রংধনুর জন্য প্রার্থনা
বুকটা ধ্বক্ করে উঠে ঘুম ভেঙে গেল বিচ্ছিরিভাবে। চোখ বুজে আরও কিছুক্ষণ ঘুমের আমেজ ভোগ করার জন্য গড়িয়ে পাশ ফিরে শুই। কিন্তু গড়াগড়িই সার। সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে একটা ধ্বকধকানি টের পাই। লাফ দিয়ে উঠে বসি।
পাশে গভীর ঘুমে এলিয়ে আছে কুমি, আমার ছোটবোন কুমকুম। ভোররাতের হালকা অন্ধকারে ওর জুবুথুবু ছোট্ট ‘দ’ মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ইচ্ছে হয় ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাই, দেখি ওর চোখের কোল কতটা ফুলে আছে, এখনও সেখানে শুকনো জলের দাগ লেগে আছে হয়তো।
কিন্তু কিছুই করা হয় না। অদ্ভূত বিপন্নতায় বাড়ানো হাত ফিরিয়ে আনি। ঘুম ভেঙে গেলে ও যখন অবাক হয়ে তাকাবে আমার দিকে, আমার লজ্জা করবে খুব।
আমরা চিৎকার করে রাগ প্রকাশ করি, ধমক দেই, শাসন করি কিন্তু ভালবাসা যা আছে সেটা আমাদের অন্তরের বিষয়। এভাবেই অভ্যস্ত আমরা। বাবা মাও আমাদের সামনে শুধু ঝগড়াই করেন, আমাদেরকে শাসন করেন সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য। মনে মনে আদরও করেন নিশ্চয়ই কিন্তু বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খান না। ভালবাসার প্রকাশকে তাদের মনে হয় ঢং, আদিখ্যেতা।
তাই আমরাও প্রতিনিয়ত যথাযথ হওয়ার সাধনা করি।
আমি আবার কুমির দিকে তাকাই। যেখানে নিম্নমধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, মননহীনতায় সুকুমার বৃত্তিগুলি বার বার পরাজিত হয়; অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় সেখানে এই ছোট্ট শরীরটির কোথায় কিভাবে এত ভালবাসা ও বাঁচিয়ে রাখে বোঝার চেষ্টা করি। বিদেশে শুনেছি প্রত্যেকেই কোন না কোন একটা প্রাণী লালন পালন করেই সাধারনত। ওখানকার দোকানগুলোতেও না কি সুন্দর সুন্দর মোড়কে বিভিন্ন স্বাদের পুষ্টিকর পশু খাবার পাওয়া যায়।
তারপরও সেসব দেশের ব্য¯ত মানুষেরা তাদের পোষাপ্রাণীর রুচি বদলের জন্য, আরও ভিন্ন স্বাদের খাবার তৈরী করতে রান্নাঘরে যায়। আবার পশু-পাখীদেরও নিয়মিত শ্যা¤পু করায়, লোশন লাগায়, নখ কেঁটে দেয়, দাঁত পরিস্কার করে, কান পরিস্কার করে। এরপর আরেকটি কাণ্ড করে তা হল, পায়খানা করানোর জন্য শীতের রাতে ঘুম হারাম করে তাদেরকে নিয়ে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে। এমনি আরও কত যতœ না কি করে যা আমাদের দেশে মানুষের বাচ্চা পালতেও করা হয় না। এ দরদ শুধু যে পোষা প্রাণীদের জন্যেই তাও না।
বন্য প্রাণীর জন্যেও তাদের সমান মায়া। বন্যপ্রানী সংরক্ষণের জন্য তারা সভা-সমিতি করে অর্থ সংগ্রহ করে এরকম বহু ঘটনাই পত্রিকায় ওঠে।
কিন্তু কুমি ! যেখানে মানুষের চেয়ে নিয়ম বড় সেই নিষ্ঠুর পরিবেশে পশুর জন্য তার গভীর মমতা অবা¯তব বৈকি। আমরা তো এসব বাড়াবাড়ি পছন্দ করি না। যেমন আমার আব্বাজানও পশুপাখী লালনপালন করেন।
তবে সেইসব পশুপাখীকে হতে হবে লাভজনক। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদি। টিয়া-ময়না বা কুকুর-বিড়াল এসব তাঁর ভালবাসার তালিকায় পড়ে না। কিন্তু কুমির ভালবাসা লাভজনক অলাভজনক এমন কি ক্ষতিকর প্রাণীদের জন্যেও অবারিত।
মনে আছে একবার ঘরের আনাচ-কানাচ সব পরিষ্কার করতে গিয়ে পুরোনো জুতার বাক্সের ভেতর থেকে বের হলো পাঁচ-ছ’টা সদ্যপ্রসূত লালচে বেগুনী ইঁদুর ছানা।
আমরা হৈ চৈ করে উঠলাম। আমাদের পরিস্কার পরিছন্নতা অভিযান সফল হয়েছে। কিন্তু সে বাক্সটা কোলে নিয়ে বসে রইল কিছুতেই ওগুলো মারতে দেবে না!
আরেকবার সিড়ি ঘরের কাঠের ¯তূপের মধ্যে কোত্থেকে এসে চারটে বাচ্চা রেখেছে এক বিড়াল। অন্যেরা টের পাওয়ার আগেই সে কাঠের টুকরোগুলি সরিয়ে সরিয়ে এমনভাবে বিড়লের ঘর সাজিয়ে দিলো যে টের পেতে অনেক সময় লেগে গেল; প্রথমে নিজের বরাদ্দের মাছ, মাংস, দুধ খাওয়াচ্ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে বাচ্চাগুলো বড় হয় আর সেও চুরির পরিমান বাড়ায়, হাত পড়ে আম্মার ভাড়ারে। ওদিকে কয়েকদিন পর বাচ্চাগুলি যখন মিউঁ মিউঁ করে খেলা আরম্ভ করলো তখনই খবর হলো সবার।
আমাদের বাড়ি তো আমাদের বাড়ি, আশেপাশের অন্য সকলেই চেঁচামেচি শুরু করলো এগুলো তাড়ানোর জন্য। কারন বিড়াল নাকি এমনই ছ্যাচ্চোর যে একটু বড় হলে আর দূর করা যাবে না। তাছাড়া অসুখ বিসুখ নোংরা ইত্যাদি তো আছেই। কিন্তু ও কিছুতেই নিতে দেবে না, চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত গুরুজনদের ‘মাইরের উপর অষুধ নাই’ আপ্তবাক্যটি প্রয়োগ করে ওকে ঠাণ্ডা করা হয়েছিল মনে পড়লো আমার।
এখন এই আধো আলো আধো অন্ধকারে ওর ভাঙাচোড়া কাঠামোটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি ঠাণ্ডা করা বলে একে নাকি হৃদয়ে পাথর চাপা দেয়া বলে।
আমি আবার আজকের দিনটিতে ফিরে আসি। এখন আমার নাদান বোনের কি হবে ভাবার চেষ্টা করি। যে সরল মনে পূর্ণ বিশ্বাসে এবার তার সমস্ত ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিল আব্বার লাভজনক প্রজেক্টে। বিড়াল উপাখ্যানের পর আব্বাজান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে একটি বকরী কিনবেন।
বকরীর দুধ স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তাছাড়া কুমির ভালবাসাটাও কাজে লাগবে অর্থ্যাৎ অপাত্রে যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহনের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একটি গর্ভবতী বকরী কিনে নিয়েও এলেন। আমরা ভাই বোনেরা বিমুখ হয়ে রইলাম। এমনিতেই হাঁস মুরগীর যন্ত্রনায় খেলাধুলার বিশেষ সময় পাই না।
এখন তো মোটেও পাবো না। কিন্তু কুমি কক্ষচ্যূত উল্কার মত ছিটকে গেল আমাদের দল থেকে এবং বিপুল উৎসাহে বকরীটিকে কাঁঠাল পাতা, ভাতের মাড় ইত্যাদি খাওয়াতে লাগল। দেখা গেল ওর সমবয়সীরা যখন গোল্লাছুট, বৌ চিঁ খেলায় ব্যস্ত সে তখন মগ্ন ছাগলের গায়ের উঁকুন বাছায়।
সেই ছাগল মাস শেষ হতে না হতেই এক সংগে তিনটি বাচ্চা প্রসব করে ফেলল। বাচ্চাগুলির লাফালাফির সাথে পাল্লা দিয়ে সেও লাফাতে লাগলো।
এরপর থেকে তার অবকাশ, বিনোদন সমস্ত কিছুর কেন্দ্র হলো এই বাচ্চা ছাগলগুলো। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাটি ছিল খুব দুর্বল। অন্য বাচ্চা দুটির সাথে পাল্লা দিয়ে দুধ খেতে পারতো না। তাই সে আমাদের বুয়ার পরামর্শে ঐ বাচ্চাটিকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলো ।
ফিডার অবশ্য অষুধের খালি বোতলে আমার সবচেয়ে ছোট ভাইটির দুধের বোতলের পুরোনো নিপ্ল লাগিয়ে তৈরী করা হয়েছিলো।
তারপর বকরীর দুধ কিছুটা দুঁইয়ে নিয়ে সেই বোতলে ভরে খাওয়ানো হতে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমাদের বাসার সামনে প্রতিনিয়তই ভীড় লেগে থাকতো। কিছুদিনের মধ্যেই সেই ভীড় থেকে সে একটি উপাধি লাভ করলো ‘ছাগলের মা। ’
‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’ কিন্তু কুমি যত আস্তরিকভাবেই চুরি করুক বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারে না। এবারও অল্প সময়ের মধ্যেই ধরা পড়লো যে, সে তার জন্য বরাদ্দকৃত সবটুকু গরুর দুধই ঐ ফিডারে ভরে নিয়ে যায়।
কারন আব্বার জন্য কিছুটা দুধ দোয়ানোর পর দুটো বাচ্চারই ঠিকমতো হয় না ওদিকে বাচ্চাগুলো বড় হওয়ার সাথে সাথে ছাগলের দুধও কমছে।
আর এ কাণ্ড দেখে তো আম্মা বিশাল হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। এদিকে আব্বাজানও দেখলেন যে, কোন লাভই হচ্ছে না। ছাগল পালিব, দুধ খাইব সুখে তো দূর অস্ত উল্টো ছাগলকেই গরুর দুধ খাওয়ানো হচেছ; মোটেই লাভজনক ব্যাপার নয়। সুতরাং গর্ভবতী ছাগল যেমন হঠাৎ এসেছিল ছাগলের ক্রেতাও তেমনি হঠাৎই গতকাল এসে বাচচাসমেত ছাগল নিয়ে রওনা হলো।
কুমি তো কাঁদতে কাঁদতে ছুটলো ছাগলের পিছনে। কিছুতেই তাকে বোঝানো যায় না। ছাগলের নতুন মালিক ছাগলসহ ভ্যানে চড়ে বসলো। সে তখন ভ্যান ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে ভ্যানের সাথেই দৌড়াতে লাগল। ভ্যানঅলা আর ছাগলঅলা দুজনেই ওকে বকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে দিল।
আর সে চিৎকার দিয়ে ওখানেই বসে পড়লো। অনেক কষ্টে সেই হৃদয় ছেড়া কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে নিজের এবং ওর চোখ মুছে ওকে ফিরিয়ে আনতে লাগলাম।
ফেরার পথে যার সঙ্গেই দেখা হয় সে-ই আট বছরের মেয়েটার কান্না দেখে হাসে আর ঠাট্টা করে,‘কী গো ছাগলের মা কাঁদো ক্যান ? পোলাপান সব পালক দিয়া দিছে সেইজন্য কাঁদো ?’
ওর জন্য প্রচণ্ড কষ্ট হলেও ততক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। তাই নিজের দুর্বলতাকে ঢাকতে আমিও তাঁদের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে হাসি। আমার বয়স পনের বছর।
আবেগ দমন করতে আমি অনেকটাই পরিপক্ক হয়ে উঠেছি। আট বছরের বালিকা যা করতে পারে পনের বছরের কিশোরিকে কি তা মানায় ! যথাযথ হওয়ার পথে আমি ওর চে’ অনেকটাই এগিয়ে।
বাসায় ফিরেও কুমি কেঁদেছে। বিরক্তিকর ছাগলগুলোর বিদায়ে সবাই খুশী হলেও প্রথমে ওর কান্না দেখে
সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও থামাতে পারে না, কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে ওর।
তখন শুরু বকাবকি এরপর জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা, ফলে বমি, সবশেষে চড়।
জমাট স্তব্ধতায় দম আটকে আসে আমার। মন জুড়ে আছে অযুত প্রশ্ন। এতো প্রশ্ন নিয়ে কার কাছে যাই কার ঘাড়েই বা চাপাই এত ক্ষোভের বোঝা। বিছানা ছেড়ে জানালার কবাট খুলে দাড়াই।
আহ্ উঠোন ভরে গেছে ঝরা শেফালী আর বকুলে। সুর্য উঠছে, পূব দিকটায় রঙের কী অপূর্ব ছড়াছড়ি; ও সূর্য আমাকেও এক চিলতে রং দাও........ আমাদের একটা রংধনু বড়ো দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।