পিএসআইডি’র মাধ্যমে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আশার আলো দেখতে শুরু করেছে
আজমাল হোসেন মামুন:
বাংলাদেশের সর্ব পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ এখন প্রতিবন্ধিতা বিষয় সম্পর্কে অবগত। সেই বেশি দিনের কথা নয়। মাত্র দুই বছর পূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ জানতো না প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে। তাদের মধ্যে নানা নেতিবাচক ধারনা ছিল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্বন্ধে। তাই এলাকার সাধারণ মানুষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কানা, খোঁড়া, ল্যাংড়া, কালা-বোবা, গোঙ্গা, খ্যাপা-পাগলসহ আঞ্চলিক ভাষায় উপহাস করে ডাকতো।
অধিকাংশ প্রতিবন্ধী শিশুরা স্কুলে যেতো না, বয়স্করা আয়-বর্ধকমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলো না। অধিকাংশই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঘরের কোনে বসে সময় অতিবাহিত করতো। নিজেদের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারে নি তারা কাজ করতে সক্ষম।
সরজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার পৌরসভা, মহারাজপুর, গোবরাতলা ও বালিয়াডাঙ্গা ইউপির বিভিন্ন গ্রামে নানা ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন পেশার সাথে জড়িত। সাথে সাথে গড়ে তুলেছে ছোট ছোট তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন।
ওসব সংগঠনের সদস্য কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। ওরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে।
২০০৭ সালে জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) নামে সকল ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কর্মরত জাতীয় পর্যায়ের বেসরকারি সংস্থা ‘উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)’ এপ্রোচ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পৌরসভা, বালিয়াডাঙ্গা ও মহারাজপুর ইউপিতে প্রথম জরিপ চালান।
তাদের জরিপ মতে- এই তিন স্থানে ২০ হাজার ৩৩৩৮ টি বাড়িতে/পরিবারে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২ হাজার ৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১১৫৯ জন এবং নারী ৮৪৭ জন।
পৌর এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৪৩ জন প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৭৮৮ জন পুরুষ এবং ৫৫৫ জন নারী, বালিয়াডাঙ্গা ইউপিতে ২৯২ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ১৬৮ জন পুরুষ ও ১২৪ জন নারী এবং মহারাজপুর ইউপিতে ৩৭১ জনের মধ্যে ২০৩ জন পুরুষ ও ১৬৮ জন নারী প্রতিবন্ধী । এর মধ্যে ৪৭৫ জন প্রতিবন্ধী শিশুও রয়েছে।
এই তিন স্থানে ২ হাজার ৬ জন প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ৮৯৩ জন শারীরিক, ২৯৭ জন দৃষ্টি, ২৫৫ জন বাক, ১০৮ জন শ্রবণ, বুদ্ধি ২৫১ জন এবং বহুমূখী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২০২ জন। এই জেলায় প্রতিবন্ধিত্বের কারণ হিসেবে দারিদ্রতা, পুষ্টিহীনতা, অসচেতনতা, বাল্য বিবাহ ও সঠিক চিকিৎসার অভাবসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ফলে উক্ত সংগঠন ‘উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)’ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে।
উক্ত প্রকল্পের আওতায় ১২ টি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে আত্ম-বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। ফলে ৩০ টি ওয়ার্ডে গঠিত হয়েছে ছোট ছোট ৩০ টি তৃণমূল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন। উক্ত সংগঠন সমূহকে মনিটরিং করে ‘চাঁপাই নবাবগঞ্জ পিএসআইডি সেন্টার’। মোট সদস্য সংখ্যা ৮৩০ জন। এর মধ্যে ৩০২ জন নারী, ২৭৬ জন পুরুষ ও ২৫২ জন প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে।
৮৩০ জন সকল ধরনের প্রতিবন্ধীর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী ৪৯৬ জন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ১১৮ জন, শ্রবণ প্রতিবন্ধী ৩০ জন, বাক প্রতিবন্ধী ৭৯ জন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ৭১ জন এবং বহুমুখী প্রতিবন্ধী ২৬ জন।
চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের পাঠানপাড়ার মোঃ মইনুদ্দিন (৪০) প্রায় ১০ বছর পূর্বে ভিলেজ পলিটিক্সকে কেন্দ্র করে হুজরাপুর ও পাঠানপাড়া এলাকার লোকজনের সংঘর্ষে বোমার আঘাতে বাম হাত ও এক চোখ হারিয়ে প্রতিবন্ধিতার শিকার হন। প্রতিবন্ধিতার পর থেকে বাড়িতে বসে সময় কাটাতো। কিন্তু বর্তমানে সে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জর্জ কোট চত্বরে পান-বিড়ি ও হরেকমালের দোকান দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পিএসআইডি সেন্টারের সহযোগিতা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের কারণে স্ব-উদ্যোগী হয়ে সে আয়-বর্ধকমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে বলে জানান।
গোবরাতলা ইউপির বেহুলা গ্রামের কৃষক আঃ লতিফের ছেলে মোঃ আকবর আলী (২০) ও মেয়ে মোসাঃ পারভীন (২৫) দুইজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধিতা ও স্কুলের দুরত্ব প্রায় ৪ কি.মি দুরের রাস্তার কারণে আকবর লেখা-পড়া বাদ দিয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০০৮ সালে তার আবারও ভর্তি হয়েছে মহিপুর এসএম দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) তাকে একটি হুইলচেয়ার ও ১ টি স্যানেটরি এক্সেসেবুল ল্যাট্রিন প্রদান করেছে। ফলে সে হুইলচেয়ারে চড়ে স্কুলে যায় এখন।
অবসর সময়ে আকবর ও পারভীন দর্জীর কাজ করে। কাপড়ের ব্যবসার জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা ঋণও প্রদান করা হয়েছে।
এই ধরনের শত শত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ঘরে বসে না থেকে আয়-বর্ধকমূলক দর্জী, এ্যামবুডরী, নক্সী কাঁথা, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু-পাখি পালন, মুদি দোকান, ষ্টোর, মনোহারির দোকান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে নিজেরা স্বাবলম্বী। আবার অনেক প্রতিবন্ধী স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আত্মপ্রত্যয়ে বলিয়ান হয়ে ওঠেছে। স্কুল গামী প্রতিবন্ধী শিশুরা স্কুলে অধ্যায়ন করছে।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি’র (বিপিকেএস) পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুদ মুক্ত ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভিক্ষার পরিবর্তে ও ঘরে বসে না থেকে আয়-বর্ধকমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত।
‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ পিএসআইডি সেন্টারের’ সমন্বয়কারী, নুৎফুন নাহার জানান, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস) চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগ (পিএসআইডি)’ এপ্রোচ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও সমসুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে। এতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্ব-উদ্যোগী হয়ে স্বাবলম্বী তথা আত্মনির্ভরশীল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। এই জেলাকে একটি মডেল হিসেবে গড়ে তুলার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
তবে এ ব্যাপারে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক-
আজমাল হোসেন মামুন
উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক)
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি (বিপিকেএস)
ঢাকা-১২৩০.
মোবাইল:০১১৯১০৮৯০৭৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।