন্য আসা কর্মকর্তা, জেসিও (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) ও অন্যান্য পদবির সৈনিকেরা এবং মেঝেতে সৈনিকদের দক্ষিণ পাশে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বিভাবে জেসিও ও সমপর্যায়ের সদস্যরা।
মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারীর বসার ব্যবস্থা করা হয় মঞ্চে।
দরবার শুরু
সকাল নয়টা পাঁচ মিনিট। ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল দরবার হলে প্রবেশ করেন। তাঁর কাছে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হক প্যারেড হস্তান্তর করেন। এরপর ডিজি ও ডিডিজি মঞ্চে নির্দিষ্ট আসনে বসেন।
বিডিআরের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমানের (যিনি ২৫ ফেব্রুয়ারির আট-নয় দিন পর হূদরোগে মারা যান) কোরআন তিলাওয়াতের পর দরবারে সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে বক্তৃতা করেন মেজর জেনারেল শাকিল। তিনি আগের দিনের প্যারেডের প্রশংসা করেন। এরপর তিনি ‘অপারেশন ডালভাত’ কার্যক্রম প্রসঙ্গ তোলেন এবং ডালভাতের ডিএ (দৈনিক ভাতা) সৈনিকেরা ঠিকভাবে পেয়েছে কি না, তা জানতে চান। কিন্তু সৈনিকদের জবাব ছিল ক্ষীণ। দরবারে সাধারণত সৈনিকদের যে ধরনের তাত্ক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত ইতিবাচক প্রত্যুত্তর থাকে, এ ক্ষেত্রে তেমনটা ছিল না।
ডিজি ডালভাতের কিছু হিসাব, সৈনিকদের ডিএ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে আপনাদের শৃঙ্খলা ভালো ছিল না। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ’
দুই বিদ্রোহীর প্রবেশ
আনুমানিক সকাল সাড়ে নয়টা, তখনো ডিজি বক্তৃতা করছিলেন। এমন সময় এক সিপাহি (মাঈন, ১৩ ব্যাটালিয়ন) আকস্মিকভাবে মঞ্চে উঠেই ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করে ধরে।
সঙ্গে সঙ্গে দরবার হলে হট্টগোল শুরু হয়। ওই সময় ডিজি মাথা ঘুরিয়ে তাকালে ওই সৈনিক প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী ও কর্নেল আনিস ওই সৈনিককে ধরে ফেলেন। প্রায় একই সময় আরেক সিপাহি (কাজল, ৪৪ ব্যাটালিয়ন) একই দিক থেকে এসে মঞ্চে উঠলেও, তিনি কোথাও না থেমে মঞ্চের দক্ষিণ পাশের জানালার কাচ ভেঙে বাইরে চলে যান। তখন একটি গুলির শব্দ শোনা যায়।
দরবার হলে প্রায় তিন হাজার সৈনিক এবং জেসিও ছিল, মুহূর্তের মধ্যে সবাই যে যেভাবে পেরেছে, জানালা বা দরজা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। অনেক কর্মকর্তাও ওই সময় বেরিয়ে যান। ডিজি, ডিডিজি, সব সেক্টর কমান্ডার, সব পরিচালক, তিনজন মহিলা ডাক্তার, সাত-আটজন লে. কর্নেল, ১৫-১৬ জন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন, কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর, আরপি জেসিও, এনএসএ, ডিএডি ফসিউদ্দীন, বিডিআর মসজিদের দুই ইমাম, তিন-চারজন সিপাহিসহ ৪৫-৫০ জন দরবার হলে থেকে যান। ১৫-২০ মিনিট পর দরবার হলের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে গুলির আওয়াজ, একই সঙ্গে ‘ধর, ধর’ শব্দ শোনা যায়। ওই সময় দরবার হলের ভেতর সামনের লোকজন দৌড়াদৌড়ি করে বের হয়ে যায়।
এদিকে সিপাহি মাঈনকে কয়েকজন কর্মকর্তা তাঁদের জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলেন, তিনি মঞ্চের ওপর অজ্ঞানের মতো পড়ে থাকেন। ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল কর্মকর্তাদের বলেন, সবাইকে যেন আবার দরবার হলের ভেতর ডেকে আনা হয়, দরবার আবার শুরু হবে।
বিদ্রোহীরা দরবার হল ঘিরে ফেলে
নয়টা ৪০ মিনিটের দিকে দরবার হলের বাইরে থেকে কয়েকটি গুলির শব্দ হয়। তখন ডিজি শাকিল বলেন, ‘কে ফায়ার ওপেন করেছে? তাদের ফায়ার করতে নিষেধ করো। সিচিউয়েশন ট্যাকল হয়েছে।
’
এর মধ্যে দেখা গেল লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিডিআর সৈনিকেরা দরবার হল ঘিরে কিছুক্ষণ পর পর গুলি করছে। তখন দরবার হলের জানালা খুলে কর্নেল গুলজার, কর্নেল এমদাদ, লে. কর্নেল এনশাদ এবং লে. কর্নেল কামরুজ্জামান চিত্কার করে বলেন, ‘তোমরা ফায়ার কোরো না, তোমরা ফেরত যাও। ’ এসময় দেখা যায়, অনেক সৈনিক দৌড়ে এসে এই সব সৈনিককে গুলি সরবরাহ করছে। একটি পিকআপ এ সময় (সম্ভবত সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের) রাস্তা দিয়ে দরবার হলে পাশের মাঠে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে কাচ ভেঙে গুলি দরবার হলের ভেতর ঢুকছিল।
কর্মকর্তারা আত্মরক্ষার্থে কেউ দেয়াল ঘেঁষে, কেউ পিলারের আড়ালে আশ্রয় নেন। দরবার হলের দিকে গুলি হচ্ছে দেখে মেজর মো. মাকসুদুল হক ক্রলিং করে দরবার হলের পূর্ব দিকে পোর্চের (গাড়ি থামার বারান্দা) নিচে পৌঁছে যান। সেখানে ৮-১০ জন সৈনিক ও ধর্মীয় শিক্ষক গুলি থেকে বাঁচতে শুয়ে ছিলেন। সেখান থেকে আনুমানিক ৫০ গজ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে, অর্থাত্ ৫ নম্বর ফটকের দিক থেকে মাথায় লাল কাপড় বাঁধা একজন সিপাহি পোর্চের দিকে গুলি করতে থাকে। ধর্মীয় শিক্ষকের সঙ্গে শুয়ে থাকা সৈনিকদের একজন তখন ‘আমরা সিপাহি’ বলে চিত্কার করে।
জবাবে গুলি বর্ষণকারী চিত্কার করে বলে, ‘সিপাহিরা, সব মাথার ওপর হাত তুলে দৌড়ে এলাকা ত্যাগ করো। ’ তখন এসব সিপাহিদের সঙ্গে মেজর মাকসুদও মাথার ওপর হাত তুলে দৌড় দেন এবং সামনের আবাসিক কোয়ার্টারের পেছনের দেয়াল টপকে বাইরে চলে যান।
এ সময় ডিজি শাকিল কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর (এসএম) নুরুল ইসলামকে বলেন, ‘আপনি তো কোনো দিন সৈনিকদের এ রকম ক্ষোভ আছে একবারও বলেননি!’ তখন কেউ একজন ডিজিকে বললেন, ‘স্যার, গাড়ি লাগানো আছে, আপনি চলে যান। ’ ডিজি বলেন, ‘আমি কোথায় যাব এবং কেন যাব?’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা সেক্টর কমান্ডার এবং ঢাকার অধিনায়কদের উদ্দেশে বললেন, ‘ইউ অল রাশ টু দ্য ইউনিট অ্যান্ড গেট ব্যাক ইউর পিপল এবং সবার সঙ্গে কথা বলো অ্যান্ড ট্রাই টু মটিভেট দেম। ’ এরপর ঢাকা সেক্টর কমান্ডার ও অধিনায়কেরা দরবার হল থেকে নিজ নিজ ইউনিটের উদ্দেশে রওনা হন।
ডিজি মাইকে ঢাকা সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক এবং সুবেদার মেজরদের নিজ নিজ ব্যাটালিয়নে কোতের (অস্ত্রাগার) নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের শান্ত করার নির্দেশ দেন। এ সময় ঢাকার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিব, ৩৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এনায়েত ও ১৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল বদরুল নিজ নিজ ইউনিটের দিকে রওনা দেন। এর মধ্যে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা চারদিক থেকে দরবার হলের দিকে গুলি করতে থাকে। তখন দরবার হল থেকে কিছু কর্মকর্তা ও বিডিআর সদস্য বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করে বের হতে থাকেন।
এরপর দরবার হলে ডিজি, ডিডিজি, সব সেক্টর কমান্ডার, পরিচালক, সদর দপ্তর ও বিডিআর হাসপাতালের কর্মকর্তা এবং ডালভাত কর্মসূচি ও প্যারেড উপলক্ষে সংযুক্ত কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ ছিল না।
সাহায্য চেয়ে একের পর এক ফোন
তখন ডিজি, কর্নেল গুলজার, কর্নেল এমদাদসহ দরবার হলের ভেতর থাকা প্রায় সব কর্মকর্তা মোবাইলে ফোনে কথা বলছিলেন। নয়টা ৪৫ মিনিটের দিকে কর্নেল গুলজার র্যাবের ডিজিকে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘স্যার, আধঘণ্টার মধ্যে ফোর্স পাঠান, নইলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে, আমরা নিরস্ত্র। ’ মেজর জায়েদী মোবাইল ফোনে মেজর জেনারেল তারেককে (যিনি আগে মেজর জায়েদীর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন) ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন এবং সাহায্য চান। এরপর জায়েদী ফোনটি মেজর জেনারেল শাকিলের হাতে দেন মেজর জেনারেল তারেকের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
হলের ভেতর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে
গোলাগুলি বাড়তে থাকলে কর্মকর্তারা পর্দার পেছনে মঞ্চের দুই পাশে আশ্রয় নেন।
একপাশে দক্ষিণ দিকে তিন মহিলা কর্মকর্তা এবং লে. কর্নেল লুত্ফর রহমান খান, লে. কর্নেল রবি, লে. কর্নেল বদরুল হুদা, মেজর জাহিদসহ আরও কয়েকজন; অন্যপাশে ডিজি, ডিডিজি, লে. কর্নেল কামরুজ্জামান ও আরও কয়েকজন ছিলেন। মেজর জায়েদী কিছুক্ষণ উত্তর পাশে, পরে দক্ষিণ পাশে অবস্থান করেন। মঞ্চের পর্দার ভেতরে যাওয়ার সময় কর্নেল আনিস ও লে. কর্নেল কামরুজ্জামান বেঁধে রাখা সৈনিক মাঈনকে টেনে পর্দার ভেতরে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া অনেকে হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের টয়লেটের দিকে বিভিন্ন আড়ালে আশ্রয় নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল রেজা, কর্নেল আফতাব, কর্নেল আরেফিন, কর্নেল এমদাদ, লে. কর্নেল সাজ্জাদ, মেজর ইকবাল, মেজর মনির, মেজর মাকসুমসহ আরও অনেকে।
মেজর সালেহ, মেজর জায়েদী, কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর, নায়েব সুবেদার অ্যাডজুট্যান্ট ও কর্নেল আনিস (ডিওটি) পর পর মাইকে কথা বলে উত্তেজিত সৈনিকদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, ‘তোমাদের সব দাবি মানা হবে, তোমরা ফায়ার বন্ধ করো। ’
প্রধানমন্ত্রীকে ফোন
তদন্ত আদালতের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সকাল নয়টা ৪৮ মিনিটের দিকে ডিজি শাকিল আহমেদ ফোনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সবাই যার যার মোবাইল ফোনে বাইরে যোগাযোগ করছিলেন। তখন জেনারেল শাকিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে সবাই চুপ করে থাকেন।
শাকিল বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক আপনার সরকারকে হেয় করার জন্য বিদ্রোহ করেছে। আমি ওদের সাথে নাই। আমরা আপনার সাথে আছি। আপনি আমাদেরকে সাহায্য পাঠান। আপনি আমাদেরকে বাঁচান।
’ এর পরই ডিজি অন্য কাউকে (সম্ভবত তাঁর স্ত্রী) ফোনে বলেন, ‘ভয় পেয়ো না। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখো। ’
সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের প্রতীক্ষায়
তদন্ত আদালততে কামরুজ্জামান জানান, এর আগে ডিজি কথা বলেছেন সেনাপ্রধান ও র্যাবের ডিজির সঙ্গে। সবাই জানিয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাবাহিনী ও র্যাব চলে আসবে। লে. কর্নেল ইয়াসমীনও লক্ষ করেন, তখন ডিজি বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল ফোনে সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করছিলেন।
ওই সময় লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামানের মোবাইল সেটে ফোন করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়া (পরিচালক, মিলিটারি অপারেশন) জানতে চান, ভেতরে কী অবস্থা। উত্তরে অবস্থা খারাপ শুনে তিনি বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড থেকে দুইটা ব্যাটালিয়ন মুভ করেছে। ’ তখন পাশ থেকে ডিওটি কর্নেল আনিস ফোন নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন।
কর্মকর্তাদের মেসে হানা ও অস্ত্রাগার লুট
তখন দরবার হলে আটকে পড়া আরপি (রেজিমেন্টাল পুলিশ) জেসিও আস্তে আস্তে ওয়াকিটকি শুনছিলেন। লে. কর্নেল কামরুজ্জামান ওয়াকিটকির সাউন্ড বাড়িয়ে দিতে বললে তাতে শোনা যায়, অপর পাশ থেকে বলা হচ্ছে, ‘অফিসার মেসে অফিসারদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
বিডিআরের সব গেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা এবং কোত ভেঙে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যাচ্ছে। ’ এর মধ্যে দেখা যায় এডিসি ক্যাপ্টেন মাজহার কেঁদে কেঁদে কারও সঙ্গে মোবাইলে ফোনে কথা বলছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করাতে জবাব দিলেন, ‘রাইফেল ভবনে বিদ্রোহী বিডিআররা ঢুকেছে। হাউস গার্ড অনেক আগে চলে গেছে। ম্যাডাম বলছেন, দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।
’ ডিজি শাকিল এ কথা শুনে মাজহারকে বললেন, ‘ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলো। ’
সকাল ১০টার দিকে দক্ষিণ দিকের টয়লেটে লুকিয়ে থাকা মেজর মাকসুম স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারেন যে বিদ্রোহীরা তাঁর স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মেজর মাকসুমের পাশে বসা মেজর মনিরও তা জানতে পারেন।
বিদ্রোহীরা দরবার হলের ভেতরে
গুলির শব্দ তখন আরও কাছে মনে হচ্ছিল। তখন মঞ্চের সব আলো নিভিয়ে ফেলতে বলেন ডিজি শাকিল।
কর্নেল আনিস একটি লম্বা কাঠ দিয়ে সব বাল্ব ভেঙে ফেলেন। ডিজি মাইকে সবাইকে শান্ত হতে বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘তোমরা গুলি থামাও। তোমাদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে। ’ এ সময় একজন সৈনিক দৌড়ে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ওর হাতে বা কাঁধে গুলি লেগেছিল। ভেতরে থাকা একজন ধর্মীয় শিক্ষক তাঁর পাগড়ির কাপড় দিয়ে ওই সৈনিকের ক্ষতস্থান বেঁধে দেন। এ সময় কিছুসংখ্যক বিডিআর সদস্য (সিপাহি সেলিম, কাজল, হাবিব, আতাউর, ওবায়েদসহ আরও কয়েকজন) গুলি করতে করতে দরবার হলে প্রবেশ করেন এবং পর্দার পেছনে লুকিয়ে থাকা কর্মকর্তাদের বের হয়ে আসতে বলেন।
কর্মকর্তারা তখন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজরকে (এসএম) বলেন, ‘আপনি ওদের থামতে বলেন। ’ সুবেদার মেজর পর্দার বাইরে গিয়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলতে যান।
সঙ্গে মেজর জায়েদীও যান। দুজনকেই সৈনিকেরা ধরে ফেলে। তখন কয়েকটি গুলি করা হয়। তাঁরা মাটিতে শুয়ে যান। দুজন সৈনিক মেজর জায়েদীকে তুলে বলে, ‘আমাদের সাথে চল।
’ দরবার হলের বাইরে নিয়ে তারা জায়েদীকে রড দিয়ে মারধর করে। তখনো কেন্দ্রীয় এসএম তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তাঁর হাত থেকে রক্ত ঝরছিল। এরপর দুই সৈনিক মেজর জায়েদীকে ২৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিকের বাসায় নিয়ে যায়।
‘র্যাব বা সেনাবাহিনী কেউ এখনো আসলো না’
সকাল ১০টা ২০মিনিট। সিপাহি সেলিম মাইকে কর্মকর্তাদের বেরিয়ে আসতে বলেন।
সেলিম বলেন, ‘কাম ওয়ান বাই ওয়ান’ এ সময় কর্মকর্তাদের রাজি করাতে কিছু সময় লাগে।
ডিজিসহ কয়েকজন কর্মকর্তা মঞ্চের পর্দার ভেতর উত্তর দিকে ছিলেন। ডিজিকে কোনায় একটি চেয়ারে বসানো হলো। অন্যরা সবাই ডিজির গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ডিজি শাকিল বললেন, ‘তোমরা মৃত্যুকে কেন ভয় পাচ্ছ।
মরতে তো একদিন হবেই। ’ কর্মকর্তারা বললেন, ‘স্যার, আপনার সেফটির দরকার আছে। ’ ডিজি তখন বললেন, ‘র্যাব বা সেনাবাহিনী কেউ এখনো আসলো না!’
ওই সময় কর্নেল মসিউর ডান দিকের উইং থেকে দৌড়ে বাঁ দিকের উইংয়ে চলে এলেন। বাঁ উইংয়ের সিঁড়িতে ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার বারী ছিলেন। কর্নেল মসিউর দুটি সাউন্ড বক্স ওখানকার পেছনের দরজার সামনে একটার ওপর একটা রাখেন।
তখন ব্রিগেডিয়ার বারী বলেন, সাউন্ড বক্স গুলি ঠেকাতে পারবে না।
হাঁত উঁচু করে কর্মকর্তাদের বের করে আনা হয়
সকাল সাড়ে ১০টা। বিদ্রোহী সৈনিকেরা চিত্কার করে কর্মকর্তাদের মঞ্চের ভেতর থেকে বের হতে বলে। তখন মঞ্চের নিচে ১৫-১৬ জন বিদ্রোহী কাপড়ে মুখ ঢেকে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। ১০টা ৩১ মিনিটের পরপরই মঞ্চের পর্দার আড়ালে দক্ষিণ পাশে থাকা তিনজন নারী কর্মকর্তাসহ ২০-২৫ জন কর্মকর্তা হাত উঁচু করে পর্দার বাইরে বের হয়ে আসেন (১০টা ৩১ মিনিটে মেজর রুখসানা স্বামীকে মোবাইল ফোনে বিদ্রোহীদের দরবার হলে ঢুকে পড়ার কথা জানান।
তিনি সময়টা পরে স্বামীর মোবাইল সেট থেকে নিশ্চিত করেন)।
উত্তর পাশে থাকা ডিজিসহ অন্য কর্মকর্তারা তখনো বের হননি। বিদ্রোহীরা প্রথমেই কর্মকর্তাদের সবার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। সবাইকে তারা মাটিতে শুয়ে পড়তে এবং র্যাংক খুলে ফেলতে বলে। কর্মকর্তারা দরবার হলের মেঝেতে শুয়ে পড়েন।
তখন তাঁদের ওপর দরবার হলের ভেতরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মুখে কাপড়বাঁধা একজন বিডিআর সৈনিক তিন-চার রাউন্ড গুলি চালায়। লে. কর্নেল কায়সার ও অপর দুজন কর্মকর্তা এতে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি খেয়ে লে. কর্নেল কায়সার উপুড় অবস্থা থেকে চিত হয়ে যান।
নারী ও অন্য কর্মকর্তারা লাইনে
লে. কর্নেল কায়সার গুলি খাওয়ার পর দরবার হলের ভেতর মহিলা-কর্মকর্তাদের দিকে এক জওয়ান দৌড়ে এসে বলে, ‘ম্যাডামদের মারিসনে, ওনারা ডাক্তার। ’ তখন অন্য একজন সৈনিক তাঁদের নিয়ে দরবার হলের পশ্চিম দিকের ফটকের দিকে যায়।
তাঁদের পেছন পেছন অন্য কর্মকর্তারাও আসতে থাকেন।
দ্বিতীয় দফায় লাইন ধরে বের করা হয় ডিজিসহ বাকি কর্মকর্তাদের
দরবার হলের মঞ্চের পর্দার আড়ালে উত্তর দিকের উইংয়ে ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল মশিউর, কর্নেল এমদাদ, কর্নেল জাহিদ, লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান, লে. কর্নেল এনশাদ, লে. কর্নেল আজম, মেজর খালিদ, মেজর সালেহ, এডিসি ক্যাপ্টেন তানভীর, ডিএডি ফসিউদ্দিন, সঙ্গে এনএসও এবং আরপি জেসিও ছিলেন। লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান তদন্ত আদালতকে বলেন, দক্ষিণ দিকের উইংয়ে আশ্রয় নেওয়া কর্মকর্তারা হাত ওপরে তুলে পর্দার বাইরে যাচ্ছেন দেখে ডিওটি কর্নেল আনিস ডিজিকে বললেন, ‘স্যার, ওই দিকে অবস্থান নেওয়া সব অফিসার সারেন্ডার করেছে। আমাদের জন্য কী অর্ডার?’ ডিজি কী বললেন তা কামরুজ্জামান ভালোভাবে শুনতে পাননি। বিদ্রোহীরা মেগাফোনে বলছিল, ‘ভেতরে কেউ থাকলে বাইরে বের হয়ে আসেন।
’ একই সঙ্গে তারা মঞ্চের দিকে গুলি ছোড়ে।
হঠাত্ মুখে কাপড়বাঁধা একজন সৈনিক অস্ত্র-হাতে পর্দা সরিয়ে মঞ্চে ঢুকে চিত্কার করে বলে, ‘ভেতরে কেউ আছে? সবাই বের হন। ’ একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের দিকে তাকিয়ে দুটি গুলি করে সে। গুলি কারও গায়ে লাগেনি। এরপর ডিজিসহ একে একে অন্য কর্মকর্তারা পর্দা সরিয়ে বাইরে আসেন।
সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় বিদ্রোহীরা। মঞ্চের নিচে নেমেই কর্মকর্তারা সবাই ডিজি শাকিলকে মধ্যে রেখে গোল হয়ে দাঁড়ান। একজন সৈনিক চিত্কার করে বলে, ‘শুয়োরের বাচ্চারা, সারা জীবন আমাদের সিঙ্গেল লাইন করে হাঁটিয়েছে, নিজেরা গোল করে দাঁড়িয়েছিস!’ আবার হুঙ্কার দিয়ে সে বলে, ‘সবাই সিঙ্গেল লাইন করে দাঁড়া। ’ লাইনে ডিজি সবার সামনে দাঁড়ালেন। তারপর কিছুটা জ্যেষ্ঠতা মানার মতো সবাই লাইনে দাঁড়ালেন।
বাইরে পা দিতেই ডিজির ওপর অতর্কিত গুলি
তখন দরবার হলের ভেতরে অনেক সৈনিক। সবার হাতেই অস্ত্র এবং কাপড়ে মুখ বাঁধা। সৈনিকদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘হাত ওপর এবং সামনে অ্যাডভান্স। ’ কর্মকর্তারা এক লাইনে হাঁটছেন। অস্ত্রধারীরা পেছন থেকে নির্দেশ দিচ্ছে, সামনে বাঁ পাশে কেউ হাঁটছে না।
ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল কেবল দরবার হলের বাইরে পা বাড়িয়েছেন। এমন সময় হলের চারজন সৈনিক ডিজির সম্মুখে লাফিয়ে দাঁড়ায়। সবার মুখে কাপড়, মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট, খুব সম্ভবত এগুলো গলফ ক্লাবে ব্যবহূত হেলমেট। ওই চারজনই প্রথমে ডিজিকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ডিজি সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকে হেলে মাটিতে পড়ে গেলেন।
তখন সময় আনুমানিক ১০টা ৩৮ মিনিট। কর্মকর্তারা ডিজিকে ধরার জন্য সামনে এগোতে চেষ্টা করলে সৈনিকেরা চিত্কার করে বলে, ‘কেউ সামনে আসবে না। ’ তখন সামনে থেকে আরও সাত-আটজন সৈনিক এসে কর্মকর্তাদের দিকে গুলি শুরু করে।
তদন্ত আদালত উদ্ঘাটন করেন, মুখবাঁধা বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সম্ভবত ৪৪ ব্যাটালিয়নের সিপাহি সেকান্দারকে লে. কর্নেল এনশাদ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। যারা ডিজির ওপর একসঙ্গে গুলি করেছিল, তাদের মধ্যে সিপাহি মুহিত ছিল, যার গুলিতে ডিজি ছাড়াও কর্নেল আনিসসহ আরও দু-তিনজন কর্মকর্তা নিহত হন।
এ দৃশ্য সিপাহি মো. হাবিবুর রহমান প্রত্যক্ষ করেন, যা তিনি পরে জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন।
লে. কর্নেল কায়সারের রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক
মেজর রুখসানা দেখেন, তাঁর বাঁ পাশে লে. কর্নেল কায়সারের রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। তখন সময় আনুমানিক ১০টা ৩৫ মিনিট। মেজর জাহিদ এবং আরও দুজন কর্মকর্তা লে. কর্নেল কায়সারকে তুলে দরবার হলের দক্ষিণের প্রধান দরজার বাইরে নিয়ে যান। সেখানে ডিজির গাড়ি দাঁড়ানো ছিল।
গাড়ির কাচ ও পতাকার স্ট্যান্ড ভাঙা। তাঁরা ডিজির গাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই বাইরে থেকে একজন মুখবাঁধা সৈনিক এসে অস্ত্র তাক করে বাধা দেয়। ওই সৈনিককে মেজর জাহিদ অনুরোধ করেন যে আহত কায়সারকে হাসপাতালে নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ওই সৈনিক বলে, ‘কেউ কোথাও যাবে না। এখানেই মরবে।
তোরা দরবার হলের ভেতরে যা। ’ তখন আহত কায়সারকে বাইরে রেখে ওই তিন কর্মকর্তা আবার ভেতরে চলে যান। লে. কর্নেল কায়সারের তখনো মুখ নড়ছিল।
জাহিদ বললেন, ‘আমারে আর মারিস না’
লে. কর্নেল কায়সারকে বাইরে রেখে মেজর জাহিদ হলের ভেতর ঢুকে দেখেন আরও দুই কর্মকর্তা মেঝেতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি আরও দেখেন, অন্য কর্মকর্তাদের এক লাইনে সারিবদ্ধভাবে পেছনের পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বাইরে নেওয়া হচ্ছে।
জাহিদকেও ওই লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। তখন কর্নেল এলাহীও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। লাইনে মেজর জাহিদের সামনে ছিলেন মেজর সালেহ। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় মেজর সালেহর পেটে গুলি লাগে। তিনি তখন বলছিলেন, ‘আমার পেটে গুলি লেগেছে, আমাকে আর মারিস না।
’ তদন্ত আদালতের কাছে প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী-কর্মকর্তা বলেন, তিনি দেখেন মেজর সালেহর পেটের কাছে গেঞ্জি তোলা এবং গুলির ছিদ্র দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তখন সময় আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিট।
পুরুষদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়, নারীদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে
দরবার হল থেকে বের হওয়ার পরপরই আরেক দল অস্ত্রধারী স্কুলের কাছ থেকে দৌড়ে আসে এবং চিত্কার করতে থাকে—‘অফিসারদের শেষ করো। ’ ছাই রঙের সিভিল শার্ট পরা একজন বলে, ‘ওদের একজনকেও ছাড়ব না, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলব, বাঁধো সবাইকে। ’ গুলি লাগার ভয়ে লে. কর্নেল ইয়াসমিন মাটিতে শুয়ে পড়েন।
অস্ত্রধারীরা এসে তাঁদের রাইফেলের বাঁট, বেয়নেট ও বুট দিয়ে মারতে থাকে। একসময় বিদ্রোহীরা পুরুষ-কর্মকর্তাদের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে। নারী-পুরুষ সবাইকে লাইনে দাঁড় করায় এবং রাইফেল নিয়ে প্রস্তুত হয় গুলি করার জন্য। এ পর্যায়ে মেজর জাহিদ চোখের বাঁধন খুললে একজন সৈনিক তাঁকে লাথি মারে। তিনি কর্নেল ইয়াসমিনের গায়ের ওপর পড়েন, তাঁরা অন্য নারী-কর্মকর্তাসহ মাটিতে পড়ে যান।
তখন একজন পেছন থেকে বলে, ‘আর মারিস না। ’ তারপর তাঁদের উঠতে বলা হয়। নারীরা উঠে দাঁড়াতেই রাইফেলধারী ওই বিদ্রোহী তাঁদের নুর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুলে চলে যেতে বলে। তখন একটি পিকআপ তাঁদের সামনে আসতেই সেটি থামায় ওই বিদ্রোহী। ছাই রঙের পিকআপটি ছিল বিডিআরের।
পিকআপের ভেতর মুখঢাকা তিনজন অস্ত্রধারী সৈনিক বসা। তারা প্রথমে নারী-কর্মকর্তাদের নিতে রাজি হয় না। তখন তাদের বোঝানো হয়, ডাক্তারদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে চিকিত্সার কাজে। নারী-কর্মকর্তারা গাড়িতে উঠে দেখতে পান, তিন বাক্স গুলি রাখা। লে. কর্নেল লুত্ফর রহমান খান গাড়িতে উঠতে চাইলে তাঁকে উঠতে দেয়নি বিদ্রোহীরা।
গাড়ি ছেড়ে দেয়। তখন লে. কর্নেল কাজী রবি কোনোরকমে গাড়ির সঙ্গে ঝুলছেন। পিকআপটি চলতে থাকলে নারী-কর্মকর্তারা দেখেন, পুরুষ-কর্মকর্তাদের মারধর করা হচ্ছে।
‘ও মরেনি’
এরই মধ্যে শোয়া অবস্থায় মেজর জাহিদ একটি গুলির আওয়াজের পর শুনতে পান যে একজন বলছে, ‘ও মরেনি। ’ তখন রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাঁর চোয়ালে খুব জোরে আঘাত করে এবং মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।
তিনি চোখের কাপড় খুলে নারী-কর্মকর্তাদের যে পিকআপে ঠানো হয়েছে সেটিতে মেজর মিজানকে দৌড়ে উঠতে দেখেন। মেজর জাহিদের মুখ দিয়ে তখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তখন মুখে কাপড়বাঁধা এক সিপাহি দৌড়ে এসে মেজর জাহিদকে জাপটে ধরে এবং বলে, ‘এ স্যারকে চিনি, উনাকে মারিস না। ’ এরপর ওই সৈনিক মেজর জাহিদকে চোখ বেঁধে হাঁটিয়ে আনুমানিক ৫০-৬০ গজ দূরে একটা ঘরে নিয়ে যায়। পরে চোখ খুলে দিলে তিনি দেখেন, সেটি একটি গার্ডরুমের বাথরুম।
পিকআপ থেকে নামিয়ে রাখা হয় রবি ও মিজানকে
তিন নারী-কর্মকর্তা ও দুই পুরুষ-কর্মকর্তাকে নিয়ে ওই পিকআপটি প্রথমে পিলখানার ৫ নম্বর ফটকে যায়। কিন্তু সেখানকার অস্ত্রধারী সৈনিকেরা বের হতে না দিলে পিকআপটি ৩ নম্বর ফটকের দিকে রওনা হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর অস্ত্রধারী আরেকটি দল পিকআপটি থামিয়ে দেয় এবং লে. কর্নেল রবি ও মেজর মিজানকে জোর করে নামিয়ে ঘিরে ফেলে। পরে পিকআপটি ৩ নম্বর ফটকের কাছে গেলে কয়েকজন সৈনিক নারী-কর্মকর্তাদের (চিকিত্সক) টেনে-হিঁচড়ে নামায় এবং গুলি করতে উদ্যত হয়। এ সময় একজন সৈনিক তাদের নিরত করে আবার গাড়িতে তুলে দেয়।
পরে পিকআপটি নারী-কর্মকর্তাদের হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে নামিয়ে দেয়।
অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন কামরুজ্জামান
তখন সময় আনুমানিক বেলা ১১টা বা একটু বেশি। লে. কর্নেল কামরুজ্জামানের পেটের ডান দিকে চামড়া ঘেঁষে গুলি চলে গেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। ক্রলিং করে খুব কাছের ডান দিকের টয়লেটের ভেতর ঢুকে পড়লেন এবং দেয়াল ঘেঁষে বসলেন।
সেখানে বসে তিনি অনবরত গুলির শব্দ পান। দরবার হলের বাইরে ও ভেতরে বেশ কিছু সৈনিক এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল। কেউ চিত্কার করে বলছিল, ‘ডিজি শেষ। ’ ১০ মিনিট পর একটু থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। তখন কামরুজ্জামানের কানে এল—‘মাগো, আল্লাহগো, বাঁচাও’—এ ধরনের গোঙানির শব্দ।
এরপর তাঁর মনে হলো, আবার সৈনিকেরা এসে দরবার হলের ভেতর গুলি করছে।
আরও যাঁরা বাঁচলেন
দরবার হলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে টয়লেটে যাঁরা লুকিয়ে ছিলেন, তাঁরা সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দরবার হলে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও গোঙানির শব্দ পান। সেখানে ভেতরের দিকের বেসিনের নিচে আশ্রয় নেন মেজর মনির ও মেজর মাকসুম। বেলা ১১টার দিকে একটি টয়লেটের ভেতর থেকে মেজর ইকবাল হাসান ও কর্নেল আফতাবুল ইসলাম পেছনের ভেনটিলেটর দিয়ে বাইরে এসে পড়েন। এ জায়গায়টা ফোকরযুক্ত দেয়ালঘেরা একটি স্থান, যেখানে বড় বড় পাতিল (ডেকচি) থরে থরে রাখা।
একই সময়ে অপর বাথরুমের ভেনটিলেটর দিয়ে আরও চারজন কর্নেল রেজা, কর্নেল আরেফিন, লে. কর্নেল সাজ্জাদ ও আরেকজন কর্নেল লাফিয়ে ডেকচি রাখার স্থানে আশ্রয় নেন।
আনুমানিক ১১টা ১০ মিনিটে দুজন সৈনিক ধর্মীয় শিক্ষককে (আরটি) দেখে বলল, ‘হুজুর, আপনি এখানে কেন? বেরিয়ে যান, না হলে গুলি করব। ’ তখন একজন সৈনিক মেজর মাকসুমের পা দেখে ব্রাশফায়ার শুরু করে সামনের টয়লেটের দেয়ালে। এ সময় মেজর মাকসুম অর্ধশোয়া অবস্থায় মেজর মনিরের দিকে মুখ করে ছিলেন। মেজর মাকসুম বলেন, ‘আমার গায়ে গুলি লেগেছে, তোমরা আর ফায়ার কোরো না, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাও।
’ তারা এবার মেজর মাকসুমকে লক্ষ্য করে পুনরায় ব্রাশফায়ার করে। এ সময় কিছুটা আড়ালে থাকা মেজর মনির ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে নিজের কপালের নিচে কেটে ফেলেন মৃত সাজার জন্য। মেজর মাকসুমের শরীর থেকে রক্তের ধারা পাশে এলে সেই রক্ত নিয়েও মুখের ডানপাশে মাখিয়ে মরার মত শুয়ে থাকেন। এরপর বিদ্রোহীরা বলে, ‘কুত্তার বাচ্চারা মরছে। ’ তারপর তারা চলে যায়।
মেজর মনির কয়েক মিনিট পর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে উঠে সামনের বাথরুমের দরজা লাথি মেরে খুলে ফেলেন। ওই বাথরুমের মধ্যে যাঁরা লুকিয়ে ছিলেন, তাঁরা এর আগে পেছনের জানালা দিয়ে পালিয়েছেন। মেজর মনিরও একই কায়দায় পেছনে পড়ে থাকা পাতিলের পাশেই একজনকে লুকিয়ে থাকতে দেখেন। কিন্তু তিনি সেখানে লুকানো নিরাপদ মনে না করে একটু সামনে একটা নর্দমা পেলেন, যার ওপর অনেক কাঠের তক্তা থরে থরে সাজানো আছে। তিনি তত্ক্ষণাত্ ওই নর্দমার ভেতর ঢুকে পড়েন।
সেখানেই তিনি ছিলেন দুপুর পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় আরেক দফা হত্যাযজ্ঞ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।