When a man has put a limit what he will do, he puts a limit in what he can do
বিদেশে পড়ালেখা করতে আসার পর যে বিষয়টি আমি সবচাইতে বেশি উপভোগ করেছি তা হল- বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতির ছাত্র-ছাত্রীর সাথে পরিচিত হওয়া। সত্যিই….. এক ভিনদেশীর সাথে পরচিতি হতে পারাটা যেন অনেক কিছু!! একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম অনুভূতি। তাছাড়া অন্য দেশের সংস্কৃতি, সভ্যতা, মানুষের ব্যাপারে অনেক কিছু জানা যায়। আমার ভার্সিটিতে প্রায় ১১৭টি দেশের ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করে। আমি প্রথমে অবাক হয়েছিলাম রাশিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের দেখে……. আমি আগে জানতামনা যে রাশিয়াতে এত বেশি মুসলমান আছে।
এতদূর থেকে ওরা পড়তে আসলো মালয়েশিয়াতে, বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম আমি।
তবে সবচাইতে বিস্ময়কর ছিল বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরিত্রের পার্থক্যের বিষয়টা। বিশেষ করে, এই উপমহাদেশের, তথা পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশী-শ্রীলঙ্কা-কাশ্মীরের বেশিরভাগ ছাত্র বেশ আড্ডাবাজ, কিন্তু খুবই মেধাবী। বলতে গেলে এই উপমহাদেশের ছাত্ররাই বেশিরভাগ ভাল রেজাল্ট করে.......
এরপর আসি আফ্রিকান ছাত্রদের দিকে.... প্রথম প্রথম ওদের দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলনা..... এক একটার বডির ফিগার দেখলেই ভয় লাগে। ছোটবেলায় একটা কথা শুনেছিলাম, কিন্তু তা কতটুকু সত্যি জানিনা..... তা হল- হাতিরা জানেনা যে ওদের শরীর এত্তো বিশাল..... কানের জন্য নাকি ওরা ওদের শরীর দেখতে পায়না....... আফ্রিকানদের অবস্থাও এমন..... খুবই নীরিহ।
কেউ ঝাড়ি মারলেই ভয়ে কুঁচকে যায়। আমি প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলাম এ খবর শুনে, আফ্রিকান ছাত্ররা যা বলে মুখে মুখেই, সত্যিই বিপদ এসে গেলে ওরা কিছুই করতে পারেনা, অনেক ভীতু টাইপের। এমনকি বাঙ্গালী ছাত্ররা ঝাড়ি মারলেও দেখি ওদের অবস্থা কেরোসিন!!! অথচ বাঙ্গালী ছাত্রদের সাইজ ওদের আফ্রিকানদের অর্ধেক হবে কিনা সন্দেহ আছে একটা আছাড় দিলেই তো শেষ..... কিন্তু এই জ্ঞান ওদের মাথায় নেই.......
আফ্রিকানরা ফুটবল বলতেই পাগল। বিশেষ করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, স্প্যানিশ লা লিগা, ইতালিয়ান সিরি-আ এর একটা ম্যাচও ওরা মিস দেয়না, সব খেলা দেখে। এমনকি পরীক্ষার আগের রাতেও.......
প্রতিদিন বিকেল বেলা ওরা ফুটবল খেলে মাঠে।
ওদের ফুটবল খেলা দেখে আমি সত্যিই অভিভূত!!! ওদের ফিজিকাল স্ট্রাকচার সত্যিই অনেক মজবুত, স্ট্যামিনা তো অতুলনীয়, আর ফুটবলের টেকনিক তো অসাধারণ!!! আর শরীরের শক্তি তো অসীম....... শেষ হবেনা মনে হয় কক্ষণো...... আমার এ ধারণা হবার কারণ, রমজান মাসেও বিকেল বেলা ওরা ফুটবল খেলা বন্ধ করেনা। রোজা রেখেও ওরা ফুল স্পীডে আগের মতন ফুটবল খেলে!!! আশ্চর্য!!!! বরং আমার কাছে মনে হয় রমজান মাসে ওদের ফুটবল খেলার জোর আগের তুলনায় দু'/তিনগুণ বেড়ে যায়....... যদি কোন বাঙ্গালী কোনদিন ওদের সাথে ফুটবল খেলতে যায়, তাহলে নিশ্চিত এর পরবর্তী এক মাস তার ঠিকানা হবে হাসপাতাল...... আফ্রিকানদের একটা লাত্থিই যথেষ্ট আমাদের হাসপাতালে চিরস্থায়ী করে দিতে......
অন্যদিকে রাশিয়ান ছাত্ররাও বেশ আড্ডাবাজ, পড়ালেখা করে খুবই কম, কোনমতে পাশ করে যায়..... এবং মারামারি করতেও বেশ ওস্তাদ! শুনেছিলাম বিগত কয়েক বছরে রাশিয়ান & আফ্রিকান ছাত্রদের মধ্যে বেশ কয়েকবার মারামারি হয়েছে এবং এর পিছনে আসল কারণ ছিল বর্ণবৈষম্য। এবং বেশিরভাগ সময়ই আফ্রিকান ছাত্ররা মার খেয়ে হাসপাতালে গিয়েছে
এরপর আসি এরাবিয়ান স্টুডেন্টদের ব্যাপারে...... এদের একটা বিষয় খুবই ভাল লাগে আমার....... এদের মাতৃভাষা আরবী হওয়ায় সবার নামই এক্কেবারে খাঁটি আরবী তে উচ্চারণ করে...... যেমন আমার যে সব এরাবিয়ান বন্ধুরা আমাকে ডাকে "তোয়ারিক্ক - طَّارِقِ" বলে ডাকে....... নিজের নামের এক্কেবারে খাঁটি উচ্চারণ শুনে কার না ভাল লাগে বলেন?
আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি-আরব এবং ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ ছাত্র হল উচ্ছৃংখল। আমি প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম, তখন খুব কষ্ট পেতাম ফিলিস্তিনী ছাত্রদের দেখে, কারণ আমি ভাবতাম- আহা ওরা কত গরীব! ওদের প্রিয় জন্মভূমি এখন ইসরাইলের দখলে। তারপরও এতদূরে পড়ালেখা করতে আসছে।
কিন্তু পরে দেখি অবস্থা এর বিপরীত!!! তারাই মনে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে ধনী ছাত্র!!! ফিলিস্তিনী ছাত্রদের বেশিরভাগই ছোটবেলা থেকেই মানুষের দেয়া টাকায় পড়ালেখা করেছে, তাদের স্কলারশিপের কোন অভাব নেই। কারো কাছে সাহায্য চাইলেই তাদের অথই টাকার সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ওদের অবস্থা এখন এমন যে, অহঙ্কারে ওদের পা এখন আর মাটিতে নেই, একদম আকাশে……. বেশ কিছুদন আগে কিছু ফিলিস্তিনী ছাত্র আমেরিকান-ইসরাইলী পণ্য বর্জন করার বিষয়ে একটি প্রোগ্রাম আয়োজন করে। সেই প্রোগ্রামে KFC, McDonalds, Pepsi, Coca-Cola সহ ইত্যাদি বর্জন করার শ্লোগান দেয় তারা। সেদিন রাতেই দেখি সেই ফিলিস্তিনী ছাত্রগুলোই KFC থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে!!!! এই হল তাদের স্বদেশপ্রেম???? পরে বড় ভাইয়াদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, এখানকার ফিলিস্তিনী ছাত্রদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে এসেছে, যারা ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছে সেসব দেশে, যার কারণে ফিলিস্তিনের সত্যিকারে পরিস্থিতি কেমন তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি এদের।
সরাসরি ফিলিস্তিন থেকে আসা ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম এবং এ সকল ছাত্রদের মধ্যেই সত্যিকারের বিদ্রোহী ভাব লক্ষ করা যায় এবং যাদের ব্যবহার, পড়ালেখা এবং অন্যান্য কার্যক্রমও বেশ ভাল।
এরপর আসি সৌদী-আরবের ছাত্রদের ব্যাপারে……. এ দেশের ছাত্রদের নিয়েই মূলত আমার এই লেখাটা। অর্থের মোহে তারা এখন অন্ধ। তাদের মনে দু’ধরনের অহঙ্কার প্রবলভাবে কাজ করে, ১) অঢেল টাকা-পয়সা এবং ২) রাসুল (সাঃ) এর দেশ থেকে এসেছে তারা।
আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসুল এর দেশ থেকে আসার কারণে তাদের ভাব এমন যে, তারা হল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, তাদের চাইতে ভাল আর কেউ হতে পারেনা, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ!!! আর তাছাড়া অর্থের মোহে তারা এতোই অন্ধ যে, অন্য দেশের ছাত্ররা তাদের কাছে মনে হয় যেন খেলনা!
তবে কিছু কিছু সৌদি-এরাবিয়ান ছাত্র আবার অসম্ভব ভাল হয়।
আবদুল রহমান নামক এক সৌদি-এরাবিয়ান ছাত্র আমার সাথেই সব কোর্স নিয়েছে, কিন্তু সে যে কিভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল তা আমার মাথায় আসেনা। Electric Circuits পড়ার সময় খেয়াল করলাম, Series & Parallel Combination কি জিনিষ তা সে জানেনা! এই সকল বিষয়তো বাংলাদেশের ক্লাস নাইনের ছাত্রও জানে!!! শুধু এ বিষয়েই নয়, সকল বিষয়েই তার সমস্যা, কিছুই বুঝেনা সে। এ জন্য সে আমাকে বলল তার বাসায় যেতে, গিয়ে তার সাথে পড়ালেখা করতে। আমি রাজি হলামনা, কারণ আমার এত সময় নেই..... তার উপর ওর বাসা হল ক্যাম্পাসের বাইরে, ভার্সিটি হোস্টেলে অধিকাংশ এরাবিয়ান থাকেনা, কারণ এসিবিহীন রুমে থাকতে ওদের কষ্ট হয়.......।
পরে সে বলল যে তার বাসায় টেলিভিশন, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সহ সবকিছুই আছে, দরকার হলে সে আমাকে নিয়ে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার যাবে, মুভি দেখবে, কুয়ালালামপুর ঘুরে বেড়াবে।
আমি তো অবাক!!! বলে কি ছেলে??? পরে বুঝলাম যে আসলে তার টাকা-পয়সার অভাব নেই, যার কারণে সবকিছুই তার কাছে খুব সহজ। এতকিছু বলার পরেও আমি রাজি হলামনা, এতে সে বেশ মন খারাপ করল। তার এই অবস্থা দেখে বললাম উইকেন্ডে আমার রুমে আসার জন্য, তখন ওকে সব বুঝিয়ে দেব। যদিও এত সময় নেই আমার, উইকেন্ডে ব্যস্ত থাকতে হয় সারা সপ্তাহের পড়া কভার করার জন্য, তারপরও বেচারার বিমর্ষ চেহারা দেখে না করতে পারলামনা।
বেশ কিছুদিন পর……… আজ সে আমাকে হঠাৎ বলল যে সে এখানে আর পড়ালেখা করবেনা, ইউএসএ চলে যাবে।
এর মতন মাথায় গোবরসমৃদ্ধ ছেলে ইউএসএ পড়ালেখা কিভাবে করবে তাই ছিল আমার প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করার পর সে বলল, ওয়াশিংটনের এক ইউনিভার্সিটিতে চলে যাবে দু’ মাসের মধ্যে, কাগজ-পত্র সব তৈরী হচ্ছে আস্তে আস্তে, এই বিশ্ববিদ্যালয় তার ভাল লাগছেনা। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, ওর এপার্টমেন্টে যা যা আছে যাবার আগে আমাকে দিয়ে যাবে, কারণ ও যাবার সময় এতকিছু নিয়ে যেতে পারবেনা। এ আবার কেমন কথা?? আমি কে যে তার সব জিনিষ আমাকে দিয়ে যাবে?? আমি বললাম আমার কিছু লাগবেনা, তোমার জিনিষগুলা তোমার দেশী বন্ধুদের দিয়ে যাও, ওদের কাজে লাগবে। এরপর সে যা বলল, আমি অতিবিস্ময়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম যেন….. সে বলল-All Arabian guys are fuckers..... I don't believe them…………..............হায় হায় হায়!!!! কয় কি পোলা??? ওর এমন মন্তব্যের হেতু কি??? জিজ্ঞেস করার পর সে বলল, কোন এরাবিয়ান ছাত্রই ভাল না, সব দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম এর কারণ কি??? সে বলল, Listen طَّارِقِ, I have a scholarship from my country. They give me 5000 Ringgit per month. Not only me, all Arabian students have scholarship like this. What should a student do with this huge amount of money??? They send us here just for fun, just for play, not for study..... আমার খুবই ভাল লাগল ওর এ কথা শুনে। …… এই প্রথম কোন এরাবিয়ান ছাত্রকে দেখলাম যে নিজেদের ভুলগুলো ধরতে পারল।
এরপর……… আমি ডুবে গেলাম চরম হতাশায়। একটা এরাবিয়ান ছাত্র মাসে ৫০০০ রিংগিত স্কলারশিপ পায়! পরে বড় ভাইয়াদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, ৫০০০ রিংগিতও ওদের কাছে অনেক কম, এমন অনেক এরাবিয়ান ছাত্র আছে যারা মাসে প্রায় ৮,০০০ রিংগিত খরচ করে, অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রতি মাসে!!! অথচ আমার খরচ হয় মাসে ৪০০ রিংগিত অথবা ৮,০০০ টাকা।
আল্লাহ এই মাথায় গোবরসমৃদ্ধ আরবদের কাছেই অঢেল টাকা-পয়সা দিলেন, যারা পড়ালেখার মর্ম বুঝলোনা, ফূর্তি করে, টাকার বিছানায় ঘুমিয়েই জীবন পার করে দিল........ অথচ ওরা এই আরবগুলোর চাইতে হাজারগুণ মেধাবী আমার দেশের গরীব ছাত্রগুলো, যারা টাকা-পয়সার অভাবে বিদেশে পড়ালেখা করতে আসতে পারেনা।
কি আর বলব আমি??? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার...... আল্লাহই ভাল জানেন...... কেন এই অবিচার করেন তিনি????
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।