আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে নতুন মুখ মুজিকা



লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে নতুন মুখ মুজিকা কিউবা ছিলই। ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়ার পর এবার উরুগুয়েও রায় দিলো বামপন্থার পক্ষেই। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন প্রাক্তন বামপন্থী গেরিলা নেতা জোসে মুজিকা। ডাক নাম ‘পেপে'। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রাক্তন জুন্টা সরকারের গোঁড়া সমর্থক পেড্রো বোর্ডাবেরী এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লুইস লাকালে।

২৯শে নভেম্বর দ্বিতীয় দফার ভোটে রেডিক্যাল লেফটিস্ট তুপামারোজ আন্দোলনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জোসে মুজিকা নির্বাচনে ৫১শতাংশ ভোট পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লাকালেকে হারান। লাকালে ১৯৯০থেকে ১৯৯৫সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ৭৪বছর বয়সী মুজিকা তার পূর্বসূরী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট তাবারী ভাসকুয়েজের বামপন্থী অর্থনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখবেন। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ভাসকুয়েজ। ৫বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি আর নির্বাচনে অংশ নিতে চান নি।

পর্যবেক্ষকরা শুরুতেই বলেছেন, মুজিকা স্পষ্টত এগিয়ে। কারণ, ২০০৮-এ বিশ্বে যখন চরম অর্থনৈতিক মন্দা, ভাসকুয়েজের সরকারের দক্ষতায় উরুগুয়েতে সেই মন্দার ধাক্কা লাগেনি। এই ভাসকুয়েজ সরকারের কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মুজিকা। সামরিক জুন্টা সরকারের রোষানলে পড়ে ১৯৭৩সাল থেকে ১৯৮৫সাল পর্যন্ত জেলে বন্দী ছিলেন মুজিকা। উরুগুয়ের রাজনৈতিক দল ‘টুপামারোস আরবান বিবেল মুভমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি একজন।

১৯৮৫সালে উরুগুয়ে থেকে সামরিক শাসন উচ্ছেদ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর জেল থেকে ছাড়া পান মুজিকা। মুজিকার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা ছিলো রক্তাক্ত। উরুগুয়ের সেই ইতিহাসজুড়ে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন। ষাটের দশকের উরুগুয়ে মানে সেই সময়ের লাতিন আমেরিকার সব থেকে গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিকভাবে সব থেকে সংগঠিত জনকল্যাণকামী দেশ। তিরিশ লক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার জন্য মাত্র ১২হাজার লোকের সেনাবাহিনী।

কিন্তু কোরিয়ায় যুদ্ধের সময় উরুগুয়ের প্রধান রপ্তানিযোগ্য সামগ্রী উল ও মাংসের বাজার ধাক্কা খায়। যার ফলে তীব্র বেকারী সৃষ্টি হয়। মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকে। এর ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক অস্থিরতার পরিবেশেই জন্ম নেয় গুপ্ত গেরিলা সংগঠন টুপামারোস।

টুপামারোস যার আসল নাম ‘ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট’। ১৯৬৩সালে রাউল সেনভিক নামক এক আইনের ছাত্র এই সংগঠনটি তৈরি করেছিলেন। এই সংগঠনের কার্যকলাপ মূলত রাজধানী মল্টিডিভিওতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণত ব্যাঙ্ক লুঠ করা, বড় ব্যবসায়ীদের ভয় দেখানো এবং নানা নাশকতামূলক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত করে তোলাটাই এদের কাজ ছিল। আর কাজ ছিল অপহরণ।

অন্তত সে সময়ের উরুগুয়ের অধিকাংশ সংবাদপত্রের বিশ্লেষণ ছিলো তাই। ষাটের দশকের শেষের দিকে উরুগুয়ের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। শুরু হয় প্রবল শ্রমিক বিক্ষোভ এবং ছাত্রদের আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় জরুরী অবস্থার ঘোষণা করে উরুগুয়ের সরকার। বাড়তে থাকে সামরিক খাতে ব্যয়বরাদ্দও।

১৯৬৮সালে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর পরই তৈরি হয় ২০হাজার মেট্রোপলিটান গার্ড। যার কাজ ছিল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে মোকাবিলা করা। ১৯৭১সালের নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে বামপন্থী দলগুলির যৌথ মঞ্চ তৈরি হয় যার নাম ছিল ফ্রেন্ডে এম্প্লিও। টুপামারোস এই নির্বাচনে ফ্রেণ্ডে এমপ্লিও-কে সমর্থন জানায়। যদিও এই জোট নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি।

১৯৭২সালের এপ্রিলে উরুগুয়ের রাষ্ট্রপতি হুয়ান মরিয়া বোর্দাবেরি টুপামেরোসের বিরুদ্ধে ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ’ ঘোষণা করেন। পুলিস এবং মেট্রোপলিটান গার্ডের সাথে এই ‘যুদ্ধে’ সৈন্যবাহিনীকেও নামানো হয়। ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়, শুরু হয় টুপামারোসের গেরিলা বাহিনীদের ধরে ধরে খুন করা। ১৯৭২সালের নভেম্বরের মধ্যেই টুপামারোস কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে ময়দানে নেমে পড়েছে সৈন্যবাহিনী আর তার অন্তরালে সি আই এ।

১৯৭৩-এ নির্বাচিত জাতীয় পরিষদকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়। শুরু হয় সামরিক শাসন। অর্থাৎ, সি আই এ মারফত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ দখলদারি। ১৯৭০ সালে টুপামারোস সব থেকে বড় যে ‘অপরাধ’টি করেছিল তা হলো, সি আই এ প্রধান এজেন্ট ভ্যান মিত্রিওনের হত্যা। ভ্যান মিত্রিওনে— মল্টিভিডিওতে সি আই এ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অফিস অব পাবলিক সেফ্টি (ও পি এস) মিশনের প্রধান।

টুপামারোস গেরিলাদের উপর সব থেকে নগ্ন নির্যাতনের দায়িত্বে ছিল এই ও পি এস। মিত্রিওনে ‘নির্যাতন’ কে ‘শিল্পের’ পর্যায়ের উন্নত করতে চাইছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ১৬জন উরুগুয়ের পুলিস অফিসারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে ‘নির্যাতন’ করার বিশেষ পদ্ধতি শেখানো হয়। ওয়াশিংটন, লস্ ফ্রেসনস এবং টেক্সাসে সি আই এ-ও পি এস পরিচালিত প্রশিক্ষণ স্কুলে বোমা তৈরির বিশেষ প্রশিক্ষণও এদের দেওয়া হয়। তাঁর সময়কালে ও পি এস তৃতীয় বিশ্বের প্রায় ১০লক্ষ পুলিসকর্মীকে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেয়।

উরুগুয়ের ও পি এস এর কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখা হতো। এবং মিত্রিওনে এইসব পরীক্ষা নিজের হাতেই করতেন। ১৯৭০সালের ৩১শে জুলাই টুপামারোস ভ্যান মিত্রিওনেকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করা হয় ১৫০জনের মতো সাধারণ মানুষের মুক্তি, যারা জেলে বন্দী ছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের নির্দেশে উরুগুয়ের সরকার তা নাকচ করে দেয়।

এরপরই ১০ই আগস্ট পাওয়া যায় ভ্যান মিত্রিওনের মৃতদেহ। ১৯৭০সালেই বন্ধ হয়ে যায় ও পি এস। । তার জায়গা নেয় ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডি ই এ)। এই ডি ই এ ড্রাগ ট্রাসিকিং বন্ধ করার নামে গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে গেরিলা যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে থাকে।

সি আই এ-র পরিকল্পনা অনুযায়ী গেরিলা বাহিনী ও কমিউনিস্টদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ১৯৭৩ এ উরুগুয়ের গণতন্ত্রকে হত্যা করে জারি হয় সামরিক শাসন। ১৯৮৫সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের মানুষ গণতন্ত্রের আলো দেখতে পাননি আর। ‘People were in prison, so that prices could be free’ তাঁর দেশের সামরিক শাসনের এই পর্বকে এভাবেই দেখেছেন উরুগুয়ের প্রখ্যাত লেখক এদোয়ার্দো গেলিয়ানো। স্বাভাবিকভাবেই প্রমাদ গুনছে ওয়াশিংটন।

কারণ লাতিন আমেরিকায় তৈরি হয়ে গেছে আর এক নতুন আমেরিকা। বশ্যতার লাতিন নয়, এ লাতিন প্রতিরোধের।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।