মাদকের কারণে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়, ক্ষয়ে যাচ্ছে নৈতিকমূল্যবোধ। ভেঙ্গে পড়ছে পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস-সমাজের তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। কাঁপন জাগছে সর্বস্তরের মানুষের মনে, ঘরে ঘরে। মাদক কেড়ে নিচ্ছে জীবন, মাদকের কারণে ভাই খুন করছে ভাইকে, বোনও নিরাপদ নয় মাদকাসক্ত ভাইয়ের কাছে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে, ছেলে খুন করছে বাবাকে, মাও ভাড়াটিয়া খুনি দ্বারা খুন করছে মাদকাসক্ত সন্তানকে। মাদকাসক্তির কারণে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা, বাড়ছে নারী নির্যাতন ও বিবাহ বিচ্ছেদ, বাড়ছে আত্মহননও।
আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঐশী-কাহিনী তো বিস্ময়ে হতবাক করেছে পুরো জাতিকে।
কিশোরী ঐশীর হাতে তার পিতা পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও মাতা স্বপ্না রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশের পর দেশব্যাপী নাড়া খেয়েছে মানুষের বিবেক। সন্তান পিতা-মাতাকে হত্যা করতে পারে একথা বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকে। এমন নিষ্ঠুর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড কখনও দেখা যায়নি বলে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে সন্তান কি খুন করতে পারে পিতা-মাতাকে? ঐশী কি তার পিতা-মাতাকে খুন করেছে? নাকি একটি মাদকাসক্ত কিশোরী খুন করেছে এক দম্পতিকে, যে-দম্পতি তার মা-বাবা।
নাকি 'ইয়াবা' নামক ভয়াবহ মাদকই খুন করেছে ঐশীর পিতা-মাতাকে, ওই দম্পতিকে? নাকি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছে অন্য কোনো গভীর ষড়যন্ত্র। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে জানতে হবে ইয়াবা কী? কী শিক্ষা জাতি গ্রহণ করতে পারে এই ঘটনা থেকে?
ইতিপূর্বেও কয়েক বছর ধরে মরণ নেশার উপকরণ 'ইয়াবা' নিয়ে এক্সক্লুসিভ সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে দেশের অধিকাংশ পত্রিকায়। প্রকাশিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হেডলাইনের দিকে ফিরে তাকানো যেতে পারে : ১. ইয়াবাসহ ছয় ধনীর দুলাল গ্রেপ্তার, র্যাবের অভিযানে বিএমডব্লিউও পারশে গাড়ি আটক। ২. ইয়াবার মরণ ছোবলে অভিজাত ছেলেমেয়ে, ৪০ ডিলারের খোঁজে র্যাব গোয়েন্দা দল। ৩. ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ছয় যুবক কারাগারে, পাইকারি বিক্রেতাদের সন্ধান পেয়েছে র্যাব।
বলা হচ্ছে— গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, ধানমন্ডি, ডিওএইচএসসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকার অসংখ্য ছেলেমেয়ে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করছে, বিক্রি করছে এমন কি পাইকারি ব্যবসায়ও নেমেছে। এরা কোটিপতি, শিল্পপতি, রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী, আমলা এবং উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়ে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-তরুণ-তরুণীদের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে। এদের সংখ্যা বেশি হলেও মধ্যবিত্তদের সন্তানদেরও এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না। অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরাও এই মরণ নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
মাদক ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।
ইয়াবা খেলে কী হয়?
অল্প কথায় বলা যায় ইয়াবা খেলে মনোত্তেজনা আসে। আবেগে জোয়ার আসে। তৈরি হয় উত্ফুল্ল ভাব। 'মুড হাই' হয়ে যায়—'ইউফোরিয়া' জাগে মনে।
এ ধরনের 'সুপার এক্সাইটেশন' একটি অস্বাভাবিক অবস্থা। এ সময়ে দেহে নানা ধরনের পুলকও বেড়ে যেতে পারে সাময়িকভাবে। প্রাথমিক উদ্দীপনার প্রভাব কেটে গেলে অবসাদ জাগে দেহ-মনে, কর্মক্ষমতা কমে যায়, দেহ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, শিথিল হয়ে পড়ে যৌনচেতনা। 'সুপার এক্সাইটেশন' সময়ে বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে ইয়াবা গ্রহণ করা যেকোনো তরুণ, নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে, অসত্ যৌনাচারে ডুবে যেতে পারে, সেঁটে যেতে পারে অপরাধের সঙ্গে, যৌনবাহিত রোগ এমনকি এইডস— রোগেও আক্রান্ত হতে পারে। আর তরুণী হারাতে পরে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যথেচ্ছভাবে ব্যবহূত হয়ে যেতে পারে।
মাদকে অভ্যস্ত তরুণ বা তরুণী হঠাত্ মাদক গ্রহণ বন্ধ করে দিলে আক্রান্ত হতে পারে শিথিলতা, নিষ্ক্রিয়তা, অবসাদগ্রস্ততায়, তীব্র যাতনায় দিশেহারা হয়ে মাদক জোগাড় ও গ্রহণের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। 'মুড হাই' করার জন্য মাদক নেয়ার গোলকচক্রে এভাবে আটকে যায় ইয়াবাসেবী। ঐশীর ক্ষেত্রেও কী ঘটেছিল এমন অনিয়ন্ত্রিত নির্মম, নিষ্ঠুর, বিবেকহীন ভয়াবহতা?
ইয়াবা গ্রহণে কী ক্ষতি হয় দেহ-মনে?
হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ে। রুক্তচাপ বেড়ে যায়।
মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র রক্তনালী ছিঁড়ে স্ট্রোক হতে পারে, রক্তক্ষরণ হতে পারে ব্রেণে। হার্টের জটিল সমস্যা হতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। ক্ষতি হতে পারে শ্বাসযন্ত্রের। ইনজেকশন হিসেবে ইয়াবা নেয়ার পর রক্তের চাপ আকস্মিক বেড়ে জ্বর আসতে পারে, হূত্স্পন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে! অতিরিক্ত ইয়াবা নিলে খিঁচুনি হতে পারে, শরীর বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে, ক্ষুধা কমে যেতে পারে, মুখ শুকিয়ে যেতে পারে, অতিরিক্ত ঘাম বেরোতে পারে, চোখের দৃষ্টি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে, অন্যদের ভয় লাগতে পারে বস্ফািরিত চোখ দেখে।
ঘুম চলে যেতে পারে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে অনিন্দ্রায়। মাংসপেশী ক্ষয় হয়ে যেতে পারে, স্নায়ু কোষের ক্ষতি হতে পারে, সংকোচিত হয়ে যেতে পারে মস্তিষ্ক। দেহে তৈরি হতে পারে ক্ষতিকর ফ্রি-র্যাডিক্যাল- এটি ক্ষতি করে স্নায়ুকোষের।
কোথায় নিরাপদ তরুণ প্রজন্ম ? কীভাবে নিজেদের রক্ষা করবে তারা?
উত্তর জানতে হলে বুঝতে হবে, কেন মাদক নেয়? কেন নিতে বাধ্য হয়? বুঝতে হবে কোথায় বিন্যস্ত রয়েছে ইয়াবার ফাঁদ। মাদক চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা পেশাগত ফিল্ডে লক্ষ্য করছেন, Peer Pressoure গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে, মাদক নিতে তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করছে।
পত্রিকার সংবাদে সেই সত্যতা দেখা যাচ্ছে। বন্ধুরা মাদক নিচ্ছে। বন্ধুরা মাদক বিক্রি করছে। বন্ধু সেজে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাগে 'ইয়াবা' ট্যাবলেট ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
একটু মন খারাপ হলে—তরুণ-মন প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে।
একটু কষ্ট পেলে সহজে ঢুকে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীর থাবার ভেতর? টার্গেট করা হয় এদের। সহজে বাগে আনা যায়। ট্যাবলেট ধরিয়েই ক্ষান্ত হয় না, অপর বন্ধুর কাছে বিক্রির জন্যও রাখা হয় চাপে। এভাবে সঠিক জায়গায় ঢিল ছুঁড়তে পারছে অসত্ চক্র। ভোক্তা তৈরি করছে, ভোক্তার পাশের টেবিলে গিয়ে বসার সুযোগ পাচ্ছে।
সুবিন্যস্ত হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের জাল। মোবাইলের যুগে এখন আর স্পটে গিয়ে মাদক কিনতে হয় না। ফোন করলেই হয়। ঘরে চলে আসে, স্কুল-কলেজে চলে আসে মাদক। কী ভয়াবহ অবস্থা! জীবনের স্বাভাবিক কষ্ট, স্বাভাবিক দুঃখ, ব্যর্থতা, হতাশা ভুলতে ভুল পথে পা দেয় তরুণ প্রজন্ম।
অনেকে মাদক নেয় কৌতূহলে। দেখি না কী মজা! পরখ করতে গিয়ে বিন্যস্ত জালে আটকে যায়। যারা ভীরু কিংবা হীনমন্যতায় ভোগে, সব কাজে তাদের এক ধরনের 'আনসিন' বাধা থাকে। ড্রাগস নিলে টের পাওয়া যায় না বাধা। আগে যা করতে পারেনি, বলতে পারেনি, মাদকের প্রভাবে তা পারে।
এ ধরনের কিশোর-তরুণ-তরুণীদেরও ব্যবসায়ীরা টার্গেট করে, সহজে দলে ভিড়াতে পারে। এরা 'না' বলতে পারে না। ফাঁদে পড়ে। অনেক স্মার্ট ছেলেমেয়ে মাদক নেয়। অনেক মেধাবী ছেলে মাদক নেয়।
ওদের 'আইডেনটিফাই' করে সহজ সাধারণ ছেলেটিও ফাঁদে পড়তে পারে। নিজেকে স্মার্ট বানাতে গিয়ে জড়িয়ে যায় কঠিন চক্রে। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের দিকে মাদক ব্যবসায়ীদের চোখ বেশি সজাগ। ওদের দিকে শ্যেন দৃষ্টি দিলে বেশি লাভ। দলে ভেড়াতে পারলে বেশি বিক্রি, বেশি অর্থ পাওয়ার পথ খুলে যায়।
পারিবারিক জীবনে বাবা-মার অশান্তি ডিভোর্স সেপারেশন, অনৈতিক জীবনযাপন অথবা বাবা-মার মাদকাসক্তি টিনএজারদের মাদকের দিকে ঠেলে দেয় । এদেরও সহজে লুফে নেয় কুটিল চক্র। ব্যক্তিত্বের সমস্যার কারণেই অনেকে মাদক নেয়। সর্বোপরি ব্যর্থ প্রেমিক কিংবা ব্যর্থ প্রেমিকাকে সহজে বগলদাবা করা যায়, জানে লোভী চক্র। সজাগ থাকতে হবে।
চোখ খুলে চলতে হবে। টিনএজ বন্ধুরা, সব ধরনের পরিস্থিতিতে সঠিক পথে এগোতে হবে, সাহস সঞ্চয় করতে হবে মাদককে 'না' বলার শক্তি।
কী করা যায়?
২০০৩ সালের মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল : 'আসুন মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই আমরা। ' জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের জবানীতে বলা হয়েছিল, মরণ নেশার প্রতিরোধে ঘর থেকেই আন্দোলন জোরদার করতে হবে। পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে থিমটি।
প্রত্যেক মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবীকে ড্রাগসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ডাক দিয়ে বলা হয়েছিল, মাদকের সর্বনাশা ক্ষতির প্রভাব নিয়ে খোলামেলাভাবে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আলোচনা করতে হবে। শিশুর মনে নৈতিকশক্তি জোরদার করতে হবে, সর্বোপরি মাদককে 'না' বলার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এসব দায়িত্ব পালন করতে হবে সবাইকে।
কিভাবে মাদককে 'না' বলব?
আবার অনেকের ব্যক্তিত্বের গড়ন এমন থাকে যে, তারা কোনো কিছুতেই না বলতে পারে না।
অনৈতিক আহ্বান বুঝতে পেরেও প্রতিরোধ করতে পারে না। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারীরা মনে করে 'না-করা' মানেই অন্যকে কষ্ট দেয়া, নিজে ছোট হয়ে যাওয়া, বন্ধু হারানো, দলছুট হওয়া—'তারা আমার সাথে মিশবে না', 'আমার ক্ষতি করতে পারে' ইত্যাদি আশংকা ও নেতিবাচক ভাবনার জালে জড়িয়ে যাওয়া। ফলে অন্যদের অশুভ প্রভাবকে 'না-বলতে' পারে না।
প্রধান কাজ হচ্ছে সঠিকভাবে 'না-বলা' শেখার দক্ষতা অর্জন করা, দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ানো। মনস্তত্ত্বের ভাষায় এই দক্ষতাকে বলে Assertiveness— অন্যকে কষ্ট না দিয়ে বা অসম্মান না করে নিজের ইচ্ছা, অনুভূতিকে দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করার ক্ষমতা।
'না-বলা'র সময় অবাচনিক আচরণ বা যোগাযোগ যেমন: চোখের দিকে তাকানো, কণ্ঠস্বর, মুখভঙ্গি ইত্যাদি সঠিকভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করা। অর্থাত্ মাদককের আহ্বানকে 'না-বলা'র সময় সরাসরি আহ্বানকারীর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা এবং কণ্ঠস্বর অতিরিক্ত নিচু বা উঁচু না করা। ক্ষেত্রবিশেষে মৃদু হেসে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া।
অপরপক্ষ আঘাত পায় এভাবে কথা না বলা। যেমন: বকাঝকা, গালাগাল না করা, অপমানজনক কথা না বলা ।
মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আহবানকে 'No thanks' বলা। এটা বলা খুবই সহজ কিন্তু অনেকেই এই সহজ কথাটা সহজে বলতে ভুলে যায় বা অনভ্যাসের কারণে বলতে দ্বিধাবোধ করে। সব ধরনের অযৌক্তিক ক্ষেত্রে 'No thanks' বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মাদকাসক্তদের কাছ থেকে মাদক নেয়ার আহবানকে সহজেই 'No thanks' দ্বারা মোকাবিলা করা যায়। ভবিষ্যতে মাদক নেয়ার কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি না দেয়া।
যেমন: 'আজ নিব না দোস্ত, অন্যদিন নেব'— এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ফলে আসক্ত বন্ধুরা আবারো মাদক অফার করার সুযোগ পাবে। সরে যাওয়া: অশুভ আহবানকে 'না-বলা'র জন্য এটি খুবই কার্যকরী এক ধরনের দক্ষতা। মাদকের পরিবর্তে অন্যবিষয় নিয়ে কথা বলা বা অন্যকোনো কাজে মনোযোগ সরিয়ে নেয়া। যেমন: আমি ক্ষুধার্ত, চলো আমরা বাসায় গিয়ে নাস্তা করি। রসবোধ ব্যবহার করে মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আহবানকে 'না' বলা যায়।
নির্ভর করে ব্যক্তির কৌতুক আশ্রয়ী রসবোধের ওপর। মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক পাওয়া যায় এমন স্থান এড়িয়ে চলা। মাদক গ্রহণ করে না এ ধরনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর অভ্যাস তৈরি করা। যে-সব পরিস্থিতিতে নতুন করে বা পুনরায় মাদক নেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে যেমন: যেকোনো উত্সব উদযাপনব (ঈদ, থার্টিফার্স্ট নাইট, পহেলা বৈশাখ, জন্মদিন ইত্যাদি); একাকীত্ব; যেকোনো ধরনের ব্যর্থতা বা কোনো কিছু হারানো (পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পর্ক বিচ্ছেদ, কারো মৃত্যু ইত্যাদি), হতাশা, বিষণ্নতা, ক্রোধ, ঘুমের সমস্যা, যৌন সমস্যা, হাতে প্রচুর টাকা চলে আসা, মাদক সম্পর্কিত ভুল ধারণা; মাদকের সহজপ্রাপ্যতা এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তির সঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে সজাগ থাকা জরুরি।
'আমি নেশা করব না', 'পরখ করে দেখি কী মজা লুকিয়ে আছে', 'অল্প-স্বল্প নিই', 'ইচ্ছা হলে খাব', 'ইচ্ছা হলে ছেড়ে দেব', 'মাদক আমাকে আসক্ত করতে পারবে না'— এ ধরনের চিন্তা শাসন করে মাদকমুক্ত থাকার ব্যাপারে বাড়াতে হবে সচেতনতা, অর্জন করতে হবে জ্ঞান।
এসব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে সঠিক উপায়ে 'না-বলা'র দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পারে। কেউ মাদক নেয়ার জন্য আহ্বান করলে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করতে হবে 'কেন একটি রাসায়নিক পদার্থ ঢোকাব নিজের দেহে?' 'রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই পদার্থ বদলে দিতে পারে নিজের দেহ-মন। ' 'নিজের শরীরকে কেন কৌতূহল মিটানোর হোস্ট বানাব?' পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে আসার সময় বাধা পেলে বিতর্কে না জড়িয়ে মনে মনে ভেবে নেয়া প্রশ্নগুলো প্রয়োজনে দৃঢ়তার তুলে ধরতে হবে অহ্বানকারীর সামনে। মূলকথা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। যার আত্মসম্মানবোধ আছে এবং যে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সচেতন ও জীবন সম্বন্ধে আশাবাদী সহজে কাবু করা যায় না তাকে।
এমন ব্যক্তিত্বের ভিত নির্মাণ করতে হবে যেন অন্যরাই নিজস্ব গুণগত বৈশিষ্ট্যের আলোয় আলোকিত হয়। ভুলপথযাত্রী যেন অশুভ পথে তাকে টেনে নিতে না পারে।
ব্যক্তিত্ব
মনে রাখা দরকার, প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাদের ব্যক্তিত্বের গঠন আলাদা। উপরে আলোচিত কোনো একটা টিপস হয়ত কোনো একজন ব্যক্তির জন্য কাজ করবে, আবার সেই টিপসটা অন্যের জন্য কাজ না-ও করতে পারে। টিপসগুলোর মধ্যে থেকে এমন কিছু টিপস বাছাই করতে হবে ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মাদকসেবীর আহবানকে প্রতিরোধ করতে পারে।
প্রয়োজনে কোনো মনোচিকিত্সক, চিকিত্সা মনোবিজ্ঞানী কিংবা প্রশিক্ষিত কাউন্সিলরের সেশনে বসে অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও মাদককে 'না বলা'র দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশে মা-বাবার ভূমিকা: 'না' বলার দক্ষতা অর্জন
শিশুকাল থেকে সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হবে। মা-বাবার উচিত শিশুর ব্যক্তিত্ব এমনভাবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা যেন সে আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। এজন্য শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, শ্লেষাত্মক বাক্য ব্যবহার না করে, সমালোচনা না করে যৌক্তিক বিষয়ে 'হ্যাঁ' বলার অভ্যাস করতে হবে। শিশুর ভালো কাজে প্রশংসা করে উত্সাহ দেয়া, অনাকাঙ্খিত আচরণে যথাসম্ভব মনোযোগ না দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
এ ধরনের শিশুরা অশুভ আহ্বানকারীকে ভবিষ্যতে 'না-বলতে' পারবে। নিজেকে মাদকমুক্ত রাখতে পারবে। পরিবারই হোক সুন্দর ব্যক্তিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা ও পরিচর্যার কেন্দ্রস্থল।
মাদকাসক্ত বন্ধুকে রক্ষার জন্য কী করব:
চিকিত্সার জন্য কীভাবে উদ্বুদ্ধ করা যাবে মাদকাসক্ত বন্ধুকে? মনে রাখতে হবে, বিষয়টি সহজ নয়, কঠিন-কিন্তু সম্ভব। দেহ-মন, ক্যারিয়ার, পারিবারিক জীবন ও আর্থিক অবস্থা ধ্বংস হচ্ছে, এক সময় বোঝে আসক্তজন।
তবুও ধ্বংসের পথে সেঁটে ফেলে তারা জীবন-যাপন। প্রতিদিনের ডোজ সংগ্রহের জন্যই বেপরোয়া ইচ্ছা জেগে থাকে মনে-আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা ও উত্সাহের কেন্দ্রবিন্দু দখল করে নেয় মাদক গ্রহণের টান। সবক্ষতি মেনেই ওই টানে ঘুরপাক খেতে থাকে তাদের জীবন। মাদকের কারণে কী ক্ষতি হচ্ছে, কী হারাচ্ছে সে, এসব কথা বলে খুব একটা লাভ হয় না। তবে চিকিত্সার একটা ধাপে আলোচনা করা হয় ক্ষতি নিয়ে।
মাদকাসক্ত বন্ধুকে চিকিত্সার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এটাই মূল কথা, বড় দায়িত্ব। প্রথম শর্ত হচ্ছে, মনোযোগী শ্রোতা হওয়া। মাদকাসক্তি নিয়ে আসক্তজন কী ভাবছে, কেন মাদক নেয়া শুরু করেছে, তাকে বলার সুযোগ দিতে হবে। সক্রিয়ভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তার কথা, শোনার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে।
শোনার সময় উত্সাহ দিতে হবে তাকে।
খোলামেলাভাবে কথা বলার সুযোগ পেলে, উত্সাহ পেলে, কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে সে। মাদক ছাড়ার জন্য প্রস্তুত কিনা, প্রয়োজনে তলিয়ে দেখতে হবে বিষয়টি। শোনার সময় থাকতে হবে Empathetic approach অর্থাত্ সমানুভূতি; সহানুভূতি নয়, করুণা নয়। আসক্তজনের প্রতি থাকতে হবে সম্মানবোধ। তার কথার পিঠে কথা বলা ঠিক হবে না।
তার বক্তব্যের সমালোচনা করা যাবে না, লেকচারিং করাও চলবে না, তাকে দোষ দেয়া হবে মারাত্মক ভুল, রাগ দেখানো হবে মূর্খতা। নিজের বিশ্বাস, মনোভাব, চিন্তা কিংবা মূল্যবোধ ও আচরণ আসক্তজনের ওপর 'চাপিয়ে দেয়া' ঠিক হবে না। কথা বলার সময় মাদক গ্রহণকে যদি সমস্যা হিসাবে Admit করে সে, বুঝতে পারে মাদকাসক্তি মানে ব্রেণের রাসায়নিক নির্ভরতা ; যদি সাহায্য চায়, তখন তার জন্য ভালো কিছু করার পথ খুলে যাবে, তাকে সহায়তা করা সম্ভব হবে। সাহায্য চাইলে, পরবর্তী ধাপে পরিবারের সদস্যদের জানাতে হবে। অন্য ভালো বন্ধুদেরও এই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
সবার সম্মিলিত উত্সাহে আসক্ত বন্ধুকে চিকিত্সার জন্য রাজি করানো সম্ভব।
উদ্বুদ্ধকরণ পথটি নানা জটিলতায় ভরা
বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের সমস্যা: সন্তান মাদকাসক্ত, জানার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চোট খাবেন তারা, প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। বিশ্বাস করলেও খেপে উঠতে পারেন, রাগারাগি, বকাঝকা, মারপিট, ঘরে আটকিয়ে রাখা, সমালোচনা করা চলতেই থাকবে। এসময় তাদের পাশেও দাঁড়াতে হবে। পরিবারের সদস্যদেরও বোঝাতে হবে-আসক্তজন ফাঁদে আটকা পড়েছে, গর্তে পড়ে গেছে, চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে।
এই ফাঁদ, গর্ত কিংবা চোরাবালি থেকে তুলে আনতে হবে তাকে। তার জন্য আরও বেশি মমতা ও ভালোবাসা দরকার। হাত বাড়িয়ে দিতে হবে তার প্রতি। যত বেশি রূঢ় আচরণ করা হবে, ততো দূরে সরে যাবে সে, ততো বেশি ডুবে যাবে, সর্বনাশ ঠেকাতে অভিভাবকদের উদ্যত আবেগ সংযত করতে হবে প্রথম। এর কোনো বিকল্প নেই।
আসক্তজনের সমস্যা:
আসক্তজন জানে যে সে খারাপ কাজ করছে, সমাজের চোখে বিষয়টি খারাপ, গ্রহণযোগ্য নয়। তাই লুকোতে থাকবে আসক্তির কথা ! অস্বীকার করবে সে। বুদ্ধিমানের মতো আলোচনা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু মূল টার্গেট হবে অস্বীকারের আড়াল থেকে তাকে, বের করে আনা। সেক্ষেত্রে বিতর্ক না করে ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকতে হবে।
স্বীকারোক্তির পরও অনেক অজুহাত তুলে ধরবে সে। বলতে পারে-আর মাদক নেব না। ছেড়ে দিলাম আজ থেকে। আমার ইচ্ছাশক্তিই প্রধান। বলতে পারে, নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই-একমাস, তিনমাস, ছয় মাস থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
এত টাকা কোথায় পাবো ইত্যাদি। চাকরিজীবী হলে বলবে, আমার ছুটি নেই, চাকরি চলে যাবে। চাকরি চলে গেলে আরও খারাপ হয়ে যাব। ছাত্র হলে বলবে, আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে, সামনে পরীক্ষা ইত্যাদি যুক্তি তুলে ধরবে, ধ্বংসের পথে চলতেই থাকবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভালো উপায় হচ্ছে নরমভাবে তার বক্তব্য ও আচরণের অসামঞ্জস্যতা (Inconsistencies) সামনে তুলে ধরা।
মনে রাখতে হবে, এই তুলে ধরার বিষয়টি হতে হবে শালীনভাবে দক্ষতার সঙ্গে। অশালীনভাবে মতদ্বৈততা দেখানো চলবে না, রিঅ্যাকশন দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকে দোষ দেয়াও যাবে না। আরও মনে রাখতে হবে-আসক্তজনের অযৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা, আচরণের ব্যাখ্যা মেনে নেয়াও যুক্তিযুক্ত হবে না, উপকারী নয়। বরঞ্চ সমস্যা জিইয়ে রাখার সহায়ক।
নিজের ধৈর্যশক্তি আসক্তজনকে উদ্বুদ্ধ করবে, সে যে সমস্যার জালে জড়িয়ে আছে (Admitting the problem) বুঝতে পারবে। অন্তর্গত এই বোঝাপড়াই তাকে চিকিত্সাগ্রহণের জন্য পথ দেখাবে। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে অপেক্ষা করতে হবে বিশেষ মুহূর্তের জন্য; যেমন কোনো দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, চাকরিচ্যুত হওয়া, পরীক্ষায় ফেল করা বা পুলিশের হাতে ধরা পড়া। তখন মাদক বর্জনের ইস্যুটি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করানো সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, অতি উত্তেজিত হয়ে রোগীকে কারাগারে প্রেরণ করা ঠিক নয়।
এর ফলে নিজেদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি জটিল হতে থাকে। কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে সে আরো বেশি আগ্রাসী হয়ে যাবে। বিকল্প কাজ হচ্ছে, আসক্তদের অতি ঘনিষ্ঠ কারোর সাহায্য নেয়া। তার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া।
নিজের ও পারিবারিক উদ্যোগ বিফল হলে মাদকাসক্তি চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ কোনো কাউন্সিলর, অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট বা অভিজ্ঞ কোনো চিকিত্সকের সাহায্য নিতে হবে।
লেগে থাকতে হবে। বিফলে হতাশ হলে চলবে না। লেগে থাকলে অবশ্যই সফলভাবে আসক্তদের রাজি করানো যায়। এক ঐশী-আতঙ্কে ডুবে থাকলে চলবে না। ঘরে ঘরে যেন কোনো নতূন ঐশীর জন্ম না হয় সেই শিক্ষাই নিতে হবে এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে।
ঐশীর মতো যে-সকল মানববোমা শেষ করে দিচ্ছে পরিবার তাদের চিকিত্সার উদ্যোগ নিতে হবে। পরিস্থিতি গোপন করা চলবে না। ঘনিষ্ঠ স্বজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে সংকট উত্তরণের পথে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তি বা মাদক নির্ভরতা হচ্ছে chronic relapsing brain disease..
লেখক : মনোচিকিত্সক-মাদকাসক্তি চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক
drmohitkamal@yahoo.com
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।