আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন ছাত্র। দীর্ঘ সাতটি বছর ঢাবির জিয়া হলে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংঘটনগুলোর অনেক সংঘর্ষের প্রত্যক্ষদর্শী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে কত নিশ্বংস ও বর্বর হতে পারে তা নিজচোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একই বিষয়ে পড়ুয়া সহপাঠিকে(একই রাজনৈতিক দলের অন্য গ্রুপের সদস্য) মারার জন্য লাঠি,হকিস্টিক,চাপাতি নিয়ে আরেক সহপাঠীর হুংকার দিয়ে ঝাপিয়ে পরা আমি দেখেছি।
যারা ঢাবির হলে ছিলনেনা তাদের পক্ষে আসলে হলের পরিস্থিতি বোঝা অসম্ভব। আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি...
একদিন সকালে রুম থেকে নিচে নামতে গিয়ে রক্তের ফোটা দেখেছি প্রতিটি সিড়িতে। পরে শুনলাম এই রক্ত কোন এক ছাত্র সংঘটনের র্মীর,যাকে আগের দিন রাতে অনেকজন মিলে আক্রমন করেছিল, হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স আসার পরেও ঐ সংঘটনের কর্মীরা অনেকক্ষন আহত ছাত্রটিকে আটকে রাখে। পরে হলের প্রাধ্যক্ষের সহায়তায় ঐ ছাত্রকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরেকদিন রাতে(১-২টার দিকে) গভীর ঘুমের মধ্যে আমি শব্দ শুনতে পেলাম কে যেন চিৎকার করছে "ও মা, ও আল্লাহ আমারে বাঁচাও,আমারে বাঁচাও"।
প্রথমে আমি মনে করলাম ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি। পাশ ফিরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঐ একই শব্দ শোনা যায়। ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে জেগে উঠেও যখন একই শব্দ শুনতে লাগলাম তখন খুব আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লাম ।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে যে আর্তচিৎকার শুনেছি তা আসলে স্বপ্ন না, বাস্তব। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা রুমমেট দের জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? ওরা বলল এক ছাত্র সংঘটনের(সম্ভবত শিবির কর্মী) ছাত্রকে একা পেয়ে অন্য আরেকটি সংঘটনের ছাত্রদের অনেকে মিলে এটাক করছে।
তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যে গন্ডগোল,যাতে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকার কার্ফিয়্যু জারি করতে বাধ্য হয়েছিল-তখনকার একটি ঘটনা বলি। সেনাবাহিনীর সাথে গন্ডগোলের দুইদিন পর-অর্থাৎ ঘটনার তৃতীয় দিন আমাদের হলের ছাদে উঠেও অনেক ছাত্র ইট পাটকেল মারছিল কাঁটাবন মোড়ে দাড়াঁনো পুলিশ অফিসারদেরকে। বলাই বাহুল্য এসব ইট পাটকেলের লক্ষ্য পুলিশ অফিসার হলেও এগুলো গিয়ে পরেছে সাধারন পথচারিদের ওপরই।
অতি উৎসাহী কয়েকজন ছাত্রদের ছাদের দেয়ালেও লাথি মারতে দেখা যায়। কেন????দেয়াল কি দোষ করল???? আসলে ইট পাটকেল শেষ হয়ে গিয়েছিল তো তাই------------কি বলবেন এদের??????
এতক্ষন পর্যন্ত যা লিখলাম তা পড়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি মানুষ পড়ে না জন্তু জানোয়ার পড়ে?????????
নারে ভাই জন্তু জানোয়ার না, এরা সাধারন মানুষেরই সন্তান।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রতি মাসে প্রায় হাজারখানেক(সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হতে পারে) ব্যগের বক্তের যোগানদাতা।
যে আবু বকরের রক্তে আজ বিশ্ববিদ্যালয় রন্জিত, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রতিটি হলে অগুনতি আবু বকর দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে মা বাবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা গ্রামে পিতামাতার কাছে পাঠায় এমন ছাত্রও হলে আছে।
৪ জনের একটি ছোট্ব রুমে ৩০-৪০ জন(গনরুম) একসাথে রাত্রিযাপন করে- এরকম রুম প্রত্যেক হলে এখন কম করে হইলেও দুইটা তো আছেই।
যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাহায্য-সহযোগিতায় ঢাবির ছাত্র/ছাত্রীরা সবসময় অগ্রগামী ভুমিকা পালন করে। সেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন "বাঁধন" ঢাবির ছাত্র/ছাত্রীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। বর্তমানে সারা দেশজুড়ে এর কার্যক্রম আছে। বাঁধনের কর্মীদের নিঃস্বার্থ ও নিরলস প্রচেষ্টায় প্রয়োজনের সময় খুব অল্প সময়ে রক্তের ব্যাবস্থা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কারা এই মারামারি ও বিভিন্ন রকমের সহিংসতার জন্য দায়ী????
আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব সেইসব মানুষরুপী পশুদের যারা তাদের ঘৃন্য স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করছে। টাকার লোভ দেখিয়ে গরীব ও অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রদের দিয়ে নিজ দলের স্বার্থ উদ্ধার করছে। ছাত্রজীবনের এই সুন্দর সময়ে তাদের হাতে লাঠি, হকিষ্টিক, চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছে। যেই ছাত্রদের সময় কাটার কথা লাইব্রেরীতে বই হাতে, তারা আড্ডা দেয় মধুর ক্যান্টিনে- হাতে নিয়ে চায়ের কাপ ও জলন্ত সিগারেট, মুখে জ্বালাময়ী বক্তৃতা- প্রতিপক্ষের আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়ার তীব্র প্রতিজ্ঞা!!!! এরাই মদ, গাঁজা, ফেনসিডিলের নিয়মিত ক্রেতা। হলের ক্যান্টিন ও দোকানে বাকি খেয়ে মাসের পর মাস পয়সা না দেওয়া, কাঁটাবন-নীলক্ষেতের দোকানে চাঁদাবাজি করা-এসব ঘটনায় ছাত্ররাই আমাদের কাছে ভিলেন।
কিন্তু যেসব নরপশু এদের মদদ দাতা তাদের কথা কেউ বলেনা কেন???? ওরা সবসময় আড়ালে থাকে কিভাবে??? ওরা খোঁজে তরতাজা প্রান রাজপথ গরম করার জন্য। এদের ক্ষুধা দিন দিন বেড়েই চলছে। আবু বকরের মৃত্যুতে এদের কেউ কেউ মুচকি হাসছে আর বলছে "দারুন একটা ইস্যু পাওয়া গেল। এবার রাজপথ কাঁপিয়ে দেওয়া যাবে"
আজকের প্রথম আলোতে পরলাম আবু বকরের ছোট ভাই ফারুক কাঁদতে কাঁদতে বলছে "আমার ভাই তো কোন দল করত না। মারামারি করতেও যায় নাই।
তার পরও কেন তাকে মরতে হলো?"
এই প্রশ্ন আমি করতে চাই ঢাবির মাননীয় উপাচার্যকে। প্রথম আলোকে তিনি এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন " যেভাবেই হোক, আমি এটাকে হত্যাকান্ডই বলব। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি বরাবরই ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির নামে মাস্তানি চলতে দেওয়া যায় না।
"
মাননীয় উপাচার্যকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি ঢাবিতে কতদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন???? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির স্বরূপ কি আপনার অজ্ঞাত??? যদি বলেন এই মাস্তানির রাজনীতির সাথে ছাত্র রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই তাহলে আমি বলব আপনি কল্পনার রাজ্যে বসবাস করছেন। আপনি বলেছেন, আপনি বরাবরই ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। সেটা নিশ্চই মাস্তানির রাজনীতি নয়। তাহলে সেটা কি ধরনের ছাত্ররাজনীতি, তা আমরা দেখতে চাই। যদি সেই ছাত্ররাজনীতির উদাহরন আপনি সবার সামনে উপস্থাপন করতে না পারেন(পারবেন না এটা নিশ্চিত) তবে কেন এর পক্ষে আপনার অবস্থান?????????????? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার অভিভাবক হয়ে আপনি কিভাবে এমন মন্তব্য করলেন????? আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের কাছে পিতার সমতুল্য।
আপনার কি মনে হয়না আবু বকরের রক্তে আপনার হাতও রন্জিত হয়েছে???
পূনশ্চ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে বলতে চাই, দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। আপনার এই দিন বদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মুল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষিত ও সচেতন ছাত্রসমাজ। আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলাতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। কেন??? কারন যারা সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা, তারাতো রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারন ছাত্রদের কথা চিন্তা করার সময় কৈ??? বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন।
দয়া করে সাধারন মানুষের কথা ভুলে যাবেন না। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি আজ গনদাবিতে পরিনত হয়েছে। ছাত্রলীগ বলেন আর ছাত্রদল বলেন, সবারই একই রুপ। ছাত্ররাজনীতি আমাদের শিক্ষাজীবনকে কলুষিত করছে। হিংসা আর সহিংসতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মাঝে।
এখনই সময় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার। আপনার ছাত্রলীগ দিন বদলাতে পারবেনা কখনই। দিন বদলানোর নেতৃত্ব দিতে পারে আবু বকরের মতো সাধারন ছাত্ররাই। এই আবু বকরেরাই আমাদের দেশের প্রতিটি পরিবারের স্বপ্ন। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে তাদের পরিবার, আত্নীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তথা এই সমাজ।
একবার ভেবে দেখুন একজন আবু বকরের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর কতকিছু নির্ভর করছে। আপনর ছাত্রলীগ তথা ছাত্ররাজনীতি শুধু একজন আবু বকরের জীবন কেড়ে নেয়নি। কেড়ে নিয়েছে তার পরিবারের স্বপ্ন, তার আত্নীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের আশা আকাংখাকে করেছে পদদলিত। তাই বলছি, কিছু একটা করুন। শুধু হলের কমিটি ভেঙে দেওয়া, সাধারন সম্পাদককে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া, তদন্ত কমিটি গঠন করা-এসব কেউ আর দেখতে চায় না।
আমদের একটাই চাওয়া- ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হোক।
ধন্যবাদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।