দামদর ফাইনাল হবার পর আয়েশা তার নতুন বেগম সাহেবকে বললো, আমার ছোট দুইডা পোলা মাইয়া আমার লগে পর্তেক দিন আইবো।
কেন ? বেগম সাহেব বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন।
-আমি বস্তিত যেই ঘরে থাহি ওইডা খালের উর্ফে। বস্তির সবতে ত' কামে জায়গা। হেরারে আমি কই রাইক্কা আমু ? পানিত পইরা গ্যালে তুলবার কেউ ত' থাহে না।
-তাইলে তুমি বাদ।
আয়েশা কেদেঁ ফেলে বললো, পোলা মাইয়া দুইডারে আমি কই রাকতাম ? হেরা এককানে চুপচাপ বইয়া থাকবো।
-কোথায় থাকবে ?
-পাক গরে।
-ভালোই বলেছো। আরামে আমার সব খাবার খেয়ে তোমার পোলাপানের পেট মোটা হবে।
-তাইলে আফনেই কন কই রাকতাম।
-সিড়ির নিচে চুপচাপ বসে থাকবে।
-আইচ্চা।
-পোলাপানের কথা বলে বেশি ভাত চাইতে পারবা না। তোমার জন্য শুধু দেবো।
পোষালে থাকো। নাইলে পথ দেখো।
-ঠিক আছে। আপনে যা দিবেন তাই।
-কাল থেকে আসো।
পরদিন এসে বাচ্চা দু'টিকে সিড়ির নীচে রেখে কাজে লাগলো আয়েশা। এদের সাথে রাখার কারণে কেউ কাজে রাখতে চায়না। তবু ভালো যে এই বেগম সাহেব রাজী হয়েছেন।
সিড়ির নীচে বসে ভাই বোন কি করবে বুঝতে পারছে না। মা বার বার বলেছে বের হলে বা দুষ্টুমি করলে বেগম সাহেব মারবে।
তাই বসে বসে গল্প শুরু করে। নিজেদের হাতে তৈরী মাটির খেলনা আছে। কিন্তু মেঝে ময়লা হবার ভয়ে সেটা বের করতে পারেছে না। এমন সময় বেগম সাহেব সামনের লনে বের হলেন নিজের মেয়েকে নিয়ে। মেয়েতো সিড়ির নীচে দুই পিচ্চিকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
একা একা কার্টুন,টিভি,খেলনায় আর মন ভরছে না। মাকেও পায়না বেশীরভাগ সময়ে। মাকে টেনে নিয়ে এলো সিড়ির কাছে। এ দুটিকে দেখে প্রথমে রেগে গেলেও পরে বেগম সাহেবের মনে পড়লো বুয়ার কথা। মেয়েকে বললেন, এরা বুয়ার ছেলে মেয়ে।
নোংরা, পচা। তুমি ওদের কাছে যাবে না। বলে মেয়েকে নিয়ে লনের দিকে চলে গেলেন।
বুয়ার ছেলেটা ভয়ে ভয়ে সব শুনে বললো, বুবু আমরা বুঝি পচা ? পচা কি ? বুবু বললো, বাই আমিও জানি না। পচা মাইনে খারাপ কিছু অইবো।
আহো, আমরা বইয়া থাহি।
-আইচ্ছা বুবু, মাইয়াডার আতে গোল অইলদা রঙের ওইডা কি ?
-কমলা। খাওনের জিনিস।
-তুমি খাইছ কুনুদিন? খাইতে কেমুন ?
-না বাই, খাই নাই। জানি না খাইতে কেমুন।
কাজের ফাঁকে বুয়া এসেছে বাচ্চাদের দেখতে। মাকে পেয়েই ছেলে বলে, ''মা, কমলা খামু। '' শুনে তো বুয়া আকাশ থেকে পড়লো।
- বাজান, তুমি কমলা কই দেকলা ?
-ওই মাইয়্যাডার কাছে। বলে বেগম সাহেবের মেয়েকে দেখিয়ে দিলো।
-সব্বনাশ বাজান। আর কুনদিন মুখে আইনো না। বলে বুয়া চলে গেলো।
কিন্তু ছেলে কমলার দিকে অপলক চেয়ে রইলো।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আবার মাকে বললো, মা কমলা খামু।
শুনে আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাজানরে, কমলা কিনতে বহুত ট্যাকা লাগে। ট্যাকা কই পামু। কিন্তু ছেলের গোঁ- মা, কমলা খামু।
-আইচ্ছা খাইয়ো। অহন গুমাও।
পরদিন ওদেরকে সিড়ির নীচে রেখে মা কাজে গেলো। ভাইবোন বসে আছে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর বাবুটার বাথরুম পেলো। ওকে রেখে বোন গেলো মার কাছে খবরটা দিতে। মা পড়লো বিপদে।
কোন বাথরুমে নেবে। ভেতরে কোন ঘরে আনা যাবে না কারণ বেগম সাহেবের বারণ আছে। অগত্যা ড্রাইভারের কাছে বললো। কিন্তু ড্রাইভার তার বাথরুম ব্যবহার করতে দিতে রাজী হলো না। দেরী দেখে বাবুটা কাঁদতে শুরু করলো।
কান্না শুনে বেগম সাহেব রেগে গেলেন-এ জন্যই এই সব আপদ রাখতে চাইনা। ভয়ে বাবুর কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। অগত্যা বেগম সাহেবকে বলে বাড়ির বাইরে ড্রেনে নিয়ে যেতে হলো। দেরী আর ভয়ে বাচ্চাটা ঘেমে নেয়ে একাকার।
আয়েশা কাজ করতে করতে দেখলো কমলার খোসা।
সাথে ছোট একটা কমলার কোয়াও লেগে আছে। দেখেই ছেলের কমলা খাবার বায়নার কথা মনে পড়লো। আস্তে করে কোয়াটা খুলে কোমরে গুঁজে নিলো।
কাজ করছে বুয়া। এরমধ্যে শোরগোল।
একটা কমলা পাওয়া যাচ্ছে না। বুয়াকেসহ অন্য কাজের লোকদের লাইন করে দাঁড় করানো হলো। সবাইকে চেক করা শুরু হলে বুয়ার কোমরে গোঁজা কমলার কোয়া বের হলো। সাথে সাথে চুলের মুঠি ধরে মার। কোন প্রশ্ন করা বা জবাব নেয়ার বালাই নেই।
মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুয়া দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। মারের কষ্টের চেয়ে চাকরি হারানোর বেদনাই আয়েশাকে শোকে কাতর করে ফেললো। বাচ্চাদের সাথে রাখার কারণে কেউতো কাজে রাখে না। এই বেগম সাহেব রেখেছিলেন। মায়ের দুরবস্থা দেখে বাবু কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি কমলা খামু না, মা।
ডুকরে কেঁদে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো আয়েশা।
রাতে না খেয়ে ঘুমাতে গেলো। ছেলেমেয়ে দুটি ক্ষুধায় কেঁদে কেঁদে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। ঘুম এলো না আয়েশার চোখে। কাল কি করবে ভেবে আবার কান্না পেলো।
কাঁদতে কাঁদতে ছেলের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে দেখে শার্টের পকেটটা একটু ভেজা। হাতদিয়ে দেখা গেলো এক টুকরা কমলার খোসা চ্যাপ্টা হয়ে আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।