ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সাহসিকতা
ফকির ইলিয়াস
======================================
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ গোয়েন্দা বিভাগ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে বেশ চমকে দিয়েছে। নিউইয়র্কের বিখ্যাত টাইম স্কোয়ার এলাকার ৪৭ স্ট্রিটের কর্ণারে একটি বিলবোর্ড রয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং মোস্টওয়ানটেডদের নাম ও ছবি দেখা যাবে। এদের কাউকে চিনতে পারলে গোয়েন্দা সংস্থাকে ফোন করার হটলাইন ফোন নম্বরও থাকবে পাশাপাশি। এটা একটি বড় ধরনের ‘ন্যাশন ওয়াইড প্রজেক্ট’ হিসেবেই দেখছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সংস্থার স্পেশাল এজেন্ট রিচার্ড কালকো বলেছেন, আমরা কিছু মন্দলোককে আরো বিখ্যাত করার পরিকল্পনা নিয়েছি! আশা করছি আমরা তাদেরকে দ্রুতই হাতকড়া পরাতে পারবো। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের বিলবোর্ড প্রদর্শনের কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। বড় বড় বিশটি শহরে এ ধরনের প্রায় এক হাজারটি বিলবোর্ড রয়েছে। টাইম স্কোয়ারে যে বিলবোর্ড নির্মিত হয়েছে, তাতে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া বালক-বালিকার ছবিও। শিগগিরিই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীচক্রের হোতা, মৌলবাদী শীর্ষ জঙ্গিদের ছবি দিয়েও এমন বিলবোর্ড বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র চাইছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরকে জনসমক্ষে তোলে ধরে গণসচেতনতা তৈরি করা।
এই যে প্রচেষ্টা এর প্রধান লক্ষ্য কী? প্রধান উদ্দেশ্যটি হচ্ছে রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের জন্য শান্তির দরজা অবারিত করা। যারা দুর্বৃত্ত, তাদেরকে আইনের হাতে সোপর্দ করা। এই কাজটি করতে না পারলে একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি নিউইয়র্কে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন খ্যাতিমান টিভি নিউজম্যান মি. ডমিনিক কার্টারের সাজা হয়েছে একটি মামলায়। খ্যাতিমান এই টিভি ব্যক্তিত্ব ‘ডমেস্টিক এ্যবিউস্’- তথা গৃহ নির্যাতন করার মতো জঘন্য অপরাধ করেছিলেন। নিউইয়র্ক ওয়ান টিভি চ্যানেলে মি. ডমিনিক কার্টার ‘ইনসাইড দ্যা সিটি হল’ নামক একটি পলিটিক্যাল প্রোগ্রামের হোস্ট ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন তার স্ত্রী।
পরে তা নিজেদের মাঝে মিটমাট করে ফেললেও আইন তার পিছু ছাড়েনি। মাননীয় বিচারক তার রায়ে বলেন, একজন বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব কিভাবে অপরাধ করেছেন, তা একটি উদাহরণ হিসেবেই থাকা উচিৎ। সে বিবেচনায় বিচারক, মি. ডমিনিক কার্টারকে এক মাসের জেল দিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা খুব সাড়া জাগিয়েছে নিউইয়র্কে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের স্টেট সিনেটর মি. হাইরাম মনসারাত তার স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্ততার হয়েছিলেন।
সেই মামলাটির এখনো পূর্ণ নিষ্পত্তি হয়নি। এই মামলায় হাইরাম মনসারাতের সাজা হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে যদিও তিনি বলছেন তার বান্ধবীর (গার্লফ্রেন্ড) সঙ্গে দফারফা হয়েছে, তারপরও আইন তার পিছু ছাড়ছে না। তার বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেট কমিটিতেও অনাস্থা উঠতে পারে। মোট কথা তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানতে হতে পারে।
তাছাড়া সামাজিক অপমানতো রয়েছেই! তার স্টেট সিনেটর এর পদটি ইতোমধ্যে কেড়ে
নেয়া হয়েছে ।
কোনো প্রভাবশালী কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা একটি রাষ্ট্রের আইন, রাষ্ট্রতন্ত্র কখনোই প্রভাবিত হতে পারে না। হওয়ার কথাও নয়। আর যে রাষ্ট্রে তেমনটি ঘটে, সেখানে গণমানুষের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।
দুই.
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আবার কাঁপিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করেছেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, গবেষক, লেখক শাহরিয়ার কবির। ‘জেহাদের প্রতিকৃতি’ শিরোনামের এই ডকুমেন্টারিতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
সেখানে রাষ্ট্রের অন্যতম জঙ্গি মুফতি হান্নানের একটি ভাষ্য দেখানো হয়েছে। যা বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে ইতিমধ্যে আংশিক দেখানো হয়েছে।
এই ভাষ্যচিত্রটি আমিও দেখেছি। তা দেখে আমার মনে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
প্রথমত, এই ভিডিও চিত্রটি কোথায় কবে, ধারণ করা হয়েছে এর কোনো সঠিক দিনক্ষণ নেই। মূল প্রামাণ্য চিত্রটি যেহেতু আমি এখনো দেখিনি, তাই টিভিতে দেখা অংশ থেকে সেটাই জানা যাচ্ছে।
আমরা জানি, মুফতি হান্নান এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপক্ষের নিয়ন্ত্রণে, কারাগারে বন্দী।
এই ভিডিও চিত্রটি কি তার বন্দীদশায় ধারণ করা হয়েছে? যদি তাই করা হয়ে থাকে, তবে একজন বিচারাধীন বন্দীর ভাষ্য এভাবে জনসমক্ষে এলো কী করে? এভাবে আসা কি উচিত?
এবার আশা যাক মুফতি হান্নানের বক্তব্য প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয় ‘হাওয়া ভবন’-এর ছত্রছায়ায়। সেখানে মূল পরিকল্পনায় কারা কারা ছিলেন তাদের নামও বলেছেন মুফতি হান্নান। তার ভাষ্যমতে বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পুত্র ‘তারেক জিয়া’ ছিলেন এর প্রধান পরিকল্পক। কী সর্বনাশের কথা !
এটা দেশবাসী, বিশ্ববাসীর জানা- সে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামাত জোট।
আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী। তাকে নিঃশেষ করার জন্যই একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয় তা খুবই স্পষ্ট। কোনো সরকারি দলের প্রধান নেপথ্য নায়ক এমন জঘন্য মানসিকতা ধারণ করেন- তা ভাবতেও তো ভীষণ কষ্ট হয় বৈকি! সেই পরিকল্পনা বৈঠকে কে কে ছিলেন তাদের নামও বলেছেন মুফতি হান্নান। জামাতের একজন শীর্ষ নেতা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একজন খুনি মেজর নূরসহ আরো বেশ কিছু নাম জানিয়েছেন তিনি।
এই ঘটনাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তা- রাষ্ট্রের জন্য, জাতিসত্তার জন্য কতো দুর্ভাগ্যজনক তা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয়।
একুশে আগস্টের নির্মমতম হত্যাকাণ্ডে জাতি হারিয়েছে একজন বলিষ্ঠ নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ বেশ কিছু দেশপ্রেমিক নাগরিককে। পরবর্তী সময়ে এই আক্রমণ, এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেবার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে নাটক সাজানো হয়েছে। এই বর্বরতম ঘটনায় যদি সরকারের নেপথ্য মদদ না থাকতো তবে, সরকার সুবিচারের উদ্যোগ নিতো, এ বিষয়ে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে দেশে বহুমুখী অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, জনপ্রিয় সাংসদ, শ্রমিকনেতা আহসানউল্লাহ্ মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছিল খুনি ভাড়া করার মাধ্যমে। বিশেষ করে এই দুইজন নেতা হত্যার মতো জঘন্য মানসিকতা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিল একাত্তরের শেষ প্রান্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কারণ রাষ্ট্রকে মেধাশূন্য করে পঙ্গু করা যায়। তেমনি একটি দলের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ধ্বংস করে দলকেও গুঁড়িয়ে দেয়া যায়।
যা আমরা পঁচাত্তরেও দেখেছি। খুনিরা একই কায়দা নিয়ে চেয়েছিল ২০০২-২০০৬ সময়ে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি একটি মহলের ক্ষোভ থেকেই যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ, এই দলটির নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মানবিক মূল্যবোধ, গণমানুষের চেতনা ধারণ করে আর কোনো দল গঠিত হবে না, তা কেউ কখনো বলেনি।
যারা এই প্রসঙ্গে বাকশালের কথা তুলবেন, তাদেরকে সবিনয়ে বলি- বাকশাল আঁতুড় ঘরেই নিহত হয়েছিল। তাতে কি ছিল- না ছিল তা আংশিক নয়, পূর্ণাঙ্গভাবে দয়া করে পড়ে দেখুন। কারা কারা কীভাবে
বাকশালে যোগ দেবার জন্য লাইন ধরেছিলেন, তাও জানুন শুদ্ধ করে।
বাংলাদেশে সেই একাত্তরের আদর্শে যদি আরো কোনো বড় রাজনৈতিক দলের জন্ম হতো তবে আদর্শিক দ্বন্দ্ব এতোটা প্রকট হতো না। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যারা আওয়ামী লীগকে সমূলে ধ্বংসের পাঁয়তারায় মেতেছিলেন, তারা হাত মিলিয়েছিলেন সেই পরাজিত রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী শক্তির সঙ্গে।
আর এই শক্তিই দেশে আইনের শাসনকে হত্যা করতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনাশ করতে ভূমিকা রেখেছে সবচেয়ে বেশি।
একটি রাষ্ট্রশক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ব্যবস্থা। কারণ তা দিয়েই দমন করা যায় সকল দুষ্টগ্রহকে। বাংলাদেশে সেই শক্তিকে বিনষ্ট করা হয়েছে মারাত্মকভাবে। যার কুকর্ম ভোগ করতে হচ্ছে সকলকেই আজ।
বহুগামী অরাজকতার যে শিকড় বাংলাদেশের শাখা-প্রশাখায় আজ বিস্তৃত তার নবতর রূপ দিয়েছিল ‘ভবনধারী’ সেই চক্রটি। যারা মৌলবাদী আধিপত্যবাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করতে চেয়েছিল, অষ্টম জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পরপরই। সেসব ঘটনা দেশবাসী কখনোই ভুলে যাবেন না। কথাটি খুবই স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে আইনের শাসন কায়েম করা না গেলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কোনোমতেই সম্ভব হবে না। তাই দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় স্বার্থ, জনস্বার্থ রক্ষার প্রতি সুদৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
‘অপরাধীরা যতোই ক্ষমতাবান হোক- তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে’এই আপ্তবাক্যের সঠিক প্রয়োগ করতে না পারলে রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধুই মুখ থুবড়ে পড়বে।
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ / ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রোববার প্রকাশিত
ছবি- প্রিসিলা নরিস
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।