মিজান রহমান শ্রেষ্ঠ
২০০৪ সালের ১৪ ই জানুয়ারী ।
তখন শীত কাল। আনজুরহাট বাজারের পশ্চিম পাশে ইউনিয়ন পরিষদের পুকুরের নতুন পাকা সিঁড়ির পাঁচ নম্বর ঘাটে বসে রোদ পোহাচ্ছিল একটা কচ্ছপ। সিঁড়ি থেকে একটু উত্তরে সামান্য জঙ্গলের মতো, সেখানে কিসের যেন একটা শব্দ হতেই ঝপাৎ করে পুকুরে লাফ দিল কচ্ছপটি। কিছুক্ষণ পরে আবার মৃদুপায়ে সে আবার সিঁড়ির সেই ধাপেই এসে বসলো।
বড্ড শীত পড়েছে দেশে। এই সকালবেলা পুকুরের পানি যেন বরফ হয়ে গেছে। তাই ডর ভয় রেখে বারবার পুকুরের পাড়ে ছুটে আসে কচ্ছপটা। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল, "কি কচ্ছপ মিয়া, শীতে দেখি কাবু হয়ে গেছ। "
কচ্ছপ তখন হাত পা মাথা তার খোলের মধ্যে যত্ন করে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
পিছন থেকে কে ডাকলো দেখার জন্য মাথা বের করে তাকালো। আরে, এ দেখছি খরগোছ। এ অঞ্চলে তো খরগোশ দেখা যায় না। কচ্ছপ জিজ্ঞেস করলো, " খরগোশ ভাই, তুমি আইলা কোত্থেকে?"
- "আমি ছিলাম বরিশাল। " খরগোশ মনের সুখে গল্প শুরু করে, "একটা ওষুধ কোম্পানীতে বন্ধি আসিলাম।
বাবুর হাটের এক লোক পালোনের জন্য কিনে আনলো। বকশী ঘাটে লঞ্চ ভিড়তেই সুযোগ পাইয়া দিলাম লাফ। এক দৌড়ে এই খানে হাজির হলাম। "
- "তা এখন যাইবা কই, থাকবা কই?"
- "কত দিনইতো বন্ধী আসিলাম। ছাড়া যখন পাইছিই আল্লাহর রহমতে যেই খানে আনন্দ ফুর্তি কইরা কাটাইতে পারমুই।
তয় তোমারে দেইখা একটা কথা মনে পড়লো। "
- "কি কথা?"
- "ছোটবেলায় শুনছি একবার নাকি কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড়ের পাল্লা হইছিল। খরগোশ জিততে পারেনাই। "
- "ধুর! অইসব বানাইন্না গল্প। সত্যি সত্যি কি অমন কিছু হয়?"
- "তাহলে এককাজ করি আমরা দুইজনে পাল্লা দিয়া দেখি।
"
- "কি যে কন আমি মইরা গেলেও কি আপনার লগে পারমু?"
- "চলোনা পাল্লাটা দিয়াই দেখি। "
যেই কথা সেই কাজ। দুইজনের দৌড়ের পাল্লার দিন তারিখ ঠিক করলো। আনজুর হাট থেকে শুরু হয়ে দৌড়ের পাল্লা শেষ হবে ভোলা এ রব স্কুল মাঠে।
।
২।
শুরু হলো আনজুরহাট স্কুল মাঠ থেকে খরগোশ কচ্ছপের দৌড়ের পাল্লা। খবর পেয়ে বনের পশু পাখি সব হাজির হলো।
এটনশান। এক - দুই - পিপিপ।
খরগোশ ও কচ্ছপ দুইজনই দৌড় শুরু করলো।
খরগোশ দুই লাফে হোটেল আল মদিনা হোটেল আল মক্কার সামনে হাজির হলো। এখান থেকে চরফ্যাশনের উদ্দেশ্যে টেম্পু ছাড়ে। আনজুরহাট থেকে টেম্পু ছাড়া কোন বাস চলাচল করেনা। মাঝে মাঝে দুই একটা বেবি টেক্সি যায়, তা খুবই কম।
খরগোশ তাড়হুরো করে একটা টেম্পুতে উঠে বসলো। কিন্তু টেম্পু ছাড়তেও আরো ১০ মিনিট বাকী। খরগোশ অধৈর্য হয়ে কি করবে ঠিক করতে পারছিল না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কচ্ছপ চলে এলো কিনা। না ১০ মিনিটে কচ্ছপ এখানে আসতে পারবে বলে মে হয় না।
তবু ও একটা বেবি টেক্সি বা একটা টেম্পু রিজার্ভ য়োর জন্য খোজ করলো। সেভাবে কিছুই পাওয়া না যাওয়ায় অধৈর্য খরগোশ টেম্পুর সামনে গিয়ে ডান পাশের সিটে বসতে চাইলো। টেম্পুর ড্রাইভার একটা হুংকারের মতো ধমক দিয়ে বললো, " এই মিয়া এইখানে বইসা আলতাফ কাজী মরছে, আপনিওকি মরতে চান? এইখানে বসা নিষেধ। মরতে না চাইলে ভিতরে গিয়া বসেন। "
সে আর এক কাহিনী।
চরকলমীর মায়া গ্রামের আলতাফ কাজী নামের এক লোক কয়েক বছর আগে চরফ্যাশন থেকে আনজুরহাট আসার পথে টেম্পুর সামনের ডানপাশের সিটে বসেছিল। লেতরা বাজারের কাছাকাছি আসতেই টেম্পুর ইণ্জিনের সাথে গলার চাদর পেচিয়ে মারা গেল। টেম্পু মালিক সমিতি ২০হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো আর কখনো টেম্পুর সামনের ডান দিকে কাউকে বসানো হবেনা।
খরগোশ টেম্পুর ভিতরে এস বসলো। কাটায় কাটায় ১০ মিনিট পূর্ণ হয়ে ২ মিনিট বেশি হলো তখন টেম্পুর লাইন ম্যান টেম্পুর গায়ে ঝপাং ঝপাং থাপ্পর মেরে স্টার্ট দিতে বললো।
ঠিক তখনই মতিন মাষ্টারের দোকানের সামনে কচ্ছপকে গুটি গুটি পায়ে আসতে দেখা গেল। হেলপার কচ্ছপকে উদ্দেশ্য করে ডাকলো, "এই লেতরা চরফ্যাশন। " টেম্পুতে ৫ জনের সিটে ৭ জন করে বসা হয়ে গেছে তার পরও কচ্ছপকে ডাকতে দেখে খরগোশের মাথায় রক্ত উঠে গেল। চিৎকার দিয়ে বলল, "হেই মিয়া আর কতজন লইতে চাও? কচ্ছপের লগে আমি পাল্লাদিছি ারে লইয়ো না। লাগলে ২ টাকা বেশী দিমু, ছাড়ো তাড়াতাড়ি।
"
আনজুরহাট থেকে থেকে লেতরা যেতে কলমী ব্রিজ হয়ে কমলী আইচা মোর পর্যন্ত নতুন পিচঢালাই রাস্তা তাই ভালোই চলছিল টেম্পুটি। কিন্তু রসুলপুর কলেজের সামনে কি হলো বুঝার আগেই মাথায় রডের সাথে আঘাত লেগে মাথার তালু ফুলে গেল। এরপর শক্ত করে বসলো খরগোশ। কিন্তু লেতরা পার হয়ে চরফ্যাশন পর্যন্ত রাস্তা আরও খারাপ। খরগোশ একে বারে তার বাপ দাদার নামও ভুলে গেল।
চরফ্যাশন এসে শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে রক্তারক্তি করে টেম্পু থেকে নামলো খরগোশ। এরপর টেম্পু স্টান্ড থেকে ২ / ৩ লাফে চরফ্যাশন বাসস্টান্ড পৌছলো। বাসস্টান্ডে অনেকক্ষন ঘোরাফেরার বুঝলো লোকাল এই মুড়ির টিন বাসে গিয়ে কোন লাভ হবেনা। তার চেয়ে অন্য কোন পথ ধরতে হবে। বাস স্টান্ড থেকে বেরিয়ে একটু সামনে আগাতেই দেখলো মাইক্রোবাস।
সে মাইক্রোবাসের সাথে দরকশাকশি করার চেষ্টা করে ও লাভ হলো না । কোন মাইক্রোবাসই বোলা পর্যন্ত যাবেনা। লালমোহন পর্যন্ত যাওয়া যাবে। পরে একজন তাকে বুদ্ধি দিল টিবি স্কুলের কোনায় ভোলা যাবার ডাইরেক্ট বাস আছে। খরগোশ ২ লাফে সেখানে চলে এল।
একি অবস্থা এখানে প্রচন্ড ভীড়। ডাইরেক্ট মিনিবাস কাউন্টারে গিয়ে মস্ত বিপদে পড়লো। পরের ২ টি বাসের টিকিটও নাকি বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। টিকেট কাউন্টারে ১০ টাকা ঘুষ দিতে চেয়েও কোন কাজ হলোনা । খরগোশ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষন বসে রইলো।
মনে মনে ভাবলো এমন জানলে সে কোন দিনও কচ্ছপের সাসে দৌড়ের পাল্লা দিতে চাইতো না। এখন কি আর করা।
। ৩।
কচ্ছপ পিলপিল করে হেটে আনজুরহাট স্কুল মাঠ থেকে মিদিনা হোটেরের সামনে থেকে কোন টেম্পু না পেয়ে রিক্সায় উঠলো।
কলমী মোর থেকে দক্ষিন আইচা থেকে আসা বাসে উঠে বসলো। বাস লেতরা এসে ১৫মিনিট দাড়িয়ে রইলো। কচ্ছপ অধৈর্য না হয়ে বাস থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে কিছু চা নাস্তা করে নিল। চরফ্যাশন এসে ডাইরেক্ট বাসের কাউন্টারে প্রচন্ড ভিড় দেখে লোকাল বাসস্টান্ড ফিরে এলো এবং লোকাল বাসে উঠে বসলো।
।
৪।
এদিকে ডাইরেক্ট বাসের ভিড় আর টাইম টেবল দেখে কাউন্টারের লোকজনের সাথে খরগোশের একচোট রাগারাগি হয়ে গেল। গাড়ী ছাড়ার ২ মিনিট মাত্র বাকী অথচ বাসের খবর নাই, তখন যাত্রীরা চিৎকার চেচামেচি করতেই দেখা গেল লোকাল বসের চেয়ে অনেক নিম্নমানের একটি জীর্ণশীর্ণ বাস এসে হাজির হলো। সবাই চেচামেচি করে উঠলো, " বাস আইছে, বাস আইছে। "
যাত্রী নামতে না নামতেই টিকেট হাতে লোকজনের ভিড় লেগে গেল।
শেষে গাড়ীর হেলপারের সাথে খাতির করে বাসে দাড়িয়ে যাওয়ার জন্য উঠতে হলো।
অবশেষে, মুড়িরটিন সাইজের ফুল লোডিং ডাইরেক্ট বাসে মুরগীর খাচার মত হালুয়া টাইট করে বাস ছড়লো। বাস খুব দ্রুত থেকে দ্রুতই ছুটে চললো। কিন্তু রাস্তা খুব খারাপ হওয়ায় খরগোশের জান বের হবার উপক্রম হলো। একে একে লালমোহন, বোরহানউদ্দিন বাস বোঝাই হলো।
খরগোশ হাতের ঘড়ির দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই লোকজনের ভিড়ে ঘড়ির দিকে তাকানো সম্ভব হলোনা। খরগোশের মনে হলো সে হেরে যাচ্ছে কচ্ছপই বুঝি ফাস্ট হয়ে যাচ্ছে। সে বাসের ড্রাইভার কে অনুরোধ করলো আরো জোরে চালানোর জন্য। ড্রাইভারও চেষ্টা করলো আরো জোরে চারানোর জন্য। ঘুইংগার হাট আসতেই বাস একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা রেগে খাদে পড়ে গেল।
........ । আধাঘন্টা খরগোশের কোন জ্ঞান ছিলনা। জ্ঞান ফিরতেই সে দেখলো তার হাতে সেলাইণ ঝুলছে, সে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি।
। ৫।
কচ্ছপ লোকাল বাসে করে যথা সময়ে কচ্ছপ ভোলা এ রব স্কুল মাঠে হাজির হলো।
----------- শেষ--------------
[খরগোশ ও কচ্ছপের কাল্পনিক চরিত্রে আনজুরহাট থেকে ভোলা সড়ক পথের বর্ণনা করা হলো]
নীতিবাক্য : সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী
রচনাকাল ঃ এপ্রিল ২০০৪
মাসিক কলমীকণ্ঠ মে ২০০৪, বৈশাখ ১৪১১ সংখ্যায় প্রকাশিত
মিজান রহমান শ্রেষ্ঠ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।